আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা আলোচনা কর

প্রশ্নঃ  আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা আলোচনা কর। 

earn money

অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।

অথবা, একটি দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের কি কোনো ভূমিকা রয়েছে?

অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের কার্যাবলি বর্ণনা কর।

অথবা, একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


ভূমিকা: আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই আমলাতন্ত্রের বিকাশ ও কার্যাবলি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি একটি সর্বজনীন ধারণায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সকল সরকারি ব্যবস্থাই হলো কোনো না কোনো আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নামান্তর। সাধারণত রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত কর্মচারীরা আমলা নামে পরিচিত এবং এদের দ্বারা পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থাই হলো আমলাতন্ত্র।

আমলাতন্ত্র শব্দের উৎস: আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) শব্দটি Bureau (ফরাসি): যার অর্থ ছোট ডেস্ক এবং Kratein (গ্রীক): যার অর্থ শাসন করা। সুতরাং, আমলাতন্ত্র বলতে বোঝায় অফিস দ্বারা শাসন করা। আধুনিক সময়ে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে প্রথম ধারনা দেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (১৮৬৪-১৯২০)। তিনি একটি জটিল ব্যবসা সংগঠিত করার একটি যুক্তিসঙ্গত উপায় হিসাবে আমলাতন্ত্র ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।

আমলাতন্ত্রের সংজ্ঞা: আমলাতন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের অভিমত দিয়েছেন। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো-

এফ. এম. মার্কস (F. M. Marx) এর মতে, “আমলাতন্ত্র হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের সংগঠন এবং সরকারি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে এটা একটি সাধারণ পদ্ধতি।” 

আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর

অধ্যাপক গার্নার বলেছেন, “এককথায় সরকারের সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা নির্ধারণে এবং সাধারণভাবে সরকার পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মচারীগণই আমলা নামে অভিহিত।” 

ফাইনার আমলাতন্ত্রের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলেছেন: আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মুখ্যত স্থায়ী সরকারী কর্মচারীরাই সরকারের কার্যাবলী সম্পাদন করেন।

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আমলাতন্ত্র অধ্যয়ন করেন। তার ১৯২১ সালের বই “ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটি”-তে ওয়েবার যুক্তি দিয়েছিলেন যে একটি আমলাতন্ত্র সংস্থা সবচেয়ে দক্ষ কাঠামো প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষ দক্ষতা, নিশ্চিততা, ধারাবাহিকতা এবং উদ্দেশ্যের একতা এর মূল বৈশিষ্ট্য। আমলাতন্ত্রের জনক Max Weber এর মতে, “কমবেশি প্রত্যেকটি বড় সংগঠনই আমলাতন্ত্রের নামান্তর।”

আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্র ও সরকারি প্রশাসনব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা বা কার্যাবলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বৃদ্ধির ফলে আমলাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং, উন্নয়নশীল দেশের সরকারের কার্যাবলি প্রতিক্ষেত্রে আমলাদের উপর নির্ভরশীল। নিম্নে আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা বা কার্যাবলি আলোচনা করা হলো:

১. সরকারি নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন: আমলাগণ আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকানুন এবং বিচারালয়ের সিদ্ধান্তসমূহকে কার্যক্ষেত্রে বলবৎ করেন। নীতি নির্ধারিত হয়ে গেলে এগুলোকে বাস্তবায়ন করার দায়িত্বও আমলারা গ্রহণ করে। সুতরাং, সরকারি নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন উভয় ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

২. রাজনৈতিক শাসকগণকে পরামর্শদান: রাজনৈতিক শাসকগণকে অভিজ্ঞ, কুশলী, সরকারি কর্মচারীদের উপর পরামর্শের জন্য নির্ভর করতে হয়। আর তখন আমলারাই রাজনৈতিক শাসকগণকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

৩. বিচার সংক্রান্ত কাজ: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাদের কিছু বিচার সংক্রান্ত কাজও করতে হয়। অনেক রাষ্ট্রেই এখন বিশেষ কিছু বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসা আদালতের পরিবর্তে প্রশাসনিক সংস্থাসমূহের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ভারতের শিল্প সম্পর্কিত ট্রাইবুনাল, ট্রেডকার্য রেজিস্ট্রিকরণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

৪. আইন বাস্তবায়ন: আমলাতন্ত্র কেবল আইন প্রণয়নে সাহায্য করে না, বরং আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকে বলবৎ করার ক্ষেত্রে আদেশ, নির্দেশ ও নিয়মকানুন তৈরির মাধ্যমে আমলাগণ আইনের বাস্তবায়ন করে থাকে।

৫. অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা: আমলাতন্ত্র শৃঙ্খলা বিধানের অন্যতম সংগঠন। আর একটি সংগঠন হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে শৃঙ্খলা বিধানে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৬. শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষা: আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার সর্বদা পরিবর্তনশীল। আজ একদল শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে আবার পরবর্তীতে অন্যদল ক্ষমতায় আসে। এভাবে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন হতে থাকে। অথচ এ উত্থান-পতনের মধ্যে আমলাগণ শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষা করে থাকে।

৭. বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে মধ্যস্থতা: প্রত্যেকটি দেশেই বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী থাকে। এ সকল স্বার্থগোষ্ঠীর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক কাজকর্ম নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসা। আর এ অবস্থায় আমলাগণ বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী ও সরকারের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে স্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টিতে সাহায্য করে।

৮. রাষ্ট্র ও প্রশাসন বিভাগের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি: প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের প্রশাসন বিভাগের উৎকর্ষ আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল। এ সম্পর্কে মার্কিন দার্শনিক John Dewey বলেন, “A final important function of bureaucracies is that of their own internal management.”

৯. অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে: অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছাড়া একটি দেশের রাজনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয় না। বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিময় চুক্তি ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে আমলাতন্ত্র দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

১০. পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে: বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, নীতিনির্ধারণ, চুক্তি সম্পাদন এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ ও সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

১১. সামাজিক পরিবর্তন: গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য পরিবর্তনশীল সামাজিক চাহিদা ও উপলব্ধি মেটাবার উপর নির্ভর করে। আর এ ক্ষেত্রে আমলাগণ রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যোগান দিয়ে সামাজিক পরিবর্তন কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

১২. আইন প্রণয়ন: তাই প্রত্যেক দেশেই আইনসভা শাসন বিভাগের উপর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হচ্ছে। আর এ অবস্থায় আমলাগণ অনেকাংশেই আইন প্রণয়ন করে থাকেন।

১৩. দৈনন্দিন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে: সরকারের দৈনন্দিন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অনেক। জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা থেকে শুরু করে বহির্বিশ্বের পরিস্থিতি বিবেচনা পর্যন্ত সকল কাজেই আমলাতন্ত্রের ভূমিকা লক্ষ করা যায়।

১৪. সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ: সরকারের গৃহীত নীতি ও কার্যাবলি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যাদি সরবরাহের জন্য সংবাদপত্র, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, জনসাধারণ সর্বদা আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল থাকে। সুতরাং, সংবাদ ও তথ্যাদি সরবরাহে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম।

১৫. সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধন: গণতান্ত্রিক দেশসমূহে আমলাগণ সরকারি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জনগণকে অভিহিত করে থাকে। জনগণও প্রয়োজনমত আমলাদেরকে তাদের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করে এবং সেসব সমস্যার সমাধান পেতে চায়। এভাবে আমলারা সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদটি ব্যাখ্যা কর

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সরকারি নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন, আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, জনসংযোগ সাধন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রভৃতি কল্যাণমূলক কাজ আমলারা করে থাকে।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক