সমকালীন বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর নগরায়নের প্রভাব আলোচনা কর।
ভূমিকা: বাংলাদেশের সমাজও সাংস্কৃতির ওপর (Urbanization) বা নগরায়ণের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। নগরায়ণের দ্বি-মুখী প্রভাব রয়েছে এর ফলে একদিকে সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয় অন্যদিকে সামাজিক সমস্যারও সৃষ্টি হয়। নগরায়নের ফলে, এদেশের মানুষের জীবনধারা, পারিবারিক কাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক, সংস্কৃতি, মূল্যসেধে,প্রতিনিয়ত পরিবর্তন দেখা দেয়। এর ফলে যেমনি ভাবে আধুনিক জীবনযাত্রা, উন্নত সুযোগ-সুবিধা এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে,অনুরূপভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকটও প্রকট আকার ধারণ করছে।
বাংলাদেশের সমাজের উপর নগরায়ণের ইতিবাচক প্রভাব: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো;
১. কর্মসংস্থান তৈরি: নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। এতে করে মানুষের জীবিকার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। পরিকল্পিত নগরায়ন অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
২. সমাজ কাঠামো পরিবর্তন: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো সমাজ কাঠামোতে পরিবর্তন। এর ফলে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। কারণ নগরের মানুষ নানা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে ও নানা পেশায় জড়িত হওয়ার ফলে সমাজে নানা শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
আরো পড়ুনঃ আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ
৩. সামাজিক গতিশীলতা: সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো নগরায়ণ ও শিল্পায়ন। কেননা নগরের নানা ধরনের পেশার সুযোগ থাকায় নগরবাসীদের মধ্যে দ্রুত গতিতে অর্থ সামাজিক তথা মর্যাদাগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
৪. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে মানুষের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। কেননা, নগরবাসীরা তুলনামূলকভাবে বেশি বাস্তববাদী, গণতান্ত্রিক চেতনা এবং ব্যক্তিস্বতন্ত্র বোধের অধিকারী। দেখা যায় যে, নগরবাসীরা তুলনামূলকভাবে বেশি রাজনৈতিক চেতনার অধিকারী। আবার ধর্ম ও নিরপেক্ষতাও নগরবাসীদের মধ্যে বেশি লক্ষ করা যায়।
৫. আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশ ঘটে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বহুমুখী সংস্কৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবন-যাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
৬. আন্তর্জাতিক যোগাযোগ: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বর্হিবিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। শিল্পায়ন এবং নগরায়ণ বিশ্বায়নকে ত্বরান্বিত করে যার ফলে নানা ক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়েছে।
৭. শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রসার: নগরায়ন শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শহরাঞ্চলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এবং অনলাইন শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের ফলে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরো পড়ুনঃ গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর
নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে সামাজিক সমস্যাঃ নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো;
১. আবাসিক সমস্যাঃ নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের নগর সমাজে যতগুলো সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে আবাসিক সমস্যা অন্যতম। নগরে যারা বসবাস করে তাদের অধিকাংশের নিজস্ব বাড়ি নেই। সবাই ভাড়া বাড়িতে থাকেন। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কাছে সমস্যাটি চরম সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। আবার নগরের ভাসমান জনগোষ্ঠী রাস্তাঘাটে রাত কাটায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শহরগুলোতে জনসংখ্যা নানা কারণে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে, আবাসিক সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে।
২. বেকারত্বঃ নগরায়ণ ও শিল্পায়নের একটি বড় সমস্যা হলো বেকারত্ব। যদিও শিল্পায়িত নগর মূলত বেকার সমস্যার সমাধানে এক বিরাট ভূমিকা পালন করার কথা, তথাপি অনুন্নত বিশ্বের অনেক দেশে এর বিপরীত হয়েছে। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। অথচ আমাদের অল্প শিল্পায়িত ও অশিল্পায়িত নগর ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান নগরবাসীর কর্মসংস্থানে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
৩. অপরাধঃ নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশর নগর গুলোতে বয়স্ক ও কিশোর অপরাধ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।নগরে পকেটমার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ ,খুন প্রভৃতি অপরাধ সমূহ বেড়েই ছলছে। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই এটি দৃশ্যমান হয়।
৪. মাদকাসক্তিঃ মাদকাসক্তি এক ধরনের সামাজিক সমস্যা যা নানা ধরনের অপরাধের জন্য দায়ী। মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার অবশ্যই দ্বন্দ্বনীয় অপরাধ। বর্তমানে বাংলাদেশের নগর গুলোতে মাদকাসক্তি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ব্যর্থতা, হতাশা বা কেউবা কৌতূহলবসত নানাভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার পরিবার ও নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করছে।
আরো পড়ুনঃ যুক্তরাজ্যের আইনসভার গঠন ব্যাখ্যা কর
৫.সন্ত্রাস ও সংঘাতজনিত সমস্যাঃ নগর জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সন্ত্রাস ও সংঘাত নৃত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। প্রতিদিন পত্র-পত্র খুললেই সন্ত্রাস ও সংঘাতের খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে শিল্পকারখানায়, যানবাহনে, ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকায় এবং জনাকীর্ণ বা ব্যস্ত রাস্তাঘাটে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে থাকে।
৬. বস্তির সৃষ্টিঃ নগরে প্রয়োজনের তুলনায় আবাসস্থল কম থাকায় অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশ বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপক হারে বস্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় দেশের নিম্ন আয়েরের লোকেরা খরচ কমাতে বস্তিতে বসবাস শুরু করে ফলশ্রুতিতে মাত্রা অতিরিক্ত বস্তির সৃষ্টি হয়। এতে শহরগুলোতে দূষণ, যানজট, বন উজাড়, পানি সংকট, এবং বায়ুদূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
৭. সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধিঃ উন্নয়নশীল দেশে অতি নগরায়নের ফলে সামাজিক বৈষম্য ও অসমতা বৃদ্ধি পায়। কেননা গ্রাম থেকে আগত অশিক্ষিত, দারিদ্র জনগোষ্ঠীকে শোষণ করার কারণে শিল্প কলকারখানার মালিকেরা ক্রমশ ধনী হচ্ছে এবং বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছে। পক্ষান্তরে শ্রমিক শ্রেণী নামমাত্র শ্রমের বিনিময় কাজ করছে এবং মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
৮. পরিবহন ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততাঃ প্রয়োজনের তুলনায় কম যানবাহনের ফলে পরিবহন জনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়। পরিকল্পনাহীন নগরায়নের ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বের নগর গুলোতে পরিবহনের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা যায়। এর কারণে সড়ক দুর্ঘটনার নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু লোকের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করছে।
৯. পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তনঃ নগরায়নের ফলে বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের সংখ্যা কমে একক পরিবার বেড়েছে। একসময় গ্রামীণ সমাজে বড় যৌথ পরিবারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ছিল। কিন্তু নগর জীবনের ব্যস্ততা, ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস, এবং চাকরি বা শিক্ষার প্রয়োজনে শহরে চলে আসার ফলে যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ভেঙে পড়ছে। ফলে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে, প্রবীণরা সামাজিকভাবে একাকীত্বে ভুগছেন, এবং পারিবারিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ পরিবর্তিত হচ্ছে।
আরো পড়ুনঃ গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর
উপসংহার: বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর নগরায়নের ব্যাপক ও বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। আমাদের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। এ প্রভাব ইতিবাচক হতে পারে, আবার নেতিবাচকও হতে পারে। পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন, সুষম কর্মসংস্থান, সামাজিক নৈতিকতার উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে নগরায়নের পুরোপুরি সুফল অর্জন করা সম্ভব।