বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি কী?
ভূমিকা: বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি ছিল ১৯৪৭ সালে বাংলা প্রদেশকে অখণ্ড এবং স্বাধীন রাখার জন্য গৃহীত একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব। শরৎচন্দ্র বসু এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল, একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে হিন্দু-মুসলিম উভয়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
প্রেক্ষাপট: ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের দ্বারপ্রান্তে ছিল, এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেতে দেশটি ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার পথে এগোচ্ছিল। এই বিভাজন ধর্মীয় ভিত্তিতে হওয়ায় শরৎচন্দ্র বসু এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা প্রদেশকে অখণ্ড রাখার প্রস্তাব করেন। তাদের মতে, বাংলা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার যোগ্য ছিল, যেখানে ধর্মীয় বিভাজন ছাড়াই হিন্দু ও মুসলিমরা একত্রে বসবাস করতে পারবে।
চুক্তির প্রস্তাবনা: চুক্তিতে বলা হয়, বাংলা হবে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র, যেখানে হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করা হবে। প্রস্তাবিত গণপরিষদে ৩০ জন সদস্য থাকবে, যার মধ্যে ১৬ জন মুসলিম এবং ১৪ জন অমুসলিম হবেন। এছাড়া, অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় হিন্দু-মুসলিমের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
চুক্তির ভূমিকা: বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি ভারতীয় উপমহাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ভাবনা হিসেবে উঠে আসে। এটি ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজনের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল এবং বাংলা প্রদেশকে একটি জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ছিল। এই চুক্তি বাংলা অঞ্চলের ঐক্য এবং স্বাধিকার আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলা একটি শক্তিশালী ও একীভূত অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠতে পারত।
অংশগ্রহণ: এই চুক্তি প্রণয়নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, আবুল হাশিম, ফজলুর রহমান, কিরণশঙ্কর রায়সহ আরও অনেক বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। তারা সবাই বাংলাকে অখণ্ড রাখতে সম্মত হন এবং মুসলিম ও হিন্দু উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছান।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়া: চুক্তিটি একটি সাহসী পদক্ষেপ হলেও, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতারা এটি সমর্থন করেননি। কংগ্রেসের নেতাদের মতে, এটি পাকিস্তানের জন্য হিন্দুদের আত্মসমর্পণ হিসেবে দেখা হয়। অপরদিকে, মুসলিম লীগ মনে করেছিল যে এই প্রস্তাব পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল ভাবনার সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে, দুই দলের বিরোধিতার কারণে চুক্তিটি কার্যকর হয়নি।
ব্যর্থতা: রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিরোধিতা, হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক অবস্থার কারণে বাংলা প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়। পূর্ব বাংলা হয় পাকিস্তানের অংশ, আর পশ্চিম বাংলা হয় ভারতের অংশ।
উপসংহার: বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি বাংলা প্রদেশের একটি অখণ্ড এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল। এটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক প্রতিবন্ধকতার কারণে তা সফল হয়নি। তবে এ চুক্তি বাংলা অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
