গণতন্ত্রে জনমতের গুরুত্ব আলোচনা কর।
ভূমিকা: গণতন্ত্র (Democracy) হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃত উৎস। জনগণের মতামতই এই শাসনব্যবস্থার ভিত্তি, যা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশ পায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখে। জনমত গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে, কারণ এটি সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে, নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখে এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
জনমতের সংজ্ঞা
জনমত বলতে সাধারণ জনগণের সম্মিলিত মতামতকে বোঝায়, যা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। জনমত গঠনের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম যেমন নির্বাচন, গণভোট, জনমত জরিপ, সামাজিক আন্দোলন এবং গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জনমতের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন—
এলসি রস বলেছেন, “যে মতামত কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রকাশ করে এবং যা রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রভাব ফেলে, সেটাই জনমত।”
গার্নার বলেছেন, “জনমত হলো জনগণের সম্মিলিত মতামত, যা সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।“
আরো পড়ুনঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম
এল টেনবি বলেন, “জনমত কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতই নয়, বরং এটি সচেতন নাগরিকদের যৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন।”
গণতন্ত্রে জনমতের গুরুত্ব
গণতন্ত্রে জনমতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে—
১. সরকার গঠনে জনমত: গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন করা হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং জনমতের প্রতিফলন ঘটে। যদি জনগণ সরকারের কার্যক্রমে অসন্তুষ্ট হয়, তবে পরবর্তী নির্বাচনে তারা সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে।
২. নীতি নির্ধারণে জনমত: জনমত সরকারকে নীতিনির্ধারণে সহায়তা করে। জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সরকারকে জনমতের প্রতি সংবেদনশীল থাকতে হয়। যদি কোনো নীতি জনগণের স্বার্থবিরোধী হয়, তবে জনসাধারণ গণমাধ্যম, সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিবাদের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করে, যা সরকারকে সেই নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করে।
৩. সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ: গণতন্ত্রে সরকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ। জনমতের চাপের কারণে সরকার স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়। জনগণ যদি মনে করে সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত বা স্বেচ্ছাচারী, তবে তারা গণআন্দোলন, গণমাধ্যমের সমালোচনা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
আরো পড়ুনঃ ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়
৪. আইন প্রণয়ন ও সংস্কারে জনমত: একটি গণতান্ত্রিক দেশে আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে জনমতের গুরুত্ব অপরিসীম। জনমতের ভিত্তিতে সংসদ সদস্যরা নতুন আইন প্রণয়ন করেন এবং বিদ্যমান আইন সংশোধন করেন। উদাহরণস্বরূপ, শ্রম আইন, মানবাধিকার সংক্রান্ত আইন, নারীর ক্ষমতায়ন আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনমতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
৫. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় জনমত: গণতন্ত্রে জনগণের মতামত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হলে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ন্যায়বিচারবিরোধী রায় বা সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা যায়।
৬. সংবাদমাধ্যম ও জনমত: সংবাদমাধ্যম জনমত গঠনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এটি জনগণের মতামত প্রকাশের একটি মাধ্যম, যা সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করতে সাহায্য করে। একটি স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে জনগণ তাদের মতামত অবাধে প্রকাশ করতে পারে এবং সরকারও জনগণের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
উপসংহার: গণতন্ত্রে জনমত জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। এটি সরকারের নীতিনির্ধারণ, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনমত যদি সঠিকভাবে গঠিত হয় এবং সরকার যদি জনগণের মতামত যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে, তবে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তবে এজন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা, নিরপেক্ষ গণমাধ্যম এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ।