ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়

“ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়।” ব্যাখ্যা কর।

earn money

ভূমিকা: রাষ্ট্র একটি জৈব সত্তা, যেখানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বলতে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, শাসন, এবং বিচার ক্ষমতা পৃথক ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে অর্পণ করা বোঝায়, যাতে এক বিভাগ অন্য বিভাগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে। তবে, এই নীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং বাঞ্ছনীয়ও নয়। কারণ, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এমনভাবে পরস্পর নির্ভরশীল যে, তাদের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ রাষ্ট্র পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টি করে। 

১. পরস্পরের সম্পর্কিত কার্যাবলী: সরকারের তিনটি বিভাগ—আইনসভা, নির্বাহী, এবং বিচার বিভাগ—নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এক বিভাগ অপর বিভাগের কাজও কিছুটা করে থাকে। যেমন, আইনসভা আইন প্রণয়ন করে, কিন্তু সেই আইন কার্যকর করে নির্বাহী বিভাগ, এবং আইন লঙ্ঘনের বিচার করে বিচার বিভাগ। তাই, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করা সম্ভব নয়।

আরো পড়ুনঃ চাকমা ও গারো এথনিক গোষ্ঠীর জীবনধারা আলোচনা কর। 

২. শাসনব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টি: অধ্যাপক লাস্কি মনে করেন, যদি সরকারের তিনটি বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করা হয়, তাহলে প্রতিটি বিভাগই নিজ নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে তা অন্যের উপর চাপানোর চেষ্টা করবে, ফলে সমগ্র শাসনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে। 

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


৩. জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের জন্য অনুপযোগী: কল্যাণমূলক রাষ্ট্র এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পরিবহন, এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মতো জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকারের নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের সমন্বয় অপরিহার্য। কিন্তু যদি ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ করা হয়, তাহলে এই বিভাগগুলোর মধ্যে একতা নষ্ট হবে, এবং কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।

৪. ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন বিভাগ প্রধান ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও আইন প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দু। আইন বিভাগ শুধু আইন প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং সরকার ও বিচার বিভাগের কাজেরও তত্ত্বাবধান করে। যদি ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ করা হয়, তবে এই ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে, কারণ আইনসভা ও বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে এবং শাসনব্যবস্থায় অকার্যকরতা দেখা দেবে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের  ভূমিকা পর্যালোচনা কর।

৫. সরকারের অখণ্ড সত্তা: সরকার কেবল আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ দ্বারা গঠিত একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়, বরং এটি একটি অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা। সরকারি কার্যাবলি পরস্পর সম্পর্কিত এবং একটির সাথে অপরটি জড়িত। ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ হলে, এই বিভাগগুলোর মধ্যে কোনো কার্যকর সমন্বয় থাকবে না, যার ফলে সরকার পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

৬. দায়িত্বহীনতার সৃষ্টি: যদি সরকারের তিনটি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে যায়, তাহলে তারা নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা দেখাতে পারে। যেহেতু এক বিভাগ অপর বিভাগের উপর নজরদারি রাখবে না, তাই দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখা দেবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আইনসভা মনে করে যে আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধুমাত্র নির্বাহী বিভাগের, এবং নির্বাহী বিভাগ মনে করে যে ন্যায়বিচারের দায়িত্ব একমাত্র বিচার বিভাগের, তাহলে দায়িত্বশীলতার অভাব দেখা দেবে এবং জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

৭. কর্মক্ষমতা হ্রাস: সরকারের প্রতিটি বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। ক্ষমতার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ করলে বিভাগের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়, যা প্রশাসনিক কার্যক্রমকে ধীরগতির করে তোলে।

৮. অস্বাভাবিক ব্যক্তিস্বাধীনতা: ব্যক্তিস্বাধীনতা মানে ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতা নয়, বরং তার অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে একটি ভারসাম্য। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত স্বাধীনতা প্রদান করতে পারে, যা সমাজের নীতিশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

৯. বিচার বিভাগের কার্যকারিতা: বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রতা কখনো কখনো বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে। নির্বাহী ও আইন বিভাগের সাথে সামঞ্জস্য না থাকলে মামলার নিষ্পত্তি দীর্ঘায়িত হতে পারে এবং জনগণ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

১০. সংকট মোকাবিলায় সমন্বয়ের প্রয়োজন: যেকোনো জাতীয় সংকট বা দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য। ক্ষমতার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ হলে এই সমন্বয় কঠিন হয়ে পড়বে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাস আলোচনা কর। 

১১. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আইন, নির্বাহী, এবং বিচার বিভাগের সমন্বয় প্রয়োজন। যদি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির উপর বিচার বিভাগের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক চুক্তির বৈধতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

১২. সাংবিধানিক স্থিতিশীলতা: সংবিধানের সঠিক প্রয়োগ ও ব্যাখ্যার জন্য সরকারের তিন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য। যদি আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ একে অপরের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তাহলে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে।

১৩. জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস: সরকারের তিন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকলে জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি প্রতিটি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে এবং একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে জনগণের মনে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অনাস্থা সৃষ্টি হতে পারে।

১৪. নীতিনির্ধারণে জটিলতা: সরকারের কার্যকর নীতিনির্ধারণের জন্য আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি। যদি এই বিভাগগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত না থাকে, তাহলে নীতিনির্ধারণ জটিল হয়ে পড়বে এবং সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দেরি হবে।

১৫. সাংবিধানিক সংশোধনীতে বাধা: একটি রাষ্ট্রের সংবিধান কখনোই স্থির নয়; সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যদি ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ করা হয়, তাহলে আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেবে। ফলে, সংবিধান সংশোধন বা আইন পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে পড়বে, যা একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

১৬. সামাজিক ও নৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা: ক্ষমতার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সমাজে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। আইন, বিচার এবং নির্বাহী বিভাগের পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য না থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও সমানাধিকার নিশ্চিত করতে ক্ষমতার একটি নিয়ন্ত্রিত বিন্যাস প্রয়োজন।

আরো পড়ুনঃ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বলতে কি বুঝ? তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ভূমিকা

উপসংহার: ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ বাস্তবসম্মত নয় এবং এটি আদর্শও নয়। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যদি এই বিভাগগুলোর মধ্যে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য না থাকে, তবে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে, জনগণের অধিকার খর্ব হবে, এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। তাই, ক্ষমতার স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেও পরস্পরের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এটি রাষ্ট্রীয় কার্যকারিতা, ন্যায়বিচার, এবং গণতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক হবে। সুষ্ঠু প্রশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে ক্ষমতার ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক