বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখ। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখ। 

ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতির গৌরবের সর্বোচ্চ অধ্যায়। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি দীর্ঘ শাসন-শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ঐতিহাসিক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং বিজয়ের প্রতীক। জাতি হিসেবে আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার, মর্যাদা ও স্বপ্ন পূরণের পথ তৈরি হয়েছিল এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ তৈরি হয়। পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল—পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্বপাকিস্তান। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানকে কখনোই সমান মর্যাদা দেয়নি। বরং পূর্বপাকিস্তানকে শাসন ও শোষণের মাধ্যমে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানের কাঁচামাল ব্যবহার করলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অবদান ছিল না। রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো। 

প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও পূর্বপাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাধা দেয়। এসব বৈষম্য, শোষণ ও অধিকার হরণের কারণে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের দাবিটি আরও জোরালো হয়ে ওঠে।

ভাষা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের উত্থান: বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রাজনৈতিক সচেতনতার মধ্যে হলেও এটি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে বাঙালিরা এর বিরোধিতা করে। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ হয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, যখন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই শহিদ হন। 

ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এরপর যুক্তফ্রন্টের জয় (১৯৫৪), ১৯৬৩ সালের শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা (১৯৬৬), গণ-অভ্যুত্থান (১৯৬৯), এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা পায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

৭ মার্চের ভাষণ: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ভাষণ জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে।

অপারেশন সার্চলাইট: ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে। তারা নির্বিচারে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করে। এই নৃশংস গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা আরও বাড়িয়ে দেয়।

মুজিবনগর সরকার গঠন: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এই সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার নেতৃত্ব দেয় এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করে।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা: মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন। সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে তারা দেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। তাদের অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।

নারীদের ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধে নারীরা সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করেন। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন, আহতদের সেবা দিয়েছেন এবং কখনো কখনো নিজের জীবনও উৎসর্গ করেছেন।

প্রবাসী বাঙালিদের অবদান: প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে অর্থ, সমর্থন ও জনমত আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা: শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণকে উজ্জীবিত করেন। তাদের লেখা, গান এবং নাটক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দেয়।

আন্তর্জাতিক সমর্থন: মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানায়। বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক পরিচালনা: মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এই সেক্টরগুলো থেকে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালিত হয়, যা পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে।

যৌথ বাহিনীর ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে অভিযান চালায়। তাদের একত্রিত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

বিজয়ের দিন: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হয়। রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: মুক্তিযুদ্ধ কেবল স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়, এটি একটি অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়ভিত্তিক ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন। এই চেতনা আমাদের জীবন ও উন্নতির পথনির্দেশ করে।

বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব: মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা এবং তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব। কুসংস্কার, দুর্নীতি ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি দেশ গড়তে এই চেতনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উপসংহার: মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অহংকার ও জাতির মুক্তির চিরন্তন প্রতীক। এটি আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি, যা অমূল্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *