যুক্তরাজ্যের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বিকাশে বিভারিজ রিপোর্টের অবদান

যুক্তরাজ্যের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বিকাশে বিভারিজ রিপোর্টের অবদান ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকাঃ বিভারিজ রিপোর্ট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রণয়নসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত বিভারিজ রিপোর্ট যুক্তরাজ্যের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনে একটি ঐতিহাসিক দলিল। স্যার উইলিয়াম বিভারিজ প্রণীত এই রিপোর্ট মানব সমাজের অগ্রগতির পথে পাঁচটি প্রধান অন্তরায় চিহ্নিত করে এবং এর সমাধানে সুপারিশ প্রদান করে। এই রিপোর্টের প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে এটি শুধু যুক্তরাজ্য নয়, বিশ্বব্যাপী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিকাশেও প্রভাব ফেলে। যুক্তরাজ্যের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিভারিজ রিপোর্টের অবদান নিম্নরূপ:

১. সামাজিক নিরাপত্তার ধারণা প্রতিষ্ঠাঃ বিভারিজ রিপোর্টের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো “সামাজিক নিরাপত্তা” ধারণাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এটি সব নাগরিকের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত, সমন্বিত এবং সর্বজনীন নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষে মতামত ব্যক্ত করে।  এটি সমাজের প্রতিটি মানুষকে রাষ্ট্রের অধীনে অর্থনৈতিক সুরক্ষা দেওয়ার পক্ষে জোরালো ভুমিকা পালন করে। 

২. অগ্রগতির পথে পাঁচটি অন্তরায় চিহ্নিতকরণঃ বিভারিজ রিপোর্টে মানব সমাজের অগ্রগতিতে বাধা প্রদান করে এরকম পাঁচটি প্রধান বাধা উল্লেখ করে সেগুলো হল অভাব, রোগ, অজ্ঞতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অলসতা। এই অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যাগুলোর সুনির্দিষ্ট সমাধান খুঁজে বের করা সহজ হয়।

৩. সামাজিক বিমা কর্মসূচি প্রবর্তনঃ রিপোর্টে সামাজিক বিমা কর্মসূচি চালু করার  প্রতি সুপারিশ করা হয়। এটি জনগণের বেকারত্ব, অসুস্থতা এবং বার্ধক্যের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এবং আয়হীনতার ঝুঁকি কমায়। এটি যুক্তরাজ্যের পরবর্তী কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি স্থাপন করে। 

৪. জাতীয় ভিত্তিক সরকারি সহায়তা কর্মসূচিঃ সামাজিক বিমার আওতায় না থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় পর্যায়ে সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব বিভারিজ রিপোর্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর মাধ্যমে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশটিও আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করে।

৫. শিশু ভাতার প্রবর্তনঃ প্রথম সন্তানের পরবর্তী প্রতিটি সন্তানের জন্য সাপ্তাহিক শিশু ভাতার প্রস্তাব সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এটি শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং অভিভাবকদের আর্থিক চাপ কমায়।

৬. বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবাঃ রিপোর্টে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন কর্মসূচি চালুর প্রস্তাব করা হয়, যা যুক্তরাজ্যে পরবর্তীতে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে। এই সুপারিশের ফলে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়।

৭. বেকারত্ব রোধে কর্মসংস্থান সৃষ্টিঃ এই রিপোর্টে  অর্থনৈতিক সংকটের সময় বেকারত্ব কমানোর জন্য সরকারিভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এর ফলে নাগরিকদের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়।

৮. একীভূত প্রশাসনের সুপারিশঃ রিপোর্টে সমাজের প্রতিটি স্তরে একীভূত প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এর ফলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব।

৯. সমহারে চাঁদা ও সুবিধা প্রদানঃ রিপোর্টের নীতিমালা অনুযায়ী, সব নাগরিকের জন্য সমহারে চাঁদা প্রদান ও সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এটি সামাজিক অসমতা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১০. গবেষণা ও নীতিনির্ধারণের ভিত্তিঃ বিভারিজ রিপোর্ট যুক্তরাজ্যের জন্য একটি গবেষণা ও নীতিনির্ধারণের কাঠামো তৈরি করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি স্তরে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ সম্ভব হয়।

১১. ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স অ্যাক্ট (1946) প্রণয়নঃ রিপোর্টের সুপারিশমালার ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যে ১৯৪৬ সালে ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স অ্যাক্ট প্রণীত হয় যার মাধ্যমে নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক বিমা ব্যবস্থা চালু হয়।

১২. ন্যাশনাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্ট (1948)প্রণয়নঃ বিভারিজ রিপোর্টের প্রভাবে ১৯৪৮ সালে ন্যাশনাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্ট কার্যকর হয়। এটি নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর জন্য অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করে।

১৩. সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠাঃ বিভারিজ রিপোর্টের মাধ্যমে সমাজের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণে সমতার ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। এটি সামাজিক অসমতা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৪. শ্রমিক শ্রেণির উন্নয়নঃ শ্রমিক শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। শ্রমিকরা সুনির্দিষ্ট সুবিধা লাভের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করে।

১৫. মানবিক উন্নয়নের পথপ্রদর্শকঃ  এই রিপোর্ট আর্থিক নিরাপত্তার সাথে সাথে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে মানবিক উন্নয়নে অবদান রাখে।

১৬. অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণের গুরুত্বঃ বিভারিজ রিপোর্ট অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গড়ে তোলার পথ প্রদর্শন করে। এটি আধুনিক নীতিনির্ধারণের জন্য এক অনন্য উদাহরণ হয়ে ওঠে।

১৭. বিশ্বব্যাপী প্রভাবঃ বিভারিজ রিপোর্ট কেবলমাত্র যুক্তরাজ্য নয বরং বর্তমান বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রভাব বিস্তার করে। এই রিপোর্টটি  বিশ্বের অন্যান্য দেশ সমূহে  কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। 

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, বিভারিজ রিপোর্ট শুধু ইংল্যান্ড নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি বিশ্বব্যাপী সামাজিক কল্যাণের ধারণা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এর সুপারিশ ও নীতিমালা আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে সমতা ও স্থিতিশীলতা আনতে বিশেষ করে দারিদ্র্য, রোগ এবং বেকারত্ব দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। 

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *