লিঙ্গ বৈষম্য কি? উন্নয়নশীল দেশে জেন্ডার অসমতার প্রকৃতি

 লিঙ্গ বৈষম্য কি? উন্নয়নশীল দেশে জেন্ডার অসমতার প্রকৃতি/ক্ষেত্র এবং সমাজে তার প্রভাব আলোচনা করো।

লিঙ্গ বৈষম্য একটি সামাজিক সমস্যা যা নারীদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং সমাজের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই নারী-পুরুষ একসঙ্গে সমাজ বিনির্মাণে অবদান রেখে আসছে। কিন্তু আজও, নারী-পুরুষের মধ্যে স্পষ্ট অসমতা বিদ্যমান, যা উন্নত ও অনুন্নত সব সমাজের জন্যই একটি সাধারণ বাস্তবতা। নারী অধিকারকে উপেক্ষা করে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই লিঙ্গভিত্তিক অসমতা দূর করার জন্য নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা অপরিহার্য।

লিঙ্গ বৈষম্য:  লিঙ্গ বৈষম্য হলো সমাজে নারী ও পুরুষের প্রতি অসম আচরণ। এটি একটি সামাজিক সমস্যা যা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, সম্পত্তির অধিকার এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীদের পিছিয়ে রাখে। লিঙ্গ বৈষম্য কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, পারিবারিক, সামাজিক, এবং রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

লিঙ্গভিত্তিক অসমতার সংজ্ঞা : লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বলতে, জেন্ডার বা লিঙ্গের ভিত্তিতে সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য।

উন্নয়নশীল দেশে জেন্ডার অসমতার প্রকৃতি/ক্ষেত্র

উন্নয়নশীল দেশে লিঙ্গ বৈষম্যের বিভিন্ন রূপ এবং ক্ষেত্র লক্ষ্য করা যায়, যা নারীদের সমঅধিকারের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। এর প্রধান ক্ষেত্রগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:

১. শিক্ষাঃ অনেক উন্নয়নশীল দেশে ছেলেদের তুলনায়  মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার অনেক কম। এ সকল দেশের আর্থিক সঙ্কট, সামাজিক নিয়ম বা বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েদের শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ এলাকায় মেয়েদের স্কুল ছাড়ার হার অনেক বেশি। 

২. কর্মসংস্থানঃ কর্মক্ষেত্রে নারীরা একই কাজের জন্য পুরুষদের তুলনায় কম বেতন পায়। এছাড়াও পরিবারসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বা নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশ গ্রহণ খুবই সীমিত। 

৩. স্বাস্থ্যসেবাঃ বিশ্বের সকল অনুন্নত, স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে নারীরা তাদের মাতৃস্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য, এবং স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। এসকল দেশগুলোতে নারীদের প্রসূতি মৃত্যুর হার এখনও উদ্বেগজনক।  

৪. রাজনৈতিক ক্ষমতায়নঃ  নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কম, এবং নেতৃত্বের ভূমিকায় তারা প্রায় অনুপস্থিত। অনেক দেশে সংসদে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় অনেক নগণ্য। 

৫. বাল্যবিবাহ ও যৌন সহিংসতাঃ বাল্যবিবাহ নারীদের শিক্ষার অধিকার ও স্বাধীনতাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করে। যৌন হয়রানি এবং পারিবারিক সহিংসতা নারীদের মানসিক ও শারীরিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।

৬. সম্পত্তির অধিকারঃ অনেক সমাজে বিশেষ করে হিন্দু সমাজে নারীদের সম্পত্তির অধিকার পুরুষদের তুলনায় কম। এ কারণে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন না।

সমাজে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রভাব

উন্নয়নশীল দেশে লিঙ্গ বৈষম্য কেবল নারীদের উপরেই নয়, সামগ্রিক সমাজের উন্নয়নেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব হলো: 

১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়ঃ কর্মক্ষেত্রে নারীদের সঠিকভাবে অংশগ্রহণের অভাব জাতীয় উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সমান সুযোগ দিলে নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। 

২. শিক্ষার মান কমে যায়ঃ মেয়েদের শিক্ষার অভাব শুধু তাদের জীবনের মান কমিয়ে দেয় না, বরং পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৩. গণতন্ত্র ও নেতৃত্ব দুর্বল হয়ঃ নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করে।

৪. স্বাস্থ্যখাতের অবনতিঃ নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো অগ্রাধিকার না পেলে পরিবার ও সমাজের সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

৫. পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ঃ নারীদের অবহেলা করলে পরিবারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এটি সামাজিক বন্ধন,স্থিতিশীলতা এবং স্থায়িত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

৬. সমাজে বৈষম্যের চক্র অব্যাহত থাকেঃ নারীদের প্রতি বৈষম্য তাদের সন্তানদের মধ্যেও স্থানান্তরিত হয়, ফলে বৈষম্যের চক্র ভাঙা কঠিন হয়। 

৭. দারিদ্র্য এবং অনগ্রসরতা বৃদ্ধি পায়ঃ নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না করতে পারলে সমাজের দারিদ্র্য বৃদ্ধির ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। 

লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগেঃ 

শিক্ষার প্রসার: মেয়েদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি এবং কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ প্রদান করতে হবে। 

আইনি সমতা: সম্পত্তি অধিকার ও বেতনের সমতা নিশ্চিত করতে কঠোর আইন প্রণয়ন করা জরুরী। 

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: লিঙ্গভিত্তিক স্টেরিওটাইপ/বাঁধাধরা নিয়ম দূর করতে এবং নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে প্রচার প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।

প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সুযোগ: নারীদের ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

ন্যায়বিচার: ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। 

পরিশেষে  একথা স্পষ্ট যে, উন্নয়নশীল দেশে লিঙ্গ বৈষম্য একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা, যা নারীদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। তাই শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এটি শুধু নারীদের উন্নয়ন নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, নারী-পুরুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, এবং নেতৃত্বে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য পরিবার, সরকার এবং সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। 

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *