শিল্পায়ন কি? বাংলাদেশে শিল্পায়নের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো। 

প্রশ্নঃ শিল্পায়ন কি? বাংলাদেশে শিল্পায়নের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো। 

ভুমিকাঃ শিল্পায়ন হলো একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যাতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে শিল্পের উৎপাদন, বিকাশ এবং বিস্তার। শিল্পায়ন অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিল্পায়নের পরিচচয়ঃ শিল্পায়ন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Industrialization’। যা ল্যাটিন শব্দ Industria হতে উৎপন্ন হয়েছে। আর Industria শব্দের অর্থ হলো কর্মকাণ্ড বা উদ্যোগ। বৃহৎ অর্থে কোনো খাতে বৃহৎ যান্ত্রিক উৎপাদন সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে শিল্পায়ন বলা হয়।

শিল্পায়নের ইতিহাসঃ বাংলাদেশে শিল্পায়নের ইতিহাস শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। ব্রিটিশরা এখানে টেক্সটাইল, সিমেন্ট, চিনি, চা, ইত্যাদি শিল্পের বিকাশ ঘটায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার শিল্পায়নের উপর জোর দেয়। ১৯৭০-এর দশকে আমদানি-প্রতিস্থাপন শিল্পায়ন কৌশল অনুসরণ করে। ১৯৮০-এর দশকে বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

আরো পড়ুনঃ শিল্পায়ন কি? বাংলাদেশে শিল্পায়নের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো। 

বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রভাবঃ বর্তমানে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। শিল্পায়ন এই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সামাজিক পরিবর্তনে এর প্রভাব অনেকটা তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রভাব নিম্নরূপ:

১। কর্মসংস্থান সৃষ্টি: শিল্পায়নের ফলে নতুন নতুন শিল্পের বিকাশ ঘটে। এর ফলে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়। এতে গ্রামীণ সমাজ থেকে আগত ব্যক্তিবর্গ কাজের সুযোগ পায়। নিজেদেরকে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেতেও নগর জীবন অধিকতর সহায়ক।

২। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: শিল্পায়নের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়াতে যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।

৩। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি: শিল্পায়নের ফলে শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন অনেকাংশে বেড়ে যায় যার ফলশ্রুতিতে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়।

৪। সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন: শিল্পায়নের ফলে সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন আসে। তাছাড়া নগরে বিভিন্ন বিষয়ে বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা থাকায় সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ শহরে ভীড় জমায়। শিল্পায়নের ফলে এর ফলে সমাজের শ্রেণি কাঠামোয় পরিবর্তন সাধিত হয়। এ প্রেক্ষিতে সমাজ কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন সাধিত হয়।

আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে অগাস্ট কোঁতের অবদান আলোচনা করো।

৫।পেশাগত বৈচিত্রঃ শিল্পায়নের ফলে সমাজে পেশাগত বৈচিত্র দেখা যায়। সমাজে নানা পেশার মানুষ তারা তাদের পূর্বের পেশা পরিবর্তন করে নতুন পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় এতে করে মানুষের মধ্যে পেশাগত বৈচিত্র উপলক্ষিত হয়।

 ৬। সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন পেশার সুযোগ থাকায় গ্রাম ও নগরবাসীদের মধ্যে দ্রুত গতিতে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

৭। আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ: শিল্পায়নের ফলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশ ঘটে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বহুমুখী সংস্কৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবন-যাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশে শিল্পায়ন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

৮। গ্রামীণ জীবনে প্রভাব: গ্রামীণ সংস্কৃতি তথা গ্রামীণ জীবনের উপর নগর সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জীবনপ্রণালী যেমন- ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক আচার-প্রথা, ঐতিহ্য ইত্যাদিতে যেমন পরিবর্তন হয় তেমনি বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রেও নগরের প্রভাব গ্রামীণ জীবনের উপর গিয়ে প্রভাব বিস্তার করে।

৯। স্থানান্তর গমন ত্বরান্বিত হয়: শিল্পায়নের ফলে মানুস গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তরের সুযোগ পায়। এর ফলে উন্নয়নশিল দেশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কর্মসংস্থানের তাগিদে শিল্প নগরে পাড়ি জমায়। এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়।

আরো পড়ুনঃ সামাজিক পরিবর্তন কি? সামাজিক পরিবর্তনের মার্ক্সিয় তত্ত্বটি আলোচনা করো।

১০। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: শিল্পায়ন জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করে থাকে। শিল্পায়নের ফলে শহরের মানুষ ও গ্রামের মানুসের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় যার ফলশ্রুতিতে শহরের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রামের মানুষের উপর বিস্তার করে। কেননা নগরাবাসীরা তুলনামূলকভাবে বেশি বাস্তববাদী, বেশি গণতান্ত্রিক চেতনার অধিকারী। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের ক্ষেত্রেও নগরের অধিবাসীরা বেশি অগ্রগামী। নগরবাসীরা তুলনামূলকভাবে বেশি রাজনীতি সচেতন। ধর্মনিরপেক্ষতায়ও তারা অধিকতর অগ্রসর।

১১। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ: শিল্পায়নের ফলে বর্হিবিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অনেক বৃদ্ধি পায় যা বিশ্বায়নকে ত্বরান্বিত করে। বিশ্বায়নের ফলে নানা ক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়।

১২। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান: শিল্পায়ন জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিবিএস এর সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০২১ – ২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপিতেশিল্প খাতের অবদান ৩৭.০৭ শতাংশ ২০২০ ২১ অর্থবছরে জিডিপিতে এখাতের অবদান ছিল ৩৬.০১ শতাংশ।

১৩। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে শিল্পায়নের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।

শিল্পায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যা একটি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে শিল্পায়ন একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। সরকার শিল্পায়নকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

১৪। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: শিল্পায়নের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে এতে মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ও সামাজিক নিরাপত্তার সহ সকল ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটে।

শিল্পায়নের কারণঃ শিল্পায়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:

১। জনসংখ্যা বৃদ্ধি: জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে চাপ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ইত্যাদির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই চাহিদা পূরণের জন্য শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

২। প্রযুক্তির উন্নয়ন: প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে শিল্পায়ন সহজতর হয়। নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন শিল্পায়নের জন্য নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে।

৩। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে শিল্পায়নের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলিতে শিল্পায়নের হার বেশি থাকে।

৪। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিনিয়োগকারীরা শিল্পায়নে বিনিয়োগ অনিচ্ছা প্রকাশ করে।

৫। সরকারি নীতি: সরকারের নীতি শিল্পায়নের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। শিল্পায়নকে উৎসাহিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের নীতি গ্রহণ কারে।

আরো পড়ুনঃ নারীর ক্ষমতায়ন বলতে কি বুঝ? নারীর ক্ষমতায়নে বাধা এবং করণীয় সমূহ আলোচনা করো। 

৬। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবণতা: বিশ্ব অর্থনীতির প্রবণতা শিল্পায়নের উপর প্রভাব ফেলে। বিশ্ব অর্থনীতিতে রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে শিল্পায়নের হার বৃদ্ধি পায়।

৭। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শিল্পায়নের উপর প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুযোগ বৃদ্ধির ফলে শিল্পায়নের হার বৃদ্ধি পায়।

৮। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা: আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা শিল্পায়নের উপর প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য দেশগুলিকে শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।

উপসংহারঃ শিল্পায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যা একটি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে শিল্পায়ন একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। শিল্পায়ন অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।তাই আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে শিল্পায়নকে তরান্বিত করা উচিৎ।

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *