সংসদীয় সরকার বলতে কী বুঝ?
ভূমিকা: সংসদীয় সরকার (Parliamentary Government) হলো একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যেখানে নির্বাহী (Executive) বিভাগ সংসদের (Legislature) প্রতি দায়বদ্ধ থাকে এবং সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন নিয়ে সরকার পরিচালিত হয়। এটি আধুনিক বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা, যা জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন দেশ, যেমন যুক্তরাজ্য, ভারত, বাংলাদেশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা অনুসরণ করে। এ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত শাসক হিসেবে কাজ করেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান (যেমন রাষ্ট্রপতি বা রাজার) ভূমিকা আনুষ্ঠানিক থাকে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
সংসদীয় সরকারের প্রকৃত অর্থ বোঝার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একাধিক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
প্রফেসর গার্নার বলেন, “সংসদীয় সরকার হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে প্রকৃত শাসকগোষ্ঠী (মন্ত্রিসভা) সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ এবং সংসদের আস্থা হারালে তাদের পদত্যাগ করতে হয়।“
এ.ভি. ডাইসি বলেন, “সংসদীয় সরকার এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে নির্বাহী বিভাগ ও আইন প্রণয়নকারী সংসদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে এবং নির্বাহী সংসদের অনুমোদনসাপেক্ষে কাজ করে।“
হারম্যান ফাইনার বলেন, “সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় এবং তারা সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে।“
মন্টেস্কিউ বলেন, “সংসদীয় সরকারব্যবস্থা জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা ও আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।“
আরো পড়ুনঃ আধুনিক রাষ্ট্রে শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণগুলো
সংসদীয় সরকারের বৈশিষ্ট্য: সংসদীয় সরকারব্যবস্থাকে চিহ্নিত করার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য—
১. নির্বাহী ও আইন বিভাগের সংহতি: সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। মন্ত্রিসভা সংসদ থেকে গঠিত হয় এবং সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে।
২. দ্বৈত নির্বাহী (Dual Executive): এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপ্রধান (যেমন রাষ্ট্রপতি বা রাজা) নামমাত্র নির্বাহী, আর প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
৩. মন্ত্রিসভার যৌথ ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা: মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে যৌথভাবে দায়বদ্ধ থাকে এবং মন্ত্রীরা নিজেদের অধীনস্থ বিভাগগুলোর কার্যক্রমের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকেন।
৪. সংসদীয় ক্ষমতা: সংসদ সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর সরাসরি নজরদারি করে এবং অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।
৫. দলীয় শাসন: সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ সরকার গঠনের জন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা আবশ্যক।
৬. সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা: সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপ্রধান সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিতে পারেন।
৭. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: সরকারের নীতিগুলো সংসদে আলোচনা হয় এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, ফলে এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখে।
আরো পড়ুনঃ ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়
উদাহরণ: ব্রিটেন, ভারত, বাংলাদেশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশ সংসদীয় সরকারব্যবস্থা অনুসরণ করে।
উপসংহার: সংসদীয় সরকারব্যবস্থা একটি সুসংহত ও কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যা জনগণের সরাসরি প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের ওপর আইনসভা কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, ফলে সরকার স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ হয়। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অতিরিক্ত দলীয় রাজনীতির কারণে মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তবুও, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য এটি বিশ্বের অনেক দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত শাসনব্যবস্থা।