প্রশ্নঃ ডুরখেইমের যান্ত্রিক সংহতি ও জৈবিক সংহতির পার্থক্য আলোচনা করো।
ভূমিকা: প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম (1858-1917) বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সের সমাজবিজ্ঞানী। ইউরোপের ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে ১৮৫৮ সালে ফ্রান্সের লোরিন প্রদেশে এক ধর্মযাজক পরিবারে ডুরখেইম জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ফরাসি বিপ্লবের পরে সে সমাজে সঙ্কট, নৈরাজ্য অন্যান্য সব মিলিয়ে ফরাসি বিপ্লবোত্তের সমাজ ছিল সুস্থ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী। তাই সমাজকে ধ্বংস ও নৈরাজ্যের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি এগিয়ে আসেন এবং সমাজ বিশ্লেষণের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন।
(ক) যান্ত্রিক সংহতিঃ ডুরখেইম যান্ত্রিক সংহতি বলতে এমন সংহতিকে বুঝিয়েছেন যেখানে সমাজের সভ্যদের মধ্যে এক অনন্য সাদৃশ্য বিদ্যমান। যান্ত্রিক সংহতিতে এক ব্যক্তি অপর হতে খুব কমই পৃথক থাকে অর্থাৎ সকলেই একই রকম আচার আচরণ ও চিন্তা-চেতনা এবং মূল্যবোধের অধিকারী হয়ে থাকে। সে কারণে এ সংহতিকে একটি যন্ত্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেখানে একটি যন্ত্রের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ নিজ নিজ কাজ করে যন্ত্রটি সচল রাখে।
(খ) জৈবিক সংহতিঃ অপরদিকে জৈবিক সংহতি হচ্ছে যেখানে সামাজিক সভ্যদের মধ্যে চিন্তায়, আচরণে কিংবা মূল্যবােধে তেমন সাদৃশ্য নেই। এ ধরণের ভাষায়, জৈবিক সংহতিতে সমাজের বিভিন্ন সভ্য বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদন করে যেমন মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গে বিভিন্ন ক্রিয়া করে থাকে। তাই বিভিন্ন অঙ্গ পরস্পর নির্ভরশীল হয়েও আলাদা-আলাদা ক্রিয়া করে থাকে। ডুরখেইম Organic শব্দটি ব্যবহার করেন সংহতির ক্ষেত্রে।
ডুরখেইমের যান্ত্রিক সংহতি ও জৈবিক সংহতির মধ্যে ৮টি পার্থক্য:
১. সমাজের ধরন: যান্ত্রিক সংহতি প্রাক-শিল্পায়িত সমাজে বিদ্যমান, যেখানে সমাজের সদস্যদের মধ্যে সাদৃশ্য বেশি থাকে। জৈবিক সংহতি শিল্পায়িত সমাজে বিদ্যমান, যেখানে সমাজের সদস্যদের মধ্যে বৈচিত্র্য বেশি থাকে।
২. শ্রমবিভাজনের ধরন: যান্ত্রিক সংহতি প্রাক-শিল্পায়িত সমাজে বিদ্যমান, যেখানে শ্রমবিভাজন কম হয় এবং সমাজের সদস্যরা একই ধরনের কাজ করে। জৈবিক সংহতি শিল্পায়িত সমাজে বিদ্যমান, যেখানে শ্রমবিভাজন বেশি হয় এবং সমাজের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাজ করে।
আরো পড়ুনঃ বিশ্বায়ন কি? উন্নয়নশীল দেশ বা তৃতীয় বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা করো।
৩. সামাজিক বন্ধনের ভিত্তি: যান্ত্রিক সংহতি সামাজিক বন্ধনের ভিত্তি হল সাদৃশ্য, যেমন একই বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ইত্যাদি। জৈবিক সংহতি সামাজিক বন্ধনের ভিত্তি হল পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, যেমন একই ধরনের পণ্য বা সেবা প্রদান ইত্যাদি।
৪. সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি: যান্ত্রিক সংহতি সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি হল বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ, যেমন আইন, নিয়ম, প্রথা ইত্যাদি। জৈবিক সংহতি সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি হল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, যেমন নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
৫. সামাজিক পরিবর্তনের প্রবণতা: যান্ত্রিক সংহতি সমাজে সামাজিক পরিবর্তনের প্রবণতা কম থাকে। জৈবিক সংহতি সমাজে সামাজিক পরিবর্তনের প্রবণতা বেশি থাকে।
৬. সামাজিক বিরোধের প্রকৃতি: যান্ত্রিক সংহতি সমাজে সামাজিক বিরোধের প্রকৃতি হল বাহ্যিক বিরোধ, যেমন শারীরিক সংঘর্ষ, বিদ্রোহ ইত্যাদি। জৈবিক সংহতি সমাজে সামাজিক বিরোধের প্রকৃতি হল অভ্যন্তরীণ বিরোধ, যেমন রাজনৈতিক বিরোধ, মতবিরোধ ইত্যাদি।
৭. সামাজিক ঐক্য ও সংহতির ধরন: যান্ত্রিক সংহতি সমাজে সামাজিক ঐক্য ও সংহতির ধরন হল এককতা, যেমন একই ধরনের পোশাক, খাবার, আচার-আচরণ ইত্যাদি। জৈবিক সংহতি সমাজে সামাজিক ঐক্য ও সংহতির ধরন হল বৈচিত্র্য, যেমন বিভিন্ন ধরনের পোশাক, খাবার, আচার-আচরণ ইত্যাদি।
৮. সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া: যান্ত্রিক সংহতি সমাজে সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হল প্রতিরোধ, যেমন নতুন ধারণা বা প্রযুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করা। জৈবিক সংহতি সমাজে সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হল গ্রহণ, যেমন নতুন ধারণা বা প্রযুক্তিকে গ্রহণ করা।
আরো পড়ুনঃ সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও। সংস্কৃতির বৈশিষ্ট ও উপাদানসমূহ আলোচনা করো।
উপসংহার: যান্ত্রিক সংহতি ও জৈবিক সংহতি দুটি ভিন্ন ধরনের সামাজিক সংহতি। যান্ত্রিক সংহতি প্রাক-শিল্পায়িত সমাজে বিদ্যমান, যেখানে সমাজের সদস্যদের মধ্যে সাদৃশ্য বেশি থাকে। জৈবিক সংহতি শিল্পায়িত সমাজে বিদ্যমান, যেখানে সমাজের সদস্যদের মধ্যে বৈচিত্র্য বেশি থাকে।