“ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম”- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো এর সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা, যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌম বলা হয় কারণ এটি দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান এবং এর সিদ্ধান্তকে কোনো আদালত বা সংবিধান চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংসদীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি যা আইন প্রণয়ন, সংশোধন এবং বাতিল করার ক্ষমতা সংসদের হাতে রাখে।
পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের ভিত্তি: গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত। সুতরাং, লিখিত আইন অনুযায়ী। পার্লামেন্টের সার্বভৌম মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ব্রিটেনের শাসনতান্ত্রিক অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মতো পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বও হলো সুদীর্ঘকালের ক্রমবিকাশের ফল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন, সাংবিধানিক রীতিনীতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে। পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব বলতে আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে পার্লামেন্টের নিরঙ্কুশ, অবাধ ও চরম ক্ষমতাকে বুঝায়, যা কোন ব্যক্তি আদালত এবং প্রতিষ্ঠান প্রণীত আইনের বৈধতা এবং সাংবিধানিকতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে না।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি: ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব আইনগত রাজনৈতিক নয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে কোন আইন প্রণয়ন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। আইনগত বিচারে পার্লামেন্টের ক্ষমতা অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যার হাতে আইন প্রণয়নের চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকে, আইনগত দিক থেকে সে ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ সার্বভৌম। ব্রিটেনের আইন প্রণয়নকারী একমাত্র সংস্থা হলো পার্লামেন্ট। সুতরাং, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাতে আইনগত সার্বভৌমত্ব ন্যস্ত আছে।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের গারো উপজাতির আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা সম্পর্কে আলোচনা কর।
Prof. Dicey এর মতে, “ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিরঙ্কুশ আইনগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।” তিনি এ সম্পর্কে তিনটি মন্তব্য করেছেন। যথা:
- ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে।
- পূর্বে প্রণীত যে কোন আইনকে সংশোধন বা বাতিল করতে পারে এবং
- শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে পারে।
আরো দুটি বিষয় থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যথা ও প্রথমত, যুক্তরাজ্যে সাংবিধানিক আইন এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য নিরূপণ করা হয় না। এখানে পার্লামেন্টের আইনই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। দ্বিতীয়ত, রাজা বা রানীর ডোমিনিয়নগুলোর ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতা প্রযুক্ত হয়।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব
১. সংসদীয় সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞাঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্টীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা আইনজ্ঞ এ.ভি. ডাইসি (A.V. Dicey) প্রথম সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, সংসদ যেকোনো আইন প্রণয়ন, সংশোধন বা বাতিল করতে পারে এবং এর সিদ্ধান্ত আদালত দ্বারা চ্যালেঞ্জ করা যায় না। এটি ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
২. সংবিধানের লিখিত রূপের অনুপস্থিতিঃ ব্রিটেনের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। এর ফলে সংসদীয় সার্বভৌমত্বের ধারণাটি আরও শক্তিশালী হয়েছে। ব্রিটিশ সংবিধান মূলত বিভিন্ন আইন, প্রচলিত রীতি ও ঐতিহ্য, এবং বিচারিক সিদ্ধান্তের সমন্বয়ে গঠিত, যা সংসদ প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারে।
৩. আইন প্রণয়নের সর্বময় ক্ষমতাঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সর্বময় আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি যে কোনো বিষয় সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করতে পারে, এমনকি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা আইন তৈরি করার ক্ষমতাও রয়েছে।
আরো পড়ুনঃ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
৪. আদালতের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বঃ ব্রিটেনে আদালত সংসদের প্রণীত আইনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে না। অন্যান্য দেশে সংবিধান আদালতের মাধ্যমে সংসদীয় সিদ্ধান্তকে খারিজ করতে পারে, কিন্তু ব্রিটেনে আদালতের এমন ক্ষমতা নেই।
৫. পরবর্তী সংসদের উপর কর্তৃত্বঃ একটি সংসদ তার পরবর্তী সংসদের সিদ্ধান্তকে বাঁধা দিতে পারে না। অর্থাৎ, প্রতিটি নতুন সংসদ পূর্ববর্তী সংসদের আইন সংশোধন বা বাতিল করতে সক্ষম। এটি সংসদীয় সার্বভৌমত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
৬. জনমতের পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীলতাঃ সংসদ সরাসরি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত, ফলে এটি জনমতের পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীল। যখন কোনো আইন জনপ্রিয়তা হারায়, তখন জনগণের প্রতিনিধি সংসদে নতুন আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে পারে।
৭. এককেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামোঃ ব্রিটেনে শক্তির মূল কেন্দ্র পার্লামেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য পৃথক নির্বাহী বা বিচার বিভাগের শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। ফলে, সংসদীয় সার্বভৌমত্ব আরও সুসংহত হয়েছে।
৮. বিচারিক পর্যালোচনার অভাবঃ যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের মতো বিচারিক পর্যালোচনার কোনো ব্যবস্থা ব্রিটেনে নেই। ফলে, সংসদের প্রণীত আইন চূড়ান্ত এবং এটি আদালত কর্তৃক বাতিল করা যায় না।
৯. আন্তর্জাতিক চুক্তির উপর সংসদের নিয়ন্ত্রণঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন বা বাতিল করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রেক্সিটের মাধ্যমে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত এই ক্ষমতারই একটি দৃষ্টান্ত।
আরো পড়ুনঃ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
১০. মানবাধিকার আইন এবং সংসদীয় ক্ষমতাঃ ব্রিটিশ সংসদ ১৯৯৮ সালে মানবাধিকার আইন পাশ করলেও, এটি সংসদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করেনি। সংসদ চাইলে এই আইন সংশোধন বা বাতিল করতে পারে, যা সংসদীয় সার্বভৌমত্বের শক্তিশালী অবস্থান নির্দেশ করে।
১১. উপনিবেশ এবং সংসদীয় সার্বভৌমত্বঃ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তার অধীনস্থ দেশগুলোর ওপর আইন প্রণয়ন করত এবং তাদের স্বাধীনতার পরও সংসদ অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত, যা পার্লামেন্টের ক্ষমতার বিস্তৃতির প্রমাণ।
১২. বিচারকদের সীমিত ক্ষমতাঃ বিচারকরা সংসদের আইন অনুসারে রায় দেন এবং কোনো আইন অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করতে পারেন না। ফলে, সংসদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
১৩. রাজতন্ত্র ও সংসদীয় সার্বভৌমত্বঃ ব্রিটেনে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থাকলেও, রাজার ক্ষমতা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক। রাজা বা রানী সংসদীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না, যা সংসদীয় সার্বভৌমত্বকে আরও জোরালো করে।
১৪. বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সংসদীয় সার্বভৌমত্বঃ স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন থাকলেও, ব্রিটিশ সংসদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই আইনগতভাবে কার্যকর। এমনকি স্কটিশ পার্লামেন্টেরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষমতা নেই।
১৫. সংসদীয় গণতন্ত্রের রূপান্তরঃ ব্রিটিশ সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, তবে এর সার্বভৌমত্বের মূল ধারণা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য থাকার সময়ও সংসদ সর্বময় ক্ষমতা ধরে রেখেছিল।
আরো পড়ুনঃ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
উপসংহারঃ ব্রিটিশ সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার অন্যতম মূল ভিত্তি হলো এর সার্বভৌমত্ব, যা দেশের আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংসদকে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রদান করে। আদালতের হস্তক্ষেপের অনুপস্থিতি, রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক ভূমিকায় সীমাবদ্ধতা, এবং সংবিধানের লিখিত রূপের অনুপস্থিতি সংসদীয় সার্বভৌমত্বকে আরও শক্তিশালী করেছে। যদিও আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সংস্থার কারণে কিছু সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, তারপরও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।