প্রশ্নঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
অথবা, মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগের সূত্রপাত ঠিক কখন থেকে তা নিশ্চিত করে বলা শক্ত। এ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, মধ্যযুগের সূচনা হয় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, মধ্যযুগের সূচনা হয় খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, মধ্যযুগের সূচনা হয় খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য সমূহঃ মধ্যযুগ ছিল ইউরোপের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। এ সময়কালে ইউরোপের সমাজ ও সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্নরূপ:
১. ধর্মের প্রাধান্য: মধ্যযুগে ধর্ম ছিল মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। খ্রিস্টধর্ম ছিল মধ্যযুগের প্রধান ধর্ম এবং এ ধর্মের নীতি-আদর্শ সমাজের সকল স্তরে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মধ্যযুগে গির্জা ছিল একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর
২. সামাজিক শ্রেণীবিভাগ: মধ্যযুগে সমাজের তিনটি প্রধান শ্রেণী ছিল: পাদরি, অভিজাত ও সাধারণ মানুষ। পাদরিরা ছিলেন গির্জার সদস্য এবং তারা ধর্মীয় ও শিক্ষাগত কাজে নিয়োজিত ছিলেন। অভিজাতরা ছিলেন জমিদার ও সামরিক নেতারা। সাধারণ মানুষ ছিলেন কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী।
৩. পােপের কর্তৃত্ব বৃদ্ধিঃ পােপের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি ছিল মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ দিক। মধ্যযুগে পােপের কথাই ছিল আইন বিশেষ। পােপের প্রাধান্য যেন সমগ্র মধ্যযুগকে গ্রাস করে রেখেছিল। আধ্যাত্মিক ক্ষমতার নিকট পােপের পার্থিব ক্ষমতার অধীনতা পােপের চিন্তাধারায় লক্ষ্য করা যায়।
৪. ইসলাম ধর্মের প্রসারঃ মধ্যযুগ অন্ধকার যুগ হলেও এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের অনেক স্থানেই পবিত্র ইসলাম ধর্মের বাণী পৌঁছে এবং দলে দলে লোক দীক্ষা গ্রহণ করে। ইসলাম ধর্ম এ যুগে একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল।
৫. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: মধ্যযুগে ইউরোপের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল কৃষিভিত্তিক। কৃষকরা ছিল সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এবং তারা জমিদারদের অধীনে কাজ করত। মধ্যযুগে শিল্প ও বাণিজ্যও ছিল বিদ্যমান, তবে এগুলির গুরুত্ব ছিল তুলনামূলকভাবে কম।
আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।
৬. যাজকদের ভূমিকাঃ মধ্যযুগে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যাজকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় প্রশ্নসমূহ প্রাধান্য লাভ করে। যাজকগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতামত পেশ করতেন। তাদের অনুসিদ্ধান্তের উৎস ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতি।
৭. সাংস্কৃতিক উত্থান: মধ্যযুগে ইউরোপের সংস্কৃতিতে ব্যাপক উত্থান ঘটে। এই সময়কালে সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য ও সংগীতের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। মধ্যযুগের সাহিত্যে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব ছিল ব্যাপক। এই সময়কালে বাইবেলের বিভিন্ন গল্প ও কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম। মধ্যযুগের শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি আগ্রহ। এই সময়কালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন নির্মিত হয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ক্যাথিড্রাল। মধ্যযুগের সংগীত ছিল মূলত ধর্মীয়। এই সময়কালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সঙ্গীত রচিত হয়েছিল।
আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর
মধ্যযুগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা:
- ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতন।
- ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে শার্লামেন সম্রাট হওয়া।
- ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে পোপ লিও তৃতীয় কর্তৃক শার্লামেনকে রোমান সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
- ১০৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেড।
- ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল বিজয়।
উপসংহারঃ মধ্যযুগ ইউরোপের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়কালে ইউরোপের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য সমূহ ইউরোপের পরবর্তী ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলে।