প্রশ্নঃ আইন কাকে বলে? আইন ও নৈতিকতার মধ্যে সম্পর্ক লিখ।
ভূমিকাঃ “মানুষকে সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং সুশৃংখলভাবে পরিচালনার জন্য যে নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয় তাকে আইন বলে”। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় আইন হলো সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক বলবৎযোগ্য বিধান, যা সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়। আইন হলো এমন কিছু কঠোর নিয়ম বা রীতির সমষ্টি যাকে নাগরিক বাধ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করতে ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকরী করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আইন লিখিত হয়। তবে কখনো কখনো প্রচলিত বিধি-বিধানকেও আইন হিসেবে গণ্য করা হয়।
আইনের প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ নিচে আইনের প্রামাণ্য সংজ্ঞা দেওয়া হলো:
- গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেন, “আইন হলো পক্ষপাতহীন যুক্তি।”
- আইনবিদ জন অস্টিনের মতে, “সার্বভৌম শক্তির আদেশই হলো আইন।”
- অধ্যাপক হল্যান্ড-এর মতে, “আইন হলো মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের এমন কতগুলো সাধারণ নিয়ম যা সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত হয়।”
- স্যার হেনরি মেইন বলেন, “আইন হলো পরিবর্তনশীল, ক্রমাউন্নতিমূলক, ক্রমবর্ধমান ও দীর্ঘকালীন সামাজিক প্রথার গতির ফল।”
আইন ও নৈতিকতার সম্পর্কঃ আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। এরা পরস্পর পরিপূরক। নিম্নে আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক আলোচনা করা হলো-
(১) আইন ও নৈতিকতার লক্ষ্য এক ও অভিন্নঃ আইন ও নৈতিকতা উভয়ই সমাজে বসবাসরত মানুষের কল্যাণসাধন করে। আইন জনগণের কল্যাণসাধন করে মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর নৈতিকতা মানুষের মনােজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।
(২) আইননীতিবােধকে প্রভাবিত করেঃ আইন অনেক সময় সমাজের নীতিবােধকে প্রভাবিত করে দেশের নৈতিক অবস্থার উন্নতির ব্যবস্থা করে। পূর্বে সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি নীতিসম্মত ছিল। কিন্তু আইন করে এই সকল প্রথা দণ্ডনীয় করার পর এগুলো সমাজে ক্রমশ কেবল বেআইনি নয়, নীতিবিরোধী বলে স্বীকৃত হলো।
(৩) নীতিজ্ঞান আইনকে প্রভাবিত করেঃ সমাজের নীতিজ্ঞান আইনকে প্রভাবিত করে। নীতিবােধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে আইন প্রণয়ন করা হয়। সেইজন্য আইনকে একটি দেশের নৈতিক মানের পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। কোনো দেশের নৈতিক মূল্যবোেধ উন্নত হলে তার আইন ব্যবস্থাও উন্নত হয়ে থাকে।
(৪) নৈতিকতার ন্যায় আইনও সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলঃ সমাজের পরিবর্তন হলে সেই সাথে নৈতিকতারও পরিবর্তন ঘটে। নতুন ধরনের আইনের প্রভাবে নৈতিকতার মানদন্ড পরিবর্তিত হয়। যেমন- পুঁজিবাদী সমাজের নৈতিক মানদন্ড এক ধরনের আবার সমাজতান্ত্রিক সমাজের মানদন্ড অনুরূপ। এ কারণে আইনও ভিন্ন প্রকৃতির।
(৫) আইন ও নৈতিকতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই সমাজ জীবনকে সমৃদ্ধি দান করেঃ আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেই সমাজ জীবনের উৎকর্ষ সাধিত হয়। মানুষের নৈতিকতা যদি উচ্চমানের না হয় তাহলে কোন রাষ্ট্রের আইন উন্নতমানের হতে পারে না। যে দেশের জনগণের মূল্যবােধ নিম্নমানের সে দেশের আইনও নিম্নমানের।
আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর
(৬) রাষ্ট্রের বিশেষ আইনঃ রাষ্ট্রে এমন অনেক আইন রয়েছে যেগুলো নৈতিকতাবহির্ভূত হলেও রাষ্ট্র কর্তৃক পালিত ও কার্যকর হয়ে থাকে। যেমন- রাস্তার ডানে বামে অসংযতভাবে গাড়ি চালনা করা নৈতিকতা বিরুদ্ধ নয় কিন্তু তথাপি এটা বেআইনী।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত সুনিবিড়। সত্যিকার তার্থে, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি থেকেই আইনের জন্য হয়। নৈতিকতা বিরোধী আইন কখনও কার্যকর করা সম্ভব নয়। যখন আইন নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তখনই এটা গণসমর্থন লাভ করে। ফলে দুর্নীতিমূলক আইন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী হয়ে পড়ে।