কেবিনেটের একনায়কত্ব কি?
ভূমিকাঃ কেবিনেটের একনায়কত্ব (Cabinet Dictatorship) বলতে এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নির্বাহী বিভাগ, বিশেষ করে মন্ত্রিসভা (Cabinet), সরকারের ওপর চরম আধিপত্য বিস্তার করে এবং অন্যান্য শাখার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। সাধারণত সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিসভা সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে, কিন্তু কখনও কখনও এটি সংসদকে উপেক্ষা করে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শুরু করে। ফলে শাসনব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কেবিনেটের একনায়কত্বের বৈশিষ্ট্য ও কারণসমূহ
১. নির্বাহী বিভাগের অতিরিক্ত ক্ষমতাঃ কেবিনেটের একনায়কত্বে প্রধান নির্বাহী, যেমন প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভা, সরকারের সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সংসদ বা বিচারব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না, ফলে কেবিনেটই এককভাবে শাসন পরিচালনা করে।
২. সংসদীয় দুর্বলতাঃ যদি সংসদ দুর্বল ও দলীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়, তবে মন্ত্রিসভার কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। সংসদ যদি কেবিনেটের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তবে মন্ত্রিসভার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা পায় এবং সংসদের ভূমিকা নামমাত্র হয়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণীবিভাগ লিখ
৩. প্রধানমন্ত্রীর আধিপত্যঃ যেসব দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী, সেখানে কেবিনেটের একনায়কত্ব দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী একাই নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা ধরে রাখেন এবং মন্ত্রিসভা তার সিদ্ধান্ত মেনে চলে। এটি কার্যত একনায়কত্বের দিকে ধাবিত হয়।
৪. দলীয় শৃঙ্খলার কঠোরতাঃ যদি শাসক দল বা সরকারে থাকা রাজনৈতিক দল কঠোর দলীয় শৃঙ্খলার মধ্যে থাকে, তবে কেবিনেটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। এতে মন্ত্রিসভা ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেয় এবং গণতান্ত্রিক আলোচনা ও বিতর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাবঃ যদি বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে এবং সরকার বা কেবিনেটের চাপে চলে, তবে কেবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ, তখন মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার কোনো কার্যকর উপায় থাকে না।
৬. গণতান্ত্রিক চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের অনুপস্থিতিঃ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। কিন্তু যদি এই ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং কেবিনেটের হাতে অধিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়, তবে একনায়কত্বের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
৭. গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের দুর্বলতাঃ যদি স্বাধীন গণমাধ্যম এবং শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকে, তবে কেবিনেটের একনায়কত্ব আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কারণ, তখন সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান কার্যকর থাকে না।
৮. জরুরি অবস্থা বা বিশেষ পরিস্থিতির অপব্যবহারঃ কিছু ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা বা বিশেষ পরিস্থিতির অজুহাতে কেবিনেট স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত করে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটি একনায়কত্বের পথ প্রশস্ত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
আরো পড়ুনঃ সংসদীয় সরকার বলতে কী বুঝ
উপসংহারঃ কেবিনেটের একনায়কত্ব একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এটি আইনসভার দুর্বলতা, প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত ক্ষমতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব ও গণমাধ্যমের দুর্বলতার কারণে সৃষ্টি হতে পারে। একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে কেবিনেটের ক্ষমতা সীমিত করতে হবে এবং যথাযথ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।