রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক পদ্ধতি আলোচনা কর

 প্রশ্নঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক/ বিবর্তনমূলক পদ্ধতি আলোচনা কর। অথবা, রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, সৃষ্টি হয়নি- উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকা: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। এসব তত্ত্বের মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তন তত্ত্ব হল সর্বজনস্বীকৃত তত্ত্ব। রাষ্ট্রের উৎপত্তির অন্যান্য তত্ত্বগুলিকে নানানভাবে ভুল প্রমাণ করা হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, অন্যান্য মতবাদ অসম্পূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত নয়। তারা রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক বা বিবর্তনীয় তত্ত্বকে সঠিক বলে চিহ্নিত করে। এই মতবাদের প্রধান সমর্থক হলেন প্রফেসর গার্নার, লিকক, বার্গেস, ম্যাকআইভার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।

রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক/ বিবর্তনমূলক মতবাদ: ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্র আকস্মিকভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টি হয়নি। মানব সমাজের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন উপাদান ও শক্তির ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। বর্তমানকালের রাষ্ট্র সুদীর্ঘ কয়েক হাজার বছরের ক্রমবিকাশের ফল। তাই এই ক্রমবিকাশের মতবাদটিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনমূলক মতবাদ নামে আখ্যায়িত করেছেন। 

আরো পড়ুনঃ Political Theory Previous Year Brief (2010-2022)

অধ্যাপক গার্নার (Garner)-এর ভাষায়, “রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্টি নয়। দৈহিক বল প্রয়োগের ফলও নয়, কোনো প্রস্তাব বা সম্মেলনের দ্বারা রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়নি; এমনকি পরিবারের সম্প্রসারণের ফলে এর সৃষ্টি হয়নি। রাষ্ট্র কোনো কৃত্রিম বা যান্ত্রিক উপায়ে সৃষ্টি নয়, রাষ্ট্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে।”

অধ্যাপক স্টিফেন বাটলার লীকক (Stephen Butler Leacock)-ও অনুরূপ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “মানুষের ইতিহাসের জানা অজানা অধ্যায় হতে রাষ্ট্র বিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে।” 

অধ্যাপক বার্জেস (Burgess) বলেন, “রাষ্ট্র মানব সমাজের মোটামুটিভাবে অসম্পূর্ণ অবস্থা থেকে অমার্জিত কিন্তু উন্নতি সাধক অবস্থার অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ ও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।”

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিটি আলোচনা কর

রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐতিহাসিক/ বিবর্তনমূলক মতবাদের উপাদানসমূহ:

১. রক্তের সম্পর্ক: রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম প্রাথমিক উপাদান হল রক্তের সম্পর্ক। রক্তের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। ক্রমে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পরিবারের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পরিবার ভিন্ন হলেও তাদের পূর্বপুরুষ এক এবং সেই সূত্রে সবার মধ্যে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এমন একটি ধারণা গভীর আত্মীয়তাবােধের সৃষ্টি করেছিল। 

২. ধর্ম: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রক্তের সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত আত্মীয়তাবােধ খুব বেশিদিন পরিবারগুলির বন্ধনকে অটুট রাখতে পারেনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পরিবার ক্রমশ গোষ্ঠীর অধীনে এসেছে। ক্রমে গোষ্ঠীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকলে রক্তের সম্পর্কজনিত একাত্মতা শিথিল হয়ে পড়ে। এই সময় সামাজিক সংহতির শক্তিশালী হাতিয়ার ধর্ম মানুষকে পুনরায় একতার বন্ধনে আবদ্ধ করে। ধর্মীয় শিক্ষাগুরুরা ধর্মীয় বিধি ও অনুশাসন তৈরি করে সামাজিক শৃঙ্খলাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এই সামাজিক শৃঙ্খলা রাষ্ট্র গঠনের পথকে প্রশস্ত করে।

৩. যুদ্ধ: আদিম সমাজে মানুষ যখন যাযাবর জীবনের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো দলপতির অধীনে বসবাস শুরু করে তখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা থেকে পরিবারের জন্ম হয়। পরে এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে এক উপজাতি গোষ্ঠী নিজেদের দলপতির নেতৃত্বে অন্য উপজাতিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এইভাবে একজন সফল দলপতি পরবর্তীকালে রাজার স্বীকৃতি অর্জন করেন।

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞান এর সম্পর্ক আলোচনা কর

৪. অর্থনৈতিক চেতনা: আদিম অবস্থায় মানুষ বাঁচার তাগিদে দল বেঁধে বনজঙ্গল থেকে ফলমূল সংগ্রহ ও পশুশিকার করত। এইসময় ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি বলে কোনো কিছু ছিল না। মানুষ প্রকৃতি থেকে যা সংগ্রহ করত তা সবাই মিলে সমানভাবে ভোগ করত। পরে পশুপালনের যুগে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে। ফলে সমাজে ধনবৈষম্য দেখা দেয়। সেই সঙ্গে চৌর্যবৃত্তি, অসাধুতা প্রভৃতিও দেখা দেয়। তখন সামাজিক শৃঙ্খলা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে মানুষ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগী হয়।

৫. রাজনৈতিক চেতনা: অর্থনৈতিক চেতনার হাত ধরে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। আদিম যুগে রক্তের সম্পর্ক এবং ধর্মের ভীতি মানুষকে পরিবারের প্রধান ও পুরােহিতদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করতে শিখিয়েছিল। এজন্য এই সময়কে ‘রাজনৈতিক চেতনাশূন্যতার যুগ’ বলা হয়। পরবর্তীকালে উপজাতীয় জীবনে অধিক সচেতন মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও প্রাণরক্ষার তাগিদে নিজ দলপতির প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রদর্শন করে। এইভাবে নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিবর্তনের এক ঐতিহাসিক পর্যায়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম হয়।

আরো পড়ুনঃ  রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা কর

উপসংহার: বিবর্তনবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্র আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়নি বা কোনো-এক অলৌকিক শক্তিও রাষ্ট্র সৃষ্টি করেনি। রাষ্ট্র হল মানবসমাজের নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিবর্তনের এক বিশেষ পর্যায়ের ফসল। বিবর্তনবাদের এই ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানসম্মত।

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *