আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: আইনসভা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং নির্বাহী বিভাগের ওপর নজরদারির দায়িত্ব পালন করে। আদর্শভাবে, এটি নীতিনির্ধারণ ও শাসন ব্যবস্থার মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। তবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক কারণে আইনসভার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে।
আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ
১. নির্বাহী বিভাগের শক্তি বৃদ্ধিঃ অধিকাংশ দেশে নির্বাহী বিভাগ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনসভা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ অধ্যাদেশ জারি করে আইনসভার অনুমোদন ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২. বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপঃ কিছু দেশে বিচার বিভাগ আইনসভার সিদ্ধান্ত বাতিল বা সংশোধন করতে পারে। সংবিধানের ব্যাখ্যা ও সাংবিধানিক সংরক্ষণের নামে বিচার বিভাগ আইনসভার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলে আইনসভার স্বাধীনতা কমে যায়।
৩. দলীয় শৃঙ্খলার কঠোরতাঃ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকলে আইনসভার সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ বা ভোট প্রদান করতে পারে না। দলীয় নির্দেশ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হওয়ায় আইনসভার কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
৪. প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্যঃ আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ব্যাপক বিস্তার এবং তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আইনসভাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল করে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আমলাদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, ফলে আইনসভার ভূমিকা কমে যায়।
আরো পড়ুনঃ উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণীবিভাগ লিখ
৫. গণমাধ্যম ও জনমতের প্রভাবঃ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেক সময় জনগণের মতামতকে এতটাই প্রভাবিত করে যে আইনসভা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। গণমাধ্যমের চাপে পড়ে আইনসভাকে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়, যা তাদের ক্ষমতা সীমিত করে।
৬. স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও বিকেন্দ্রীকরণঃ অনেক দেশে বিভিন্ন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, কমিশন ও বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ইউনিট গঠনের ফলে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পায়। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় আইনসভার তুলনায় স্থানীয় সরকার বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা বাড়লে কেন্দ্রীয় আইনসভার ভূমিকা কমে যায়।
৭. দুর্নীতি ও অকার্যকারিতাঃ যদি আইনসভার সদস্যদের মধ্যে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাহলে জনগণের আস্থা কমে যায় এবং নির্বাহী বিভাগ আইনসভার ভূমিকা হ্রাস করার সুযোগ পায়।
৮. আন্তর্জাতিক সংস্থা ও চুক্তির প্রভাবঃ জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও চুক্তির কারণে অনেক দেশের আইনসভা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে তারা অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্য হয়ে বহিরাগত সংস্থার শর্ত মেনে চলে।
আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য
উপসংহারঃ আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস একটি বহুমুখী ও জটিল বিষয়। এটি নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য, বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক দলীয় নিয়ন্ত্রণ, আমলাতন্ত্রের প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির মতো বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে। তবে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইনসভার ক্ষমতা সংরক্ষণ ও শক্তিশালী করা অপরিহার্য।