১৮৭৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দা কী?
ভূমিকাঃ ১৮৭৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দা, যা “Panic of 1873” নামে পরিচিত, শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী বিশ্বের প্রথম উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত। এটি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি করে, যা “লং ডিপ্রেশন” নামে পরিচিত। এই সংকটের কারণ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করলে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়।
মন্দার কারণসমূহ:
১. অতিরিক্ত উন্নয়ন প্রকল্পঃ ১৮৭০-এর দশকে রেলপথ নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়, যা অর্থনীতির একটি বড় অংশ দখল করেছিল। তবে, এই বিনিয়োগের বেশিরভাগ ছিল অপরিকল্পিত এবং লাভজনক ছিল না। রেলপথ নির্মাণের জন্য নেওয়া ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং তা পরিশোধে অক্ষমতা তৈরি হয়।
২. ব্যাংকিং খাতের সংকটঃ ব্যাপক ঋণ বিতরণের পর, ব্যাংকগুলো যখন ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়, তখন বড় ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Jay Cooke & Company এর দেউলিয়া হওয়া সংকটের সূচনা ঘটায়। ব্যাংকিং খাতের এই অস্থিতিশীলতা দ্রুতই অন্যান্য খাতে ছড়িয়ে পড়ে।
৩. শিল্পখাতের অপ্রস্তুতিঃ শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হয়, কিন্তু অর্থনীতির সংকোচন এবং ক্রয়ের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় এই খাতেও মন্দা দেখা দেয়।
৪. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রভাবঃ ইউরোপীয় দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। ব্রিটেন, জার্মানি, ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে শিল্প উৎপাদন এবং রপ্তানিতে স্থবিরতা আসে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তোলে।
মন্দার পরিণতিঃ
১. বেকারত্ব বৃদ্ধিঃ মন্দার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। শিল্প, কৃষি এবং নির্মাণ খাতে কাজের সুযোগ দ্রুত কমে যায়।
২. ব্যবসা-বাণিজ্যের পতনঃ হাজার হাজার কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয় এবং বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন হ্রাস পায়।
৩. রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাঃ বেকারত্ব এবং আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘটের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
৪. আর্থিক ব্যবস্থার পরিবর্তনঃ এই মন্দার পরবর্তী সময়ে আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভূমিকা আরও দৃঢ় হয়।
১৮৭৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দা আধুনিক অর্থনীতির জন্য মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করেছে। এটি দেখিয়েছে যে,
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য পরিকল্পিত বিনিয়োগ অপরিহার্য।
- ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি।
উপসংহারঃ ১৮৭৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দা শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক সংকট ছিল না; এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটও সৃষ্টি করেছিল। এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হলেও, এটি আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেগুলো উন্নত করার সুযোগ তৈরি করেছিল। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও বাজার নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বোঝার জন্য এই মন্দা একটি শক্তিশালী উদাহরণ।
