জন অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব বর্ণনা কর।

জন অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব বর্ণনা কর।

জন অস্টিনকে (১৯২১–১৯৯৯) বলা হয় একত্ববাদী সার্বভৌমত্বের জনক। তাঁর সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। তিনি তার “Legal Positivism” দর্শনের ভিত্তিতে তিনি সার্বভৌমত্বকে ব্যাখ্যা করেছেন। অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতা যা আইন প্রণয়ন এবং তার কার্যকরতা নিশ্চিত করে। সার্বভৌমত্বের ধারণা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক। এটি এমন এক ক্ষমতা যা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। 

অস্টিনের তত্ত্বে, সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা  নির্দিষ্ট সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশই আইন হিসেবে বিবেচিত হয়। তার মতে, সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ এবং অভ্রান্ত।

অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য

১।  আইনের উৎস: অস্টিনের মতে, সার্বভৌম হলো সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যার আদেশ অনুসারে আইন তৈরি হয়। এই আইন মেনে চলতে জনগণ বাধ্য থাকে। সার্বভৌমত্বের আদেশই আইন হিসেবে গণ্য হয়।

২।  সর্বোচ্চ ক্ষমতা: সার্বভৌম ক্ষমতা হল নিরঙ্কুশ এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এটি অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। 

৩। নির্ধারিত গোষ্ঠী: অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্ব একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীর উপর প্রয়োগ করা হয়। এই গোষ্ঠী হলো সেই জনগণ যারা সার্বভৌমের আদেশ মেনে চলে এবং এর নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকে। 

৪। আদেশ ও বাধ্যবাধকতা: আইন হলো সার্বভৌম কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ, যা মেনে চলতে জনগণ বাধ্য। এই আদেশ অমান্য করলে শাস্তির বিধান প্রয়োগ করা হয়। 

৫। আদেশের অভ্যাস: অস্টিনের মতে, জনগণ সার্বভৌমের আদেশ মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলে। এটি একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

৬। প্রতিসম আদেশের অভাব: সার্বভৌম নিজে তার আদেশ মেনে চলতে বাধ্য নয় এবং তার আদেশের উপর অন্য কোনো আদেশ চাপানো যায় না।

৭। অবিচ্ছিন্ন ক্ষমতা: অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা অবিচ্ছিন্ন। এটি অন্য কোনো শক্তির দ্বারা লঘু করা যায় না। সার্বভৌমত্বের এই বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রের শাসন ও আইন কার্যকর রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৮। নিরঙ্কুশতা: সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ এবং এর আদেশের উপর কোনো প্রকার সীমাবদ্ধতা বা বাধা আরোপ করা যায় না।

৯। বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতকরণ: অস্টিনের তত্ত্বে জনগণ সার্বভৌমের আদেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য এবং এর ব্যতিক্রম হলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

১০। সার্বভৌমের প্রতি আনুগত্য: সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের প্রতি জনগণের আনুগত্য বাধ্যতামূলক। এই আনুগত্য রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক।

১১। আইন ও নৈতিকতার পৃথকীকরণ: অস্টিনের মতে, আইন এবং নৈতিকতা পৃথক। আইন সার্বভৌম কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ, নৈতিকতার সাথে এর কোনো সংযোগ নেই।

১২। ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা: সার্বভৌম ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত এবং এটি বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বিভাজিত নয়। এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হিসেবে কাজ করে।

১৩। সার্বভৌমত্বের চিরন্তনতা: অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্ব চিরন্তন এবং এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে যুক্ত। এটি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না।

সমালোচনা:

অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হলেও এটি বিভিন্ন ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার জন্য সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এর কতিপয় সমালোচনাগুলো  উল্লেখ করা হলো:

১। বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্য: আধুনিক রাষ্ট্রের বাস্তবতায় ক্ষমতা এককেন্দ্রিক নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি একত্রে কাজ করে। অস্টিনের একক সার্বভৌম শক্তির ধারণা এই বহুমাত্রিক বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না।

২। গণতন্ত্র বিরোধী: সার্বভৌমত্বের ধারণা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং জনগণের অংশগ্রহণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

৩। আইনের বৈধতার উপেক্ষা: অস্টিন জনগণের সম্মতি ও নৈতিক মানদণ্ডকে গুরুত্ব দেননি। তিনি আইনকে কেবল সার্বভৌমের আদেশ হিসেবে দেখেছেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই জনস্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।

৪। প্লুরালিস্টিক সমালোচনা: বহুত্ববাদী দর্শনের প্রবক্তারা মনে করেন আধুনিক সমাজে ক্ষমতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভাজিত। পরিবার, ধর্মীয় গোষ্ঠী, এবং পেশাজীবী সংগঠনের মতো প্রতিষ্ঠান আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অস্টিনের তত্ত্ব এই বহুত্ববাদী বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছে।

৫। স্বৈরতান্ত্রিক ঝুঁকি: একক সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা স্বেচ্ছাচারিতার পথ তৈরি করতে পারে। এটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে যেটি ব্যক্তি অধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ।

৬। আন্তর্জাতিক সীমাবদ্ধতা: আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ, এবং বহির্বিশ্বের চাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অস্টিনের তত্ত্ব এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় আনেনি।

৭। অপর্যাপ্ত মাপকাঠি: অস্টিনের তত্ত্বে সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের আনুগত্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। এতে আইন এবং ক্ষমতার সীমানা অস্পষ্ট রয়ে যায়।

৮। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিচার বিভাগ, আইনসভা, এবং নির্বাহী বিভাগ সমন্বিতভাবে কাজ করে। অস্টিনের তত্ত্বে এই বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিবেচনা নেই।

৯। নৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা: অস্টিন আইনের নৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করেননি। তার মতে, আইন কেবল সার্বভৌমের আদেশ, যা প্রায়ই সামাজিক এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে যেতে পারে।

১০। সার্বভৌমত্বের সীমাবদ্ধতা: আধুনিক রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণ সীমাহীন নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক চুক্তি, এবং অর্থনৈতিক চাপ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

এছাড়াও অস্টিন ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কের জটিলতাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন । তাঁর তত্ত্ব প্রাচীন রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য প্রাসঙ্গিক হলেও আধুনিক রাষ্ট্রে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং বৈশ্বিক সংস্থার প্রভাবের কারণে তার তত্ত্ব কার্যকর নয়।

পরিশেষে বলা যায়, অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব একটি নিরঙ্কুশ এবং শক্তিশালী ধারণা হিসেবে রাষ্ট্রের আইন ও শাসন ব্যবস্থার কাঠামো নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রভাব রয়েছে, তবুও অস্টিনের তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলোর মধ্যে অন্যতম। অস্টিনের তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনের ক্ষেত্রে এক অসাধারণ অবদান হিসেবে বিবেচিত হয়। 

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *