প্রশ্নঃ আইনের সংজ্ঞা দাও। আইনের উৎসগুলো আলোচনা কর। অথবা, আইন কী? আইনের উৎসসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: সাধারণ অর্থে আইন হলো মানুষের চলাফেরার ক্ষেত্রে আবশ্যক কিছু নিয়মকানুন। আইন হলো এমন কিছু কঠোর নিয়ম বা রীতির সমষ্টি যাকে নাগরিক বাধ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করতে ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকরী করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আইন লিখিত হয়। তবে কখনো কখনো প্রচলিত বিধি-বিধানকেও আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য অলিখিত আইন মানার জন্য সরকারিভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাউকে বাধ্য করা যায় না; কিন্তু সামাজিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
আইন শব্দের উৎপত্তি: ‘আইন’ হলো একটি ফারসি বা পারসিয়ান শব্দ এবং বিশেষ্য। ‘আইন’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো- সরকারি বিধি; বিধান; কানুন; নিয়মাবলি যা দেশের সমস্ত মানুষ মেনে চলে বা মানতে বাধ্য। ফারসি শব্দ থেকে আগত এবং বাংল অভিধানে ঠাঁই পাওয়া ‘আইন’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ল (Law)। এই ল (Law) শব্দের আগমন ঘটেছে ল্যাগ (Lag) নামক অন্য এক শব্দ থেকে, যার আভিধানিক অর্থ হলো স্থির ও অপরিবর্তনীয় যা সবার ক্ষেত্রে সমানভানে প্রযোজ্য।
আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর
আইনের সংজ্ঞা: আইন সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের অভিমত দিয়েছেন। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো-
৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেন, “পক্ষপাতহীন যুক্তিই হচ্ছে আইন।”
আইনবিদ জন অস্টিনের মতে, “সার্বভৌম শক্তির আদেশই হলো আইন।”
অধ্যাপক হল্যান্ড-এর মতে, “আইন হলো মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের এমন কতগুলো সাধারণ নিয়ম যা সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত হয়।”
অধ্যাপক গ্যাটেল এর মতে, “রাষ্ট্র যে সকল নিয়ম-কানুন তৈরী করে, অনুমোদন দেয় এবং বলবৎ করে সেগুলোকেই আইনবলা হয়।”
আইনের উৎস: আইনের বেশ কয়েকটি উৎস রয়েছে।। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো-
১. চিরাচরিত প্রথা: সব দেশের আইন ব্যবস্থার একটা বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে প্রথা। আর প্রাচীন যুগে প্রথাই ছিল তৎকালীন বিধি-নিষেধের প্রধান উৎস। অধ্যাপক হল্যান্ড এর মতে, “কোন এক সময়ে কোন ব্যক্তি কোন উদ্দেশ্য বা আকস্মিকভাবে বিশেষ রীতিনীতি সমাজে প্রবর্তন করে এবং কাল ক্রমে অন্য সকলে তা মেনে চলে। এভাবেই প্রথার উদ্ভব হয়।” যেমন- ইংল্যান্ডের সাধারণ আইন। ভারতের হিন্দু-মুসলিম আইন।
২. ধর্ম: প্রাচীন কালে ধর্ম ও আইন এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল যে, অনেক সময় কোনটি আইন, কোনটি ধর্মীয় অনুশাসন তা সুস্পষ্ট ভাবে আঁচ করা যেত না। উড্রো উইলসন বলেন যে, “আদিতে রোমান আইন কতিপয় ধর্মীয় সূত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না।” বর্তমান কালে হিন্দু ও মুসলিম আইনেও ধর্মের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।
আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?
৩. বিচারকের রায়: সর্বোচ্চ আদালতের বিচার-মীমাংসা অনেক সময় আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। বিচারপতি হোসস্ বলেন, “বিচারকগণ আইন প্রণয়ন করেন। এবং এটা তাদের এক আবশ্যিক কর্তব্য।” জনৈক আমেরিকান বিচারপতি বলেন, “বিচারপতিগণ অবশ্যই আইনপ্রণয়ন করেন এবং চিরকালই করে যাবেন।” অধ্যাপক গেটেল বলেন, “আইন প্রণেতা হিসেবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়নি, রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল প্রথার ব্যাখ্যা কর্তা ও প্রয়োগকারী হিসেবে।”
৪. আইনজ্ঞগণের ভাষ্য: বিশিষ্ট আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, পর্যালোচনাও আইনের অপর একটি উৎস। তারা প্রাচীন ও বর্তমান তথ্যাদির তুলনামূলক আলোচনা করে আইনের ব্যাখ্যা ও স্বরূপ তুলে ধরেন। যেমন- ইমাম আবু হানিফা, ইংল্যান্ডের ব্রাকস্টোন, আমেরিকার স্টোরী, কেন্ট প্রমূখ আইনজ্ঞ অন্যতম।
৫. ন্যায়নীতি: সর্বকালে এবং সর্বদেশে ন্যায়নীতি আইনের বিরাট উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। অধ্যাপক গিলিক্রাইস্টের মতে, “ন্যায়নীতির অর্থ সাম্য বা ন্যায়বিচার অথবা যেখানে আইনের বিধান ঠিকমত প্রযোজ্য হয় না সেখানে সাধারণ বুদ্ধি বা ন্যায়বোধের উপর ভিত্তি করে বিচার করা।” প্রাচীন কালে রোমের গ্রীটার ন্যায়বিচারের মাধ্যমে নতুন আইনের প্রবর্তন করতেন।
৬. আইন পরিষদ: আধুনিক কালে আইনপরিষদ আইনের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান উৎস বলে পরিগণিত হয়। ওপেন হ্যাইম জনমতকেই আইনের একমাত্র উৎস বলে বর্ণনা করেছেন। আইনসভাই জনমত, প্রথাগত বিধি-বিধান, ন্যায়নীতি প্রভৃতিকে আনুষ্ঠনিকভাবে আইনের রূপদান করে থাকে।
৭. সংবিধান: সংবিধান আইনের একটি আনুষ্ঠানিক উৎস বলে স্বীকৃত। সংবিধানেই রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন এবং বিধি বিধান লিখিতভাবে বিদ্যমান থাকে। আর সংবিধানের আইনের সাথে মিল রেখে আইনসভা আইন তৈরি করে। আর এ আইনকে বাস্তবে প্রয়োগকালে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ আরো আইনের জন্ম দেয়।
৮. আন্তর্জাতিক আইন: আন্তর্জাতিক আইনকেও বর্তমান সময়ে আইনের উৎস বলে চিহ্নিত করা হয়। তার কারণ, পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইন পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে পারস্পরিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদটি ব্যাখ্যা কর
৯. জনমত: আইনের উৎস হিসেবে জনমত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি। জনমতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো তাদের অন্যতম দায়িত্ব। আইনসভায় যে কোন আইন প্রণয়নের সময় জনমতের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়।
১০. নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রী: আধুনিককালে শাসন ব্যবস্থায় জটিলতার কারণে আইনসভা তার কর্তৃত্ব নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের নিকট অর্পণ করে। এরূপ ক্ষমতা বলে জারীকৃত ঘোষণা ও আদেশ গুলোকে ডিক্রীআইন বা প্রশাসনিক আইনও বলে।
১১. বিজ্ঞানসম্মত ভাষ্য: বিশিষ্ট আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনাও আইনের অন্যতম উৎস। তাদের মতবাদ যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সিদ্ধান্ত হিসেবে নয়। বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার স্বীকৃতিস্বরূপ একে বিচারকদের সিদ্ধান্ত বলেই গণ্য করা হয়।
১২. আইনবিদদের গ্রন্থ: বিচারকগণ কোনো মামলার বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে যদি আইন সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় পড়েন তাহলে তারা তা সমাধানের জন্য আইন-বিশারদদের বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। যা পরবর্তী সময়ে আইনে পরিণত হয়। যেমন- অধ্যাপক ডাইসি‘র ‘ল অব দ্যা কনস্টিটিউশন’ ও ব্লাকস্টোনে‘র ‘কমেনটরিজ অন দ্যা লজ অব ইংল্যান্ড’।
উপসংহার: আইনের বিভিন্ন উৎসের মধ্যে সবথেকে প্রাচীন উৎস হল, প্রচলিত প্রথা বা ঋতি নীতি। পরবর্তী কালে বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত এবং আধুনিক কালে আইন অঙ্গদের বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা ও আইন সভা আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎসে পরিণত হয়েছে।
💗💗
Superb