প্রশ্নঃ নির্বাচক মন্ডলীর সংজ্ঞা দাও। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচক মন্ডলীর ভূমিকা আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী একটি অপরিহার্য অঙ্গ। অধ্যাপক গেটেলের মতে, নির্বাচকমণ্ডলী কার্যত সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও অত্যন্ত প্রভাবশালী শাখা । গণতান্ত্রিক শাসন বাবস্থায় নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও সার্বজনীন করার ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম। নির্বাচকমণ্ডলী একটি সাংবিধানিক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। যারা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নির্বাচন পরিচালনা করে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলো-
নির্বাচকমণ্ডলীঃ দেশের আইন অনুযায়ী যারা সাধারণ নির্বাচনে ভােটদানের অধিকার উপভােগ করেন সার্বিকভাবে তাদের সমষ্টিকে নির্বাচকমণ্ডলী বুঝায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে নির্বাচকমণ্ডলীর সংজ্ঞা দিয়েছেন। যথা-
JW Garner বলেন, “An electorate is the body of citizens which is most democratic states determines in the last analysis the form of government of the state and choose those who guide and direct its affairs.”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলবী বলেন, “প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হচ্ছে নির্বাচকমণ্ডলী।”
আরো পড়ুনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও ব্রিটেনের লর্ডসভার তুলনামূলক আলোচনা কর।
Lasky বলেন, “Electorate implies voters those select the representative to represent the state.”
সুতরাং নির্বাচকমণ্ডলী বলতে আইন অনুযায়ী ভােটাধিকারপ্রাপ্ত নাগরিকদের সমষ্টিকে বুঝায়, যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করে সরকার গঠনে এবং শাসন কার্য নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় ভূমিকা পালন করে।
নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা বা কার্যাবলিঃ
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হল নির্বাচকমণ্ডলী। কিন্তু বিশাল আয়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্রে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসন কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাই তারা প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে । তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন ও শাসন বিভাগীয় কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাই জনগণের আস্থা ও অনাস্থার উপরই গণতান্ত্রিক সরকারের উত্থানপতন নির্ভর করে। নিম্নে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা বা কার্যাবলি আলোচনা করা হলোঃ
১। প্রতিনিধি নির্বাচনঃ নির্বাচকমণ্ডলীর প্রধান কাজ হলো সরকার পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারে নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার সদস্যদেরকে নির্বাচিত করে। অপরদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রশাসন জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়। এভাবে নির্বাচকমণ্ডলী সরকার পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে।
২। সরকার পরিবর্তনঃ সরকার পতন এবং পরিবর্তনে নির্বাচকমণ্ডলী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থের পক্ষে কাজ করছে কি না নির্বাচকমণ্ডলী তা নিবিড় ভাবে লক্ষ করে । কোনো জনপ্রতিনিধি জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করলে নির্বাচকমণ্ডলী পরবর্তী নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের জন্য নতুন প্রতিনিধি নির্বাচন করার ক্ষমতা রাখে। এ পরিবর্তন সরকারের মেয়াদ শেষে বা মেয়াদ পূরণের পূর্বেও আন্দোলনের মাধ্যমে হতে পারে। এজন্য ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচকমণ্ডলীর চাহিদা এবং দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো কার্যকরী নীতি অবলম্বন করে থাকে ।
আরো পড়ুনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর।
৩। প্রবহমান জনমতের প্রতিফলনঃ প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচকমণ্ডলীর প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটে। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুযায়ী আইনসভা জনমতের প্রকৃত দর্পণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে যেকোনো পরিস্থিতি মোোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারি জনমত যাচাই পূর্বক যেকোনো নীতি ও কর্মসূচি পুনর্বিবেচনার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায়।
৪। গণতন্ত্রের সফল বাস্তবায়নঃ নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমের সমালোচনা করে । এ ধরনের সমালোচনা সরকারকে স্বেচ্ছাচারী হওয়া থেকে বিরত রাখে । এটি সরকারের ক্ষমতার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত করে যা গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্রে জনগণ সরকারি কাজে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এভাবে নির্বাচকমণ্ডলী গণতন্ত্রের সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫। সরকারকে নিয়ন্ত্রণঃ আধুনিক গণতন্ত্রে সরকারের অস্তিত্ব রক্ষায় নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা অনেক। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচকমণ্ডলী জনপ্রতিনিধিদেরকে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে সকাল হয়। আধুনিক প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার জনস্বার্থে কাজ করে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল যদি জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করে তাহলে নির্বাচকমণ্ডলী গণভোট, গণউদ্যোগ ও গণনির্দেশের মাধ্যমে তা রোধ করে এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রাখে।
৬। সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনে সহায়তা দানঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনে নির্বাচকমণ্ডলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মতামতের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধন করা হয়। তাই নতুন কোন সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনেরর জন্য নির্বাচকমণ্ডলীর মতামতের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
৭। সরকারের অপরিহার্য অঙ্গঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের অপরিহার্য অঙ্গ বা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। কোন কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ বিভাগ হিসেবে অবহিত করেন।
৮। সরকার ও জনগণের সেতুঃ সরকার এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের কার্যক্রম ও জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটান। এটি সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতু সৃষ্টি হয।
৯। ভোটাধিকার প্রয়োগঃ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যোগ্য, বিজ্ঞ, দক্ষ প্রার্থী নির্বাচন করা নির্বাচকমণ্ডলীর এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বিশেষ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। জনগণের এ শক্তি একমাত্র ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। সুতরাং নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটাধিকার প্রয়োগ এমন বিশেষ শক্তি, যা দ্বারা সরকারের আইন প্ৰণয়নকে প্রভাবিত করতে পারে।
১০। সরকারকে সহায়তাদানঃ সরকার কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে নির্বাচকমণ্ডলীর সহায়তা কামনা করে। সেই মুহূর্তে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারকে সহায়তা করে শাসন কাজ পরিচালনা করতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে।
১১। আইন প্রণয়নে প্রভাব বিস্তারঃ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে নির্বাচকমণ্ডলী আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তনে সরাসরি অংশগ্রহণ করে থাকে৷ তাছাড়া প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থাও নির্বাচকমণ্ডলীর চাহিদার প্রেক্ষিতেই আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার সদস্যদের নির্বাচন করে থাকে। আইনসভায় জনগণের জন্য কল্যাণকর আইন প্রণয়নের সময় নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার সদস্যদেরকে প্রভাবিত করতে পারে।
১২। একনায়কতন্ত্র ও দুর্নীতি রোধঃ জনমতের উপর ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। ফলে শাসনকার্যে দুর্নীতির প্রভাব অনেক অংশে কমে যায়। সাধারণত নির্বাচকমণ্ডলী সৎ, দক্ষ ও বিজ্ঞ প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে থাকেন এবং এভাবে তারা একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও দুর্নীতি রোধ করে থাকেন।
আরো পড়ুনঃ প্রথা বলতে কী বোঝো? বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা কেন মান্য করা হয়?
১৩। রাজনৈতিক দলের উপর নিয়ন্ত্রণঃ নির্বাচকমণ্ডলী রাজনৈতিক দলের উপরও প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে । নির্বাচকমণ্ডলীর মতামত বা তাদের চিন্তাধারা দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলো প্রভাবিত ও পরিচালিত হয় ।
১৪। জাতীয় সমস্যার সমাধানঃ রাষ্ট্রে যেকোনো ধরনের জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি হলে সেই সমস্যা সমাধানে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের সাথে এক হয়ে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকে চাপের মুখে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
১৫। জনমত গঠনঃ নির্বাচকমণ্ডলী তাদের ভোটাধিকার প্রদান করে।পাশাপাশি রাষ্ট্রের অন্যান্য জনগণকে ভোট দানে উৎসাহিত করে। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও যোগাযোগের মাধ্যমে কোন সরকারের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান করে। তাই নির্বাচকমণ্ডলীকে জনমতের ব্যারোমিটার বলা হয়।
উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রণয়ন করাই হচ্ছে নির্বাচকমণ্ডলীর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী সক্রিয় শক্তি হিসেবে দলের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবকে দূরীভূত করে । পাশাপাশি। সরকারকে সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়তা করে । তাই অধ্যাপক গার্নার যথার্থই বলেছেন , “অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের ধরন ও আকার পরিচালনাকারী।”