প্রশ্নঃ ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থার একটি তুলনামূলক আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ একাবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব নেতৃত্বের দুটি অন্যতম প্রধান অংশের নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। উভয় দেশ দুটি তাদের শত বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে রাজনীতির চর্চা করে। তাদের সংবিধানে দলীয় ব্যবস্থা নিয়ে কোন নীতির উল্লেখ না থাকলেও ক্ষমতা গ্রহণ এবং তা পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশগুদুটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই ভূমিকা রাখে। আজকের এই লেখায় আমি যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে দলীয় ব্যবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র আঁকবো।
ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও এর মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য রয়েছে। আমরা প্রথমেই সাদৃশ্য সমূহ আলোচনা করব।
সাংবিধানিক স্বীকৃতি বিহীন: ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের কোথাও দলীয় ব্যবস্থার উল্লেখ নেই। তবুও এখানে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বিপ্লবের ফলে অথবা জনকল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মালিক শ্রেণির অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে। ঠিক তেমনি বিভিন্ন সময়ে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং প্রয়োজনেই গ্রেট ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে I
আরো পড়ুনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর।
গঠনগত সাদৃশ্য: দুই দেশেরই দলীয় ব্যাবস্থার মধ্যে গঠনগত দিকের মিল রয়েছে। এখানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মিশরের পিরামিডের গঠন পক্রিয়া অনুসারে সংগঠিত হয়েছে। তাদের জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠন ও নেতৃত্ব বিদ্যমান। নির্বাচনি রাজনীতির প্রতিযোগিতা থাকায় সকল পর্যায়ের সংগঠনের প্রভাবও উভয় দেশেই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ভিত্তিগত সাদৃশ্য: দুই দেশেই উদারনৈতিক চিন্তার উপরে দলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বেই ব্রিটেনে উদারনৈতিক চিন্তা ও কাঠামোর বিকাশ ঘটেছে। আর এই পথ ধরেই হেঁটেছে আমেরিকান দলীয় ব্যবস্থা। উভয় দেশের দলীয় ব্যবস্থা দীর্ঘ বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। উভয় দেশই উদারনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শে নিজেদের সুসংগঠিত করেছে।
দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা: এক দিক থেকে এই দুই দেশেই বহু দলীয় গণতন্ত্র চলমান রয়েছে। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে ব্রিটেনে রক্ষণশীল ও শ্রমিক দল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এখানে আরও রাজনৈতিক দোল থাকলেও তা মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে না। যার ফলে মার্কিন দলীয় ব্যবস্থাকে কার্যকরী দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা নামে চিহ্নিত করা হয়। আবার ব্রিটেনেও নির্বাচনি রাজনীতির লড়াই কেবলমাত্র রক্ষণশীল ও শ্রমিক দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে ।
রাজনৈতিক দীক্ষা প্রদান: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থা রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে নানামুখী অবদান রাখে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নাগরিকদের নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শে দীক্ষিতকরণের বিভিন্ন কার্যকরী পদ্ধতি প্রণয়ন করে। রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে উভয় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকদের মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলে। উভয় দেশের রাজনৈতিক দলই প্রচলিত সমাজ কাঠামোর সংরক্ষণ ও সংস্করণে ব্যাপক অবদান রাখে।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন উভয় দেশে দল ব্যবস্থাই জনগণকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। শুধুমাত্র নির্বাচনের সময়েই রাজনৈতিক দল তাদেরকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে না; বরং অন্যান্য সময়েও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকে অনুপ্রাণিত করে। যে দল তার বিপরীত দলের তুলনায় বেশি সংখ্যক নাগরিকের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত করতে পারে, সেই দলই জনমানুষের মনমন্দিরে আসন লাভ করে।
আরো পড়ুনঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কী বোঝো? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় সমূহ আলোচনা কর।
সরকার গঠন: দুই দেশেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের মাদ্ধমে ক্ষমতা দখল করে। নির্বাচনে জয় লাভ করতে তারা জনগণকে সময়উপযোগী বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। যে দল বেশি জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে পারে বা জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে তারাই সরকার গঠন করে। তবে কোনো দেশেই দলগুলো অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের পক্ষপাতি নয়।
বৈসাদৃশ্যসমূহ:
আদর্শগত অমিল: ব্রিটেনের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় রক্ষণশীল দল ও শ্রমিক দলের মধ্যে আদর্শ ও নীতিগত ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রক্ষান্তরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে আদর্শ ও নীতিগত ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা দেখা যায় না। ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্ভব এবং তাদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পেছনে আদর্শ ও নীতিগত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল দুটির উদ্ভবের কারণ এবং তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আদর্শগত নয়, কেবল তা ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে।
কাঠামোগত ভিন্নতা: ব্রিটেন ও আমেরিকায় দলগুলোর গঠন কাঠামোর ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়।ব্রিটেনের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এখানে দলীয় কাঠামোও এককেন্দ্রিক। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দু’টি দলের প্রকৃত ক্ষমতা এক কেন্দ্রিক নয়। তৃণমূল পর্যায়ে তারা বিক্ষিপ্ত ভাবে অবস্থান করে। মার্কিন ব্যবস্থায় প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল তাদের আঞ্চলিক সমস্যা ও স্বার্থের ব্যাপারে বিশেষভাবে নজর দেয় । আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় দল দু’টি জাতীয় দল হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও কংগ্রেসের নির্বাচনের সময় আঞ্চলিক স্বার্থের বিচারে নির্বাচনী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে।
উদ্দেশ্যগত পার্থক্য: সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও নীতির ভিত্তিতে ব্রিটেনের প্রধান দু’টি দল নির্বাচনে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে। সরকারি ক্ষমতা দখল করতে পারলে দল দু’টি তাদের নিজস্ব দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকে। অপরদিকে, মার্কিন দল দু’টির মধ্যে কর্মসূচি ও নীতিগত তেমন কোনো পার্থক্য না থাকার কারণে তারা কেবল ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে।
দলীয় শৃঙ্খলা: ব্রিটেনের প্রধান রাজনৈতিক দল দু’টির মধ্যে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও সংহতি দেখা যায়। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি দলের দল দু’টির মধ্যে এরূপ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না। এখানে কংগ্রেসের সদস্যগণ স্বাধীনভাবে তাদের মতামত ব্যাক্ত করতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
ভিন্নমুখী ভূমিকা: ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় দলীয় ব্যবস্থার ভূমিকার ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি দলীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু মার্কিন শাসনব্যবস্থায় এর উল্টো তা ঘটে। যে কারণে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দল দুটির ভূমিকা এবং মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দল দু’টির ভূমিকা পৃথক প্রকৃতির। সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত থাকায় ব্রিটেনে সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক লক্ষণীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কোনো বিশেষ দলের দ্বারা গঠিত বা পরিচালিত হয় না।
উপসংহারঃ উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, উভয় দেশেই রাজনৈতিক দলগুলো শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে দলীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণের দিক দিয়ে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষণীয়। ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দলগুলোর তুলনায় অনেক বেশী সংগঠিত ও সুশৃংখল।