বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে কী বুঝ?

বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে কী বুঝ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।

earn money

ভূমিকা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial Review) একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগ সরকারের আইন এবং কার্যক্রমের সাংবিধানিকতা পরীক্ষা করে এবং নিশ্চিত করে যে কোনো আইন বা কার্যক্রম সংবিধানের বিরুদ্ধে যায় না। এটি ক্ষমতার বিচ্ছিন্নকরণের একটি মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে, যা শাসনের একতরফা সিদ্ধান্তকে প্রতিরোধ করে। এই প্রক্রিয়া সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, এবং এর ফলে একে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতকারী একটি কার্যকর প্রক্রিয়া বলা হয়।

১. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার সংজ্ঞা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা হল আদালতের ক্ষমতা, বিশেষত সুপ্রিম কোর্টের, যাতে তারা কোনো আইন, নীতি, বা সরকারি কার্যক্রমের সাংবিধানিকতা পরীক্ষা করে দেখতে পারে। যদি কোনো আইন সংবিধান বিরুদ্ধ হয়, তবে তা অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। এটি মার্কিন শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ চাকমা ও গারো এথনিক গোষ্ঠীর জীবনধারা আলোচনা কর। 

২. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার সূচনা: মার্কিন ইতিহাসে ১৮০৩ সালে মারবেরি বনাম মাদিসন মামলার মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। চিফ জাস্টিস জন মারশাল এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা নিশ্চিত করেন এবং আদালতকে সংবিধান অনুসারে কার্যক্রমের পর্যালোচনা করার অধিকার প্রদান করেন, যা আইন প্রণয়ন এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


৩. সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণের ধারণা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে সংবিধানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, যা সকল আইন এবং কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে একটি মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে। সংবিধান হলো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, এবং বিচার বিভাগ সেই ভিত্তির উপর ভিত্তি করে সরকারের কার্যক্রমের ন্যায়িক পর্যালোচনা করে নিশ্চিত করে যে এটি সঠিক এবং সাংবিধানিক।

৪. ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে শক্তির বিচ্ছিন্নকরণের প্রক্রিয়া কার্যকরভাবে কাজ করে। নির্বাহী বা আইনসভা শাখা যদি সাংবিধানিক সীমা অতিক্রম করে, তবে বিচার বিভাগ তাদের সিদ্ধান্ত বা আইনকে বাতিল করতে পারে। এটি একতরফা ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে।

৫. সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের গুরুত্ব: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনায় সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সংবিধান নির্ধারিত ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে প্রভাবশালী সিদ্ধান্ত দেয় এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, কংগ্রেসের আইন এবং রাজ্য সরকারের কার্যক্রমের সাংবিধানিকতা যাচাই করে। সুপ্রিম কোর্টের রায় দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করে।

৬. সংবিধানের সমর্থন নিশ্চিত করা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সংবিধানকে শক্তিশালী এবং কার্যকর রাখে। এটি সুনির্দিষ্ট করে যে কোনো আইন বা কার্যক্রম সংবিধানের মধ্যে না থাকলে তা বৈধ হতে পারে না। সংবিধান পরিপালন এবং সংবিধানিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের  ভূমিকা পর্যালোচনা কর।

৭. মানবাধিকার সুরক্ষা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষা করা হয়। যদি কোনো আইন মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে বিচার বিভাগ তা বাতিল করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্লেসি বনাম ফার্গুসন মামলায় বিচার বিভাগের মাধ্যমে জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটি বিচার ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক ভূমিকা নিশ্চিত করে।

৮. কার্যকর গণতন্ত্রের ভিত্তি: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শাসন নিশ্চিত করা হয়, যেখানে আইন এবং নীতি নাগরিকদের অধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করে। এটি সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখে। বিচার বিভাগী পর্যালোচনা, তাই, গণতন্ত্রের প্রয়োগযোগ্যতা রক্ষা করতে সহায়ক।

৯. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ধারণাটি নিশ্চিত করে যে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং এটি আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এটি বিচারকদের স্বাধীনতা রক্ষা করে, যাতে তারা সরকারি চাপের আওতায় না পড়ে এবং স্বাধীনভাবে আইন প্রয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

১০. কংগ্রেস ও রাষ্ট্রপতির পর্যালোচনার ক্ষেত্র: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে কংগ্রেস এবং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের সাংবিধানিকতা নিরীক্ষণ করা হয়। যখন কংগ্রেস বা রাষ্ট্রপতি এমন কোনো আইন বা সিদ্ধান্ত নেন যা সংবিধান বিরুদ্ধ, তখন সুপ্রিম কোর্ট সেই আইন বাতিল করতে পারে। এতে শক্তির অপব্যবহার প্রতিরোধ করা হয় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা পায়।

১১. রাজ্যশক্তি এবং ফেডারেল শাসন: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ফেডারেল শাসনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। এটি রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে এবং নিশ্চিত করে যে তারা সংবিধান বা কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশের বাইরে না যায়। ফেডারেল সিস্টেমের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এটি রাজ্যদের স্বাধীনতা এবং কেন্দ্রের ক্ষমতাকে সুসংহত করে।

১২. সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সংবিধান সংশোধনের একটি শক্তিশালী উপায় হিসেবে কাজ করে। যখন সমাজে পরিবর্তন আসে, বিচার বিভাগ নতুন অবস্থার সঙ্গে সংবিধানের সঙ্গতি যাচাই করে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব করতে পারে। এতে সংবিধানকে আধুনিক সমস্যার জন্য উপযোগী করা হয় এবং দেশের সমৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

১৩. রাজনীতির প্রভাবিত হওয়ার থেকে মুক্তি: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে যে বিচারকরা রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা চাকরির মেয়াদ শেষে নির্দিষ্ট বেতনসহ কর্মরত থাকেন, যা তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে সহায়ক। এটি আইন এবং ন্যায়ের প্রতি অবিচলতা বজায় রাখে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য দিক।

১৪. অপ্রকাশিত অধিকার রক্ষা: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সংবিধানের অপ্রকাশিত অধিকারগুলো রক্ষা করে। অনেকে মনে করেন যে কিছু অধিকার লিখিত না থাকলেও জনগণের মৌলিক অধিকারের অংশ, যেমন গোপনীয়তা বা বিবাহের অধিকার। বিচার বিভাগ এগুলোকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে মান্যতা প্রদান করে, যা জনগণের জীবনযাত্রাকে সুরক্ষা দেয়।

১৫. বিচার বিভাগের কর্তৃত্বের প্রতিফলন: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বিচার বিভাগের ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতিফলন। এটি আইন প্রণয়ন, কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সাংবিধানিকতা রক্ষা করে এবং দেশের ন্যায় ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। এর মাধ্যমে শক্তির কেন্দ্রীকরণ রোধ হয়, এবং গণতান্ত্রিক অবকাঠামো সুসংহত হয়।

১৬. আইনশৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি: বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা আইনশৃঙ্খলা এবং ন্যায়বিচার রক্ষা করার মূল উপায়। এটি আইন লঙ্ঘনকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়, যাতে সবাই আইনের সামনে সমান হতে পারে। এটি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে।

আরো পড়ুনঃ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ

উপসংহার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ক্ষমতার বিচ্ছিন্নকরণ এবং ভারসাম্য রক্ষা করে, যা সরকারি কর্মকাণ্ডের বৈধতা পরীক্ষা করে এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষা নিশ্চিত করে। বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা নিশ্চিত করে যে সরকারি সিদ্ধান্ত সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক