সংবিধানের সংজ্ঞা দাও। উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

প্রশ্নঃ সংবিধানের সংজ্ঞা দাও। উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

earn money

ভুমিকাঃ সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক আইন ও পবিত্র দলিল। সংবিধানের মাধ্যমেই রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অঙ্গ হচেছ সরকার। সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে থাকে। সংবিধানের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। তাই সংবিধানকে রাষ্ট্রের দর্পণ বলা হয়।

সংবিধানের প্রামাণ্য সংজ্ঞা: সংবিধান হচ্ছে জাতির পবিত্রতম দলিল। সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক আইন। সংবিধান সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে থাকে। এটা সরকারের বিভিন্ন-বিভাগ, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সংবিধানের সংজ্ঞা দিয়েছেন। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটলের মতে- “কোন রাষ্ট্র নিজেকে পরিচালনার জন্য যে পথ বেছে নেয় তাই সংবিধান।”

অধ্যাপক ফাইনার বলেন, “’রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে পরস্পরের সমন্ধ হলো সংবিধান।” 

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


সি.এফ.ষ্ট্রং সংবিধানের সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন, তিনি বলেন, “সংবিধান হচ্ছে সেই সকল নিয়মের

সমষ্টি যা সরকারের ক্ষমতা, শাসিতের অধিকার এবং এ দু’য়ের সম্পর্ক নির্ধারণ করে।” 

আরো পড়ুনঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তম সংবিধানের সংজ্ঞাঃ যে সংবিধান অনুসারে নাগরিকের অধিকার যথাযথ ভাবে সংরক্ষিত রাখে এবং নাগরিকগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তাকেই উত্তম সংবিধান বলে। একটি উত্তম সংবিধান হল এমন একটি সংবিধান যা একটি রাষ্ট্রের জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এটি একটি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি মৌলিক কাঠামো প্রদান করে।

K.C.Wheare বলেছেন, “উত্তম সংবিধানের জন্য গণতন্ত্রই হলাে উত্তম ক্ষেত্র।”

উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা করা হলাে-

১. সুস্পষ্টতাঃ শাসনতন্ত্রের নীতি ও ধারাসমূহ সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট এবং সুনিশ্চিত হওয়া আবশ্যক যাতে তার অর্থ সম্পর্কে দ্বিমত দেখা না দেয়। সুতরাং, সে শাসনতন্ত্রই উত্তম বলে বিবেচিত হবে যা দ্ব্যর্থ পূর্ণ ভাষা ও শব্দ পরিহার করে প্রাঞ্জল এবং অর্থপূর্ণ ভাষায় রচিত।

২. সংক্ষিপ্ততাঃ সংবিধানের বিভিন্ন ধারা ও উপধারা সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় যাতে তার মধ্যে অযথা অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গের অনুপ্রবেশ না ঘটে। তবে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের গঠন এবং কিভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যবস্থার উল্লেখ থাকতে হবে।

৩. মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্তিঃ সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ অন্তর্ভূক্তি থাকা আবশ্যক। শাসন বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে চাইলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে শাসনতন্ত্র ভঙ্গের অভিযোগ আনয়ন করতে পারে। ফলে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রুদ্ধ হয়, জনগণের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে।

৪. সময়োপযোগিতাঃ উত্তম সংবিধানকে অবশ্যই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। শাসনতন্ত্রকে অবশ্যই জনগণের এ পরিবর্তিত চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হবে। অন্যথায়, শাসনতান্ত্রিক বিধিবিধান ও উদ্দেশ্যের সাথে জনগণের ইচ্ছার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখা দিবে।

৫. সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাঃ এটা উত্তম সংবিধানের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। ‍উত্তম সংবিধানে রাষ্ট্রের আইনগত সার্বভৌমত্ব ও সরকার এবং রাজণৈতিক সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ, জনগণের মধ্যে ভারসাম্য থাকা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায়, বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের ভয় থেকে যায়।

৬. গণতন্ত্রঃ উত্তম সংবিধানের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলাে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র না থাকলে উত্তম সংবিধান নিশ্চিত করা যায় না। K.C.Wheare বলেছেন, “উত্তম সংবিধানের জন্য গণতন্ত্রই হলাে উত্তম ক্ষেত্র।”

৭. সহজ সংশোধন পদ্ধতিঃ উত্তম সংবিধানকে অবশ্যই একটি সহজ সংশোধন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। তবে এমন সহজসাধ্য হওয়া উচিত নয়, যাতে অহেতুক পরিবর্তনের সুযোগ থাকে।

আরো পড়ুনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর।

৮. লিখিত রূপঃ উত্তম সংবিধান লিখিত হবে বলেই প্রত্যাশা করা হয়। শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা, নাগরিকদের অধিকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেশগুলোর অধিকার রক্ষার জন্য লিখিত সংবিধানই কামনা করা হয়।

৯. জনমতের অগ্রাধিকারঃ উত্তম সংবিধান জনমতের প্রতিফলন ঘটায়। উত্তম সংবিধান হবে জনমতের ধারক ও বাহক। জনমতের প্রতি লক্ষ্য রেখেই সংবিধান পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে যুগোপযোগী হবে।

১০. বিচার বিভাগের প্রাধান্যঃ সংবিধানের প্রাধান্য সুনিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বিচার বিভাগের হাতে সংবিধানকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। বিচার বিভাগ হবে সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক।

১১. উত্তম সংশােধন পদ্ধতিঃ সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন যাতে রাজনৈতিক দলগুলাের খেয়ালের বিষয়ে পরিণত হয় সেটিকে নিশ্চিত করা উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য। উত্তম সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হবে না, আবার দুষ্পরিবর্তনীয়ও হবে না। এ দু’য়ের মধ্যবর্তী পন্থাই হবে এর কাম্য। এমতাবস্থায় এরূপ সংবিধান কেবল দেশের প্রয়ােজনীয় মুহূর্তেই সংশােধিত হবে।

১২. ভারসাম্য রক্ষাঃ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের ভারসাম্য রক্ষাও উত্তম সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সরকারের সকল বিভাগের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান থাকা জরুরি। আবার জনগণের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

১৩. জনমতের অগ্রাধিকারঃ উত্তম সংবিধানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কেননা এরূপ সংবিধান সকল দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত একটি গণপরিষদ বা কর্তৃত্বসম্পন্ন কোন সংস্থা কর্তৃক রচিত হয়। ফলে, এরূপ সংবিধান জনমতের ধারক ও বাহক হয়। জনমতের প্রতি লক্ষ্য রেখেই সময়ে সময়ে সংবিধান পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে যুগােপযােগী হবে।

১৪. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থাঃ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। উত্তম সংবিধানই এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। অর্থাৎ সংবিধান এমনভাবে প্রণীত হবে যাতে বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের স্বৈরাচার থেকে ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করতে পারে এবং সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে। তাই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি উত্তম সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৫. আইনের অনুশাসনঃ উত্তম সংবিধানে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য ও আইনসমূহের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিতকরণ করা উত্তম সংবিধানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য।

আরো পড়ুনঃ প্রথা বলতে কী বোঝো? বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা কেন মান্য করা হয়?

১৬. সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাঃ উত্তম সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতা সংগতিপূর্ণ উপায়ে বণ্টন করা হয়। অর্থাৎ উত্তম সংবিধানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা। আইনসভার সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বণ্টন ক্ষেত্রে উত্তম সংবিধান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সরকার ও জনগণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যাবশ্যক নতুবা গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের ভয় থেকে যায়।

উপসংহারঃ একটি উত্তম সংবিধান হল এমন একটি সংবিধান যা একটি রাষ্ট্রের জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এটি একটি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি মৌলিক কাঠামো প্রদান করে। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি নিশ্চিত করে এবং ন্যায়বিচার ও ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখে।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক