“অপারেশন সার্চলাইট” কী?
ভূমিকা: “অপারেশন সার্চলাইট” ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত একটি সশস্ত্র অভিযান ছিল, যা মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হয়। এই অভিযানটি ছিল পরিকল্পিত গণহত্যার একটি অংশ, যার মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের স্বাধীনতার আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল। অভিযানের সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য: অপারেশন সার্চলাইটের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী নেতাদের ধ্বংস করা। এর মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার চাইছিল আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমন করতে।
নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা: পাকিস্তানের মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এই অভিযানের নির্দেশনা দেন। ১৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে তারা এই অভিযানের পরিকল্পনা শুরু করেন এবং এর নাম দেওয়া হয় “অপারেশন সার্চলাইট”। মূল পরিকল্পনা ছিল সামরিক শক্তি দিয়ে বাঙালিদের দমন করা।
নিরস্ত্রীকরণ: পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালি সেনা ও পুলিশদের নিরস্ত্র করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়। পিলখানা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), রাজারবাগ পুলিশ লাইন, এবং চট্টগ্রামের অস্ত্রাগারে থাকা ২০ হাজারেরও বেশি রাইফেল দখল করা হয়েছিল, যাতে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে।
গণহত্যা: অপারেশন সার্চলাইটের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, এবং পিলখানায় হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং অধ্যাপকদের হত্যা করে তাদের আন্দোলন এবং চিন্তাশক্তিকে দমন করার চেষ্টা করা হয়। একইভাবে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনেও বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার: অপারেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা। শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেপ্তার করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, যাতে তিনি আরও কোনো প্রকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে না পারেন। তার সাথে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৫ জন শীর্ষ নেতাকেও গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করা হয়।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা: অভিযানের শুরুতেই দেশের সমস্ত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, যাতে কোন বাহ্যিক সাহায্য বা সমর্থন সংগ্রহ করা না যায়। রেডিও, টেলিভিশন, এবং টেলিফোন সেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে বাঙালি জনগণের মধ্যে কোনো সমন্বয় বা প্রতিরোধ সংগঠিত না হতে পারে।
আন্দোলনকে দমন করার প্রচেষ্টা: এই অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সরকার চেষ্টা করেছিল বাঙালি আন্দোলনকে ধ্বংস করতে। কিন্তু অপারেশনের মাধ্যমে বাঙালি জনগণ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করে।
উপসংহার: অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে থামানোর প্রচেষ্টা চালালেও, এটি ছিল স্বাধীনতার সংগ্রামের সূচনা। বাঙালি জাতির দৃঢ় প্রতিরোধ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতার প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের মূল ধাপ শুরু হয়, যা ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় এবং স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায়।
