প্লেটোর সাম্যবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর

 প্রশ্নঃ প্লেটোর সাম্যবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর। বা, প্লেটোর সাম্যবাদের প্রকারভেদ বা পদ্ধতি আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ প্লেটোর The Republic-এ আলোচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে শাসকশ্রেণীর সাম্যবাদ। শাসকের দায়িত্ব পালনকে নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে প্লেটো অভিভাবক তথা শাসক ও সৈন্যবাহিনীর জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত পরিবার বিলোপের প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাবই ‘প্লেটোর সাম্যবাদ’ নামে অভিহিত হয়েছে। প্লেটো মনে করেন, এই সাম্যবাদী ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় ঐক্যসাধন এবং সুনাগরিক গড়ে তুলতে সমর্থ হবে।

সাম্যবাদের স্বরূপঃ উদ্দেশ্য ও রাষ্ট্রের শাসন পরিচালক বা প্রভু যাতে নিঃস্বার্থভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করে জনগণের কল্যাণসাধন করতে পারে সে উদ্দেশ্যেই তিনি সাম্য ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। প্লেটো বলেন, আমাদের সর্বজনীন অভিজ্ঞতা এই শিক্ষা দেয় যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা একই হস্তে কেন্দ্রীভূত হলে শাসনব্যবস্থার দক্ষতা ও সততা গুরুতররূপে ব্যাহত হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে সমাজে দেখা দেয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অনৈক্য, কলহ ও স্বার্থপরতা, হিংসা ও দ্বেষ। ফলে রাষ্ট্রের ঐক্য বিনষ্ট হয়। অন্যপক্ষে পারিবারিক জীবনে আনে মায়ার বন্ধন, যার ফলে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কর্মস্পৃহা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর

সাম্যবাদের ধারণাঃ প্লেটো তার সাম্যবাদের ধারণা লাভ করেন গ্রীক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার সাম্যবাদী ব্যবস্থা হতে। বিশেষ করে গ্রীক নগর স্পার্টার মহিলাদের রাষ্ট্রীয় কার্যে ধার নেয়া হতো। প্লেটোর সাম্যবাদ তত্ত্ব দুভাগে বিভক্ত। যথা- (১) সম্পত্তির সাম্যবাদ ও (২) পারিবারিক সাম্যবাদ। নিম্নে উভয় প্রকার সাম্যবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-

(১) সম্পত্তির সাম্যবাদঃ প্লেটো তার সাম্যবাদ ব্যবস্থায় অভিভাবক শ্রেণীর জীবন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করার কথা ঘােষণা করেছেন। তার মতে শাসক ও দার্শনিকের সহায় সম্পত্তি, বাড়ি ঘর, আসবাবপত্র, কল কারখানা ইত্যাদি বলতে নিজস্ব কোন জিনিস থাকবে না। অপর নাগরিকের নিকট থেকে প্রাপ্ত খাদ্যই তাদের মাহিনা হবে। সমষ্টিগতভাবে এই খাদ্য তারা গ্রহণ করবে এবং তাদের কোনো ব্যক্তিগত ব্যয় থাকবে না।

(২) পারিবারিক সাম্যবাদঃ অভিভাবক শ্ৰেণীকে স্থায়ী জীবন ও স্ত্রী, পুত্র পরিজনকে বর্জন করতে হবে। পারিবারিক ইবনে তাদের কোন অধিকার থাকবে না। কারণ স্থায়ী পরিবার ব্যবস্থা আদর্শ রাষ্ট্রে ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটা বিরাট করায়। এর ফলে অভিভাবক শ্রেণীর মধ্যে ‘এটি আমার ওটি তােমার’ প্রভৃতি বিভেদ মূলকব্যবহার সৃষ্টি হবে।

প্লেটোর সাম্যবাদের বৈশিষ্ট্যঃ উপযুক্ত বিশ্লেষণে সাম্যবাদের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-

(১) সম্পত্তির সাম্যবাদঃ প্লেটোর সাম্যবাদ ব্যবস্থায় অভিভাবক শ্রেণীর কোনো প্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারবে না। তাদের ভরণপােষণের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করবে।

(২) বৈবাহিক সম্পর্ক অনুপস্থিতঃ প্লেটোর সাম্যবাদ ব্যবস্থায় অভিভাবক শ্রেণীর কোন স্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্ক থাকবে না।

আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?

(৩) সুপরিকল্পিত জন্মদান পদ্ধতিঃ সাম্যবাদ অনুযায়ী অভিভাবক শ্রেণীভুক্ত নারী-পুরুষেরা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে যৌনক্ষুধা নিবারণের জন্য একত্রে মিলিত হবে।

(৪) নারীদের মর্যাদা প্রদানঃ প্লেটোর সাম্যবাদে নারীদের মর্যাদা দান করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নারীরাও অভিভাবকের পদে আসীন হতে পারে।

প্লেটোর সাম্যবাদের সমালোচনাঃ মহান দার্শনিক প্লেটো প্রবর্তিত সাম্যবাদ ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এটিকে সমালোচনা করেছেন –

(১) ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থীঃ প্লেটোর সাম্যবাদে অভিভাবক শ্রেণীকে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু সর্বযুগে, সর্বকালে, সবদেশে মানুষের বাঁচার জন্য এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য ন্যূনতম ব্যক্তিগত সম্পত্তি আবশ্যক।

(২) গণতন্ত্রের পরিপন্থীঃ প্লেটোর সাম্যবাদ গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এখানে তিনি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যৌন মিলন প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র অভিভাবক শ্রেণীর নর-নারীর অংশগ্রহণের কথা বলেছেন। কিন্তু সৈনিক ও উৎপাদক শ্ৰেণীকে এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছে। কাজেই এটি অগণতান্ত্রিক। কেননা একই পরিবারে বাস করে কেউ খাবে, কেউ খাবে না, এটা হতে পারে না।

আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদটি ব্যাখ্যা কর

(৩) শ্রেণীভিত্তিক সংগঠনঃ প্লেটোর সাম্যবাদ শ্রেণীভিত্তিক। রাষ্ট্রের অভিভাবক শ্রেণীর জন্য এটি প্রযােজ্য, উৎপাদক শ্রেণীর জন্য নয়। অভিভাবক শ্রেণী শাসন করবে আর উৎপাদক শ্রেণী খাদ্য দান করবে। ফলে অভিভাবক শ্রেণী উৎপাদক শ্ৰেণীকে শােষণ ও নির্যাতন করে থাকে।

(৪) রাষ্ট্রতত্তের বিনাশ সাধনঃ এরিস্টটল প্লেটোর সাম্যবাদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন যে, ব্যক্তিগত মালিকানা ও দখল সমগ্র ভালোবাসার ভিত্তি। রাষ্ট্রের অতিরিক্ত ঐক্যসাধন করতে গিয়ে তিনি শুধু পরিবারই বিনষ্ট করেননি, বরং রাষ্ট্রতত্ত্বও নষ্ট করেন।

প্লেটোর সাম্যবাদের প্রকারভেদ

প্লেটো তাঁর সাম্যবাদ তত্ত্বকে ‍দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন। যথা-

ক. সম্পত্তি এবং

খ. পরিবার।

নিম্নে এগুলোর বিবরণ দেওয়া হলো-

ক. সম্পত্তি

সম্পত্তি বিষয়ক সাম্যবাদের ক্ষেত্রে প্লেটো যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন সেগুলো নিম্নরূপ:

১) প্লেটো তার সাম্যবাদ ব্যবস্থায় শাসক এবং সৈনিক শ্রেণীর জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথার বিলোপ সাধন করতে চেয়েছেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে স্বার্থান্বেষী এবং লোভী করে তোলে। মানুষ ব্যক্তিগত লোভলালসার বশবর্তী হয়ে নিজের হিতাহিত জ্ঞান ও কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে ভুলে যায়। তাই অভিভাবক শ্রেণীর কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকাই বাঞ্ছনীয়।

২) অভিভাবক শ্রেণীর কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না, এমনকি নিজস্ব বাড়িঘর ও স্থায়ী পত্নী থাকবে না। তারা বিভিন্ন নারীর সাথে অবাধে মিলিত হতে পারবে এবং এ অবাধে মেলামেশার ফলে সৃষ্ট সন্তান রাষ্ট্রীয় সন্তান হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, প্রভু শ্রেণীর যদি নিজস্ব কোন সন্তান থাকে, তাহলে তারা সন্তানের মায়ায় জড়িয়ে যাবে এবং আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে।

আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

৩) কোন ব্যক্তি প্রয়োজনাতিরিক্ত কিছু পাবে না। প্লেটোর মতে, “None should have any property of his own beyond what is absolutely necessary.” অর্থাৎ, সম্পত্তি বা সম্পদ আহরণের একমাত্র উদ্দেশ্য বেঁচে থাকা। তাই অভিভাবক শ্রেণীর বেঁচে থাকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রই স্থির করবে। তাদের নিজস্ব কোন সম্পত্তির দরকার নেই।

৪) প্লেটো বিশ্বাস করতেন, একই ব্যক্তির হাতে যদি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে, তাহলে সে শাসক স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে। তাই তিনি রাজনীতিকে অর্থনীতির থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে চেয়েছেন।

খ. পরিবার

কেবলমাত্র সম্পত্তির উৎখাত হলেই সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে না, এর জন্য পরিবারেরও বিলুপ্তির প্রয়োজন বলে প্লেটো বিশ্বাস করতেন। পরিবারকে তিনি জ্ঞানীদের অপচয়ের স্থান বলে বর্ণনা করেন। কারণ-

১) স্ত্রী ও ছেলেমেয় তথা পরিবারের প্রতি মায়া শাসক শ্রেণীকে স্বার্থপর করে তোলে। পরিবার থাকলেই নিজের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি শাসকগণ পক্ষপাতিত্ব করবে। এজন্য শাসক শ্রেণীর পরিবার না থাকাই বাঞ্ছনীয়।

২) পরিবার স্ত্রীলোকদেরকে তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধা দান করে। মেয়েরা গৃহের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে। সন্তান প্রসব ও তাদের লালনপালন ছাড়া অন্য কোন প্রকার কাজ তাদের থাকে না বললেই চলে। রাষ্ট্র এভাবে দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিকের অবদান থেকে বঞ্চিত হয়।

৩) নিয়ন্ত্রিত জন্ম ব্যবস্থার ফলে উন্নত ধরনের সন্তান উৎপাদন সম্ভব হবে। রাষ্ট্র বুদ্ধিমান লোক ও বুদ্ধিমতি মহিলা নির্ধারণ করবে। তাদের মিলনের ফলে যে সন্তানের জন্ম হবে সেও স্বাভাবিকভাবেই বুদ্ধিমান হবে। 

৪) পরিবারে যে শিক্ষা শিশুরা পায় তা অত্যন্ত সংকীর্ণ ও সংকুচিত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে তারা যে শিক্ষা পাবে সেটা হবে ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। রাষ্ট্রই তাদের শিক্ষার ভার গ্রহণ করবে। ফলে রাষ্ট্রের ঐক্য দৃঢ়তর হবে এবং সন্তান সন্ততির মধ্যেও ঐক্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে।

আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আজ হতে আড়াই হাজার বছর পূর্বে তখনকার সমাজ ও নগররাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি যে আদর্শ শােষণমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের কল্পনা করেছিলে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে তার সাম্যবাদ। তিনি সাম্যবাদকে শুধু আদর্শ রাষ্ট্রের বাস্তবায়নের জন্যই করেছিলেন, অন্যকোনো প্রেক্ষিতে নয়। যার ফলে তার চিন্তা বা বিশ্লেষণে তার সাম্যবাদ পূর্ণাঙ্গ আকার ধারণ করেনি সত্য কিন্তু তিনিই প্রথম দার্শনিক যিনি দুর্নীতিমুক্ত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্যবাদের মতো একটি অভিনব দর্শনের ভিত্তি রচনা করেছেন।

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *