আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর

প্রশ্নঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর।

earn money

ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনসভা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইন প্রণয়ন (Rule Making) হল আইনসভার মুখ্য কাজ। আইন প্রণয়ন ছাড়াও আইনসভাকে নানাবিধ ভূমিকা পালন এবং কার্য সম্পাদন করতে হয়। তবে সাম্প্রতিককালে আইনসভার মর্যাদা, প্রভাব এবং ক্ষমতা হ্রাসের কারণ ইত্যাদি সংক্রান্ত আলোচনা সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

আইনসভা: আইনসভা হল সরকারের সেই বিভাগ যেখানে সরকার আইন প্রণয়ন করে, পরিবর্তন করে, সংশোধন করে তাকে আইন বিভাগ বলা হয়। আইন বিভাগের প্রণীত আইনের দ্বারা শাসন বিভাগ রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং বিচার বিভাগ বিচার কার্যক্রম সম্পাদন করে। আইন বিভাগ ছাড়া কখনও একটি রাষ্ট্র সুসংহত হতে পারে না।

আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর

আইনসভার প্রামাণ্য সংজ্ঞা: আইনসভা সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের অভিমত দিয়েছেন। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো-

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


Oxford Dictionary-এর সংজ্ঞানুযায়ী, “আইনসভা হচ্ছে একদল লোকের সমষ্টি যাদের আইন তৈরি এবং পরিবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে।” (Legislature is a group of people who have the power to make and change laws.)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টকভিল (Tocqueville) বলেছেন, “সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইনসভা হলো একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে জনগণের প্রাধান্য থাকে।”

ইংল্যান্ডের সংবিধান বিশারদ ওয়াল্টার বেজহট (Walter Bagehot) বলেছেন, “এটি হলো জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের মহান চালিকাশক্তি, যেখানে সকল সমস্যার সমাধান হয় এবং সর্বক্ষেত্রে জনগণের প্রাধান্য থাকে।”

অধ্যাপক গার্নার (Gamer) এর মতে, “সরকারের সকল বিভাগের মধ্যে আইনসভা নিশ্চিতভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে আছে।” 

অইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ: যে সমস্ত কারণে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-

১. আইন প্রণয়নে আইনসভার শিথিলতা: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভার প্রাধান্য তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ আইন শাসন বিভাগের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়। আইনসভায় শাসকদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার জন্য দলীয় নির্দেশে মন্ত্রীসভার সদস্যরা সরকারের এবং সরকার পক্ষের সদস্যরা কোনো বিলের পক্ষে ভোট দেন। তাই অনেকে মনে করেন যে, আইন প্রণয়নে আইনসভার ভূমিকা এখন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে।

২. দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা: দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা তথা নিয়মানুবর্তিতা অর্থাৎ দলীয় আদেশ-নির্দেশ, শৃঙ্খলা, সাংগঠনিক দৃঢ়তা আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের উল্লেখযোগ্য কারণ। আইনসভার সদস্যরা দলীয় নির্দেশ অনুসারে আইনসভার অভ্যন্তরে তাদের বক্তব্য পেশ ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেন। শাসকদলের সদস্যরা আইনসভায় এমন কিছু করেন না যা তাদের সরকারের এবং নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তোলে। তাই নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের স্বার্থে দলীয় নির্দেশকে পালন করাই তারা শ্রেয় বলে মনে করেন।

৩. জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি: জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির জটিলতা, জনগণের মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন, দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা, আইনসভার সদস্যদের গুণগত যোগ্যতা হ্রাস, অর্থনৈতিক সংকট, আইনসভার সদস্যদের আলোচনার উপর সাংবিধানিক বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি আইনসভার ক্ষমতাকে নিষ্প্রভ করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের শাসক প্রধান প্রধানমন্ত্রী পদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে বলেন প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতি কর্ণ ঘটেছে।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

৪. সদস্যদের অযোগ্যতা: দেশের শিক্ষিত ও জ্ঞানী সমাজ আমাদের দেশে প্রচলিত প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি থেকে দূরে থাকে। ফলে অশিক্ষিত ও মূখ শ্রেণি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়। এসব অশিক্ষিত লোক সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ।

৫. জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব: জনসাধারণের মনস্তত্ত্বও শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। বাস্তবে শাসন বিভাগই আধুনিক রাষ্ট্রে সকল বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাই শাসন বিভাগের প্রতি জনগণের আগ্রহ বৃদ্ধি আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসের একটি কারণ।

৬. আইনসভার সদস্যদের সংসদীয় গুণগত যোগ্যতার মান হ্রাস: আইনসভার সদস্যদের গুণগত মান হ্রাস জনমানসে এবং বাস্তবে আইনসভার প্রভাব ও ক্ষমতা হ্রাসে সাহায্য করেছে বলে অনেকে মনে করেন। তা ছাড়া আইনসভার মধ্যে একঘেয়েমি ও অর্থহীন। বাগাড়ম্বর সাধারণ মানুষের কাছে আইনসভার বিতর্কের আকর্ষণ ও গুরুত্ব হ্রাসের আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে বিবেচিত হয়।

৭. স্বার্থগোষ্ঠী যোগসূত্র হিসেবে ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা: পূর্বে আইনসভা মূলত শাসন বিভাগ এবং জনগণের মধ্যে সংযোগসাধনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর উদ্ভব ও পেশাগত গোষ্ঠীর উদ্ভব এবং তাদের সঙ্গে যােগাযােগে ব্যর্থতার কারণেও আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।

৮. ক্ষমতার লোভ: আইনসভার সদস্যদের অতিমাত্রায় ক্ষমতার লোভ। জনগণের স্বার্থ না দেখে তারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে তৎপর। এজন্য দিন দিন আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

৯. জরুরি অবস্থায় ব্যর্থ: সরকারের যে কোন প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আইনসভা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ। আইনসভার মমতা হ্রাসের এটি অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত।

১০. অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন: অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের পদ্ধতিকেও আইনসভার প্রভাব হ্রাসের একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সময়ের অভাব, জরুরি অবস্থায় সংকট মােকাবিলা, আইনের নমনীয়তা, আইনসভার সদস্যদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অভাবের ফলে বাধ্য হয়েই আইনসভার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।

১১. আলোচনার সুযোগের অভাব: আইনসভার বিরোধী দল অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে সরকারের দোষ, ত্রুটিবিচ্যুতি বা ব্যর্থতার সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু সরকার যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।

১২. আইনসভার সদস্যদের স্বার্থপর মানসিকতা: সমালোচকরা মনে করেন, আইনসভার সদস্যদের বেতন, ভাতা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় বলেই তাদের মধ্যে স্বার্থপর মানসিকতার সৃষ্টি হয়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আইনসভার সদস্যরা নিজেদের সুযোগসুবিধা সংরক্ষণের কাজে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। এইজন্যই আইনসভার ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে, যার ফলস্বরূপ শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

১৩. গণসংযোগের অভাব: বর্তমানে শাসন বিভাগ জনস্বার্থে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে ফলে জনগণের সাথে শাসন বিভাগের সদস্যদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং আইন বিভাগের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক বিছিন্ন হচ্ছে। ফলে আইনসভার ক্ষমতার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।

১৪. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: সাম্প্রতিককালে সরকারের আর্থিক বিষয়গুলি বেশ জটিল প্রকৃতির ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা বিশ্লেষণের জন্য বিশেষজ্ঞদের প্রয়ােজন, কিন্তু আইনসভার সকল সদস্য আর্থিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, সদস্যদের এই অনভিজ্ঞতা ও কাজের প্রতি অনুৎসাহ শাসন বিভাগের হাতকে শক্তিশালী করে তুলেছে। ভারতে ও ব্রিটেনে পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি, এস্টিমেট কমিটি, অডিটর ও কম্পট্রোলার জেনারেল থাকলেও তা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।

উপসংহার: উপরোক্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সরকারের ক্ষমতার ভারকেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটেছে – পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাবে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, আইনসভা তাদের পূর্ব গৌরব ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে হারিয়ে ফেলেছে এবং সকলের কাছে একটি তর্কবিতর্কের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ব্লন্ডেলের ভাষায় বলা যায়, বর্তমানে আইনসভার ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পেলেও সংযোগসাধনের মাধ্যম হিসেবে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের ধারণাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

2 COMMENTS

  1. স্যার নিজের ভাষায় লিখছেন নাকি কোন বই থেকে তুলে দিছেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক