বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে নগরায়ন ও  শিল্পায়নের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা সমূহ

 প্রশ্নঃ বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে নগরায়ন ও  শিল্পায়নের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা সমূহ আলোচনা করুন।

earn money

ভূমিকা; বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ যেখানে নগরায়ন ও শিল্পায়ন দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই দুটি প্রক্রিয়া সমাজ ও সংস্কৃতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।নিম্নে বাংলাদেশের সমাজ ও  সংস্কৃতিতে নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রভাব এবং   প্রতিবন্ধকতা সমূহ আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে নগরায়নের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা সমূহ

নগরায়নঃ কোনো একটি স্থানে নগর সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে নগরায়ন (urbanization) বলে। অর্থাৎ, নগরায়ন গ্রামাঞ্চল থেকে শহুরে অঞ্চলে জনসংখ্যার স্থানান্তর, গ্রামের তুলনায় নগর অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি এবং সমাজের উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে। 

আরো পড়ুনঃ  বাংলাদেশের সুশাসনের সমস্যাবলি ব্যাখ্যা করুন

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


নগরায়নের  প্রভাবঃ বাংলাদেশ সম্প্রতি নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উপনিত হয়েছে। দেশে অনেক নতুন প্রকল্প, মেগা প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে। সে সাথে দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে। নগরায়নের প্রভাব নিম্নরূপঃ

জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি:  নগরায়নের ফলে অনেক মানুষ গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে।  গ্রাম থেকে শহরে জনসংখ্যার স্থানান্তরণের ফলে শহরগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।

জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন: নগরায়ন সমাজস্ত মানুষের জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। গ্রামের মানুষের মধ্যে শহরে বসবাসের ফলে গ্রামীণ জীবনধারার পরিবর্তে শহুরে জীবনধারার প্রসার ঘটে।

পরিবার কাঠামো পরিবর্তন: বর্তমান সময়ে নগরায়নের   সাথে সাথে শহর বা গ্রাম সর্বক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের পরিবর্তে একক পরিবারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: নগরায়ন বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটে  ঘটাতে সহায়তা করে। এতে করে এক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফলে   নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব হয়।

অর্থনৈতিক প্রভাব:  নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টির জন্য নবরণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ চাকমা ও গারো এথনিক গোষ্ঠীর জীবনধারা আলোচনা কর। 

পরিবেশগত প্রভাব: নগরায়নের ফলে  শহরে  স্বল্প স্থানে অধিক মানুষ বসবাস করে। তাই  শহরের বায়ু এবং পানি দূষণ অধিক  মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যা বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। 

নগরায়নের প্রতিবন্ধকতা  সমূহ

কাঠামোগত ঘাটতি:  শহরগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাসস্থান, পরিবহন, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, এবং অন্যান্য মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে।

বেকারত্ব বৃদ্ধি: অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য গ্রাম থেকে অনেক  অশিক্ষিত ও অদক্ষ ব্যক্তিগত শহরে আসে কিন্তু পর্যাপ্তকর্মসংস্থান না থাকায় নগরায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

অপরাধ বৃদ্ধি: নগরায়নের ফলে গ্রাম থেকে আসা মানুষ শহরগুলোতে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, এবং অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে  নগরায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি: ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পায়।

পরিবেশগত ঝুঁকি বৃদ্ধি: বন্যা, জলাবদ্ধতা, এবং দূষণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

 অপরিকল্পিত নগরাণের ফলে শহরবাসীর জন্য শিক্ষা, চিকিৎসার সুবিধা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা দুরুহ ব্যাপার। পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে।

বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে  শিল্পায়নের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা সমূহ

শিল্পায়ন হলো একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যাতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে শিল্পের উৎপাদন, বিকাশ এবং বিস্তার। শিল্পায়ন অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের রেমিটেন্স এর গুরুত্ব

শিল্পায়নের পরিচয়: শিল্পায়ন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Industrialization’। যা ল্যাটিন শব্দ Industria হতে উৎপন্ন হয়েছে। আর Industria শব্দের অর্থ হলো কর্মকাণ্ড বা উদ্যোগ। বৃহৎ অর্থে কোনো খাতে বৃহৎ যান্ত্রিক উৎপাদন সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে শিল্পায়ন বলা হয়।

বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রভাব

বর্তমানে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। শিল্পায়ন এই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সামাজিক পরিবর্তনে এর প্রভাব অনেকটা তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রভাব নিম্নরূপ:

১। কর্মসংস্থান সৃষ্টি: শিল্পায়নের ফলে নতুন নতুন শিল্পের বিকাশ ঘটে। এর ফলে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়। এতে গ্রামীণ সমাজ থেকে আগত ব্যক্তিবর্গ কাজের সুযোগ পায়। নিজেদেরকে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেতেও নগর জীবন অধিকতর সহায়ক।

২। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি:  শিল্পায়নের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়াতে যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।

৩। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি:  শিল্পায়নের ফলে শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন অনেকাংশে বেড়ে যায়  যার ফলশ্রুতিতে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়।

৪। সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন: শিল্পায়নের ফলে সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন আসে । তাছাড়া নগরে বিভিন্ন বিষয়ে বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা থাকায় সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ শহরে ভীড় জমায়। শিল্পায়নের ফলে এর ফলে সমাজের শ্রেণি কাঠামোয় পরিবর্তন  সাধিত হয়। এ প্রেক্ষিতে সমাজ কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন সাধিত হয়।

৫।পেশাগত বৈচিত্র: শিল্পায়নের ফলে সমাজে পেশাগত বৈচিত্র দেখা যায়।  সমাজে নানা পেশার মানুষ তারা তাদের পূর্বের পেশা পরিবর্তন করে নতুন পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় এতে করে মানুষের মধ্যে পেশাগত বৈচিত্র উপলক্ষিত হয়।

 ৬। সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন পেশার সুযোগ থাকায় গ্রাম ও নগরবাসীদের মধ্যে দ্রুত গতিতে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

 ৭। আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ: শিল্পায়নের ফলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশ ঘটে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বহুমুখী সংস্কৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবন-যাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশে শিল্পায়ন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

 ৮। গ্রামীণ জীবনে প্রভাব: গ্রামীণ সংস্কৃতি তথা গ্রামীণ জীবনের উপর নগর সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জীবনপ্রণালী যেমন- ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক আচার-প্রথা, ঐতিহ্য ইত্যাদিতে যেমন পরিবর্তন হয় তেমনি বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রেও নগরের প্রভাব গ্রামীণ জীবনের উপর গিয়ে প্রভাব বিস্তার করে।

 ৯। স্থানান্তর গমন ত্বরান্বিত হয়: শিল্পায়নের ফলে মানুস গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তরের সুযোগ পায় ।  এর ফলে উন্নয়নশিল  দেশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কর্মসংস্থানের তাগিদে  শিল্প নগরে পাড়ি জমায়। এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়।

 ১০। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ: শিল্পায়নের ফলে বর্হিবিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অনেক বৃদ্ধি পায় যা বিশ্বায়নকে ত্বরান্বিত করে। বিশ্বায়নের ফলে নানা ক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়।

আরো পড়ুনঃ কুমিল্লা মডেল কি এবং এর উদ্দেশ্য সমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা কর

 ১১। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান: শিল্পায়ন জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিবিএস এর  সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০২১ – ২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপিতেশিল্প খাতের  অবদান ৩৭.০৭ শতাংশ ২০২০ ২১ অর্থবছরে জিডিপিতে এখাতের অবদান ছিল ৩৬.০১ শতাংশ।

 ১২। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: শিল্পায়নের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি  ঘটে এতে  মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ও সামাজিক নিরাপত্তার সহ সকল ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটে।

প্রতিবন্ধকতা 

শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা পরিলক্ষিত হয় যা সমাজ সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।যেমনঃ

পরিবেশ দূষণ:   শিল্প-কারখানার অতিরিক্ত বর্জ্যের ফলে ফলে পরিবেশ দূষিত হয় যা জনজীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতি কর।

সামাজিক সমস্যা:  শ্রমিকদের মধ্যে শোষণ, নির্যাতন, এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়।

অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি:  শিল্প মালিকদের এবং শ্রমিকদের মধ্যে আয়ের ব্যবধান বৃদ্ধি পায়।

মানবসম্পদের ঘাটতি:  দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে।

অবকাঠামোগত ঘাটতি:  বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহ, এবং পরিবহনে নানারকম সমস্যা সৃষ্টি করে ।

উপসংহার: শিল্পায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যা একটি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরাণ  শহরবাসীর   শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের ব্যবস্থা ব্যাহত করে। তাই নগরায়ন ও শিল্পায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এই প্রক্রিয়াগুলোর সুফল ভোগ করার জন্য এবং এর প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবেলা করার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যাবশ্যক।

Riya Akter
Riya Akter
Hey, This is Riya Akter Setu, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক