প্রশ্নঃ লিঙ্গের ভিত্তিতে সামাজিক অসমতা ব্যাখ্যা করো।
ভূমিকা: প্রকৃতির অসম বণ্টন সম্পদের শ্রেণিবিভাজনে সকল মানুষ সমান হলেও সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অসমান। সামাজিক অসমতা একটি সমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। সমাজ পরিবর্তনের ধারায় এ অসমতা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম রূপ ধারণ করেছে। বিরাজমান সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন রকম অসমতা লক্ষণীয়। এ অসমতা নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন। পৃথিবীতে এমন কোনো সমাজ নেই, যেখানে সামাজিক অসমতার অস্তিত্ব নেই। সমাজে আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ও অন্যান্য দুর্লভ উপাদানের অসম বণ্টনের ফলে সৃষ্ট অসমতাই হলো সামাজিক অসমতা।
অসমতা: আভিধানিক অর্থে অসমতা বা Inequality শব্দটি Equality শব্দটির বিপরীত। যার অর্থ হচ্ছে ‘সমান হওয়া’ (State of seing equal)। তাহলে Inequality শব্দের অর্থ হচ্ছে অসমান হওয়া। আবার আকৃতি ও মাত্রা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমতার অভাবই হচ্ছে ‘অসমতা’।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সামাজিক অসমতার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের সংজ্ঞা প্রদান করা হলো:
আরো পড়ুনঃ বিশ্বায়ন কি? উন্নয়নশীল দেশ বা তৃতীয় বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা করো।
‘Encyclopedia of Sociology’ গ্রন্থে অসমতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Elmer (1981) বলেছেন, “সামাজিক অসমতা বলতে বুঝায় এমন একটি অবস্থা যেখানে সমাজের সদস্যবৃন্দ অসম পরিমাণ বা মাত্রায় সম্পদ, খ্যাতি বা ক্ষমতার অধিকারী হয়।”
“সামাজিক অসমতা উইলিয়াম পি. স্কট (Willam P. Scott) তাঁর ‘Dictionary of Sociology’ গ্রন্থে বলেন, বলতে গোষ্ঠী বা সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের কারণে অসম সুযোগ সুবিধা এবং অসম পুরস্কারের অস্তি ত্বকে বুঝায়।”
রবার্টসন (Robertson) বলেছেন, “যখন সমাজের কতিপয় লোক অন্যান্যদের তুলনায় বেশি ক্ষমতা, সম্পদ অথবা খ্যাতির অধিকারী হয় তখন সেখানে সামাজিক অসমতা বিরাজ করছে বলা চলে।
Smelser বলেন, “সামাজিক অসমতা বলতে এমন একটি অবস্থাকে বুঝায় যখন সমাজের পুরস্কারগুলোতে সবার সমান অধিকার বর্তায় না। সমাজের যা কিছু দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান বলে বিবেচিত হয় সেগুলোকেই বলা হয় পুরস্কার-আর এ সবেই থাকে অসম অধিকার।
সামাজিক বৈষম্য বা অসমতা প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান তাঁর ‘সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি’ বইয়ে (৪র্থ সংস্করণ, পৃঃ ৩৬৫) বলেছেন, “সামাজিক অসমতার অর্থ হচ্ছে মর্যাদা, ক্ষমতা, সম্পদ ইত্যাদির অসম বণ্টন।”
লিঙ্গের ভিত্তিতে সামাজিক অসমতার বিভিন্ন দিক রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
আরো পড়ুনঃ সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও। সংস্কৃতির বৈশিষ্ট ও উপাদানসমূহ আলোচনা করো।
১. শিক্ষা: মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় কম শিক্ষার সুযোগ পায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে, বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে ১৪ মিলিয়ন কম ছিল।
২. কর্মসংস্থান: মেয়েরা এবং মহিলারা পুরুষদের তুলনায় কম বেতন, কম পদোন্নতি এবং কম কর্মক্ষেত্রের সুযোগ পায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে, বিশ্বব্যাপী নারীদের বেতন পুরুষদের বেতনের প্রায় ৭৭% ছিল।
৩. রাজনীতি: নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম রাজনৈতিক ক্ষমতা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে, বিশ্বব্যাপী আইনসভায় নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ২৫.৬%।
৪. স্বাস্থ্য: নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম স্বাস্থ্যসেবা পায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে, বিশ্বব্যাপী গর্ভবতী এবং প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর হার পুরুষদের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি ছিল।
৫. সহিংসতা: নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি সহিংসতার শিকার হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে, বিশ্বব্যাপী প্রতি তিন জন নারীর মধ্যে একজনের জীবনে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
লিঙ্গের ভিত্তিতে সামাজিক অসমতার অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
১. সাংস্কৃতিক ধারণা: কিছু সংস্কৃতিতে, পুরুষদের নারীদের তুলনায় বেশি মূল্য দেওয়া হয়। এই ধারণাগুলি লিঙ্গ বৈষম্যকে বৈধতা দেয়।
আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
২. আইন ও নীতি: কিছু দেশে, আইন এবং নীতিগুলি লিঙ্গ বৈষম্যকে সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু দেশে, মহিলাদের সম্পত্তি বা উত্তরাধিকারের অধিকার নেই।
৩. অর্থনৈতিক অবস্থা: দরিদ্র দেশগুলিতে, লিঙ্গ বৈষম্য প্রায়শই আরও প্রকট। এর কারণ হল দরিদ্র পরিবারগুলি প্রায়শই মেয়েদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের জন্য কম সম্পদ এবং সুযোগ প্রদান করতে পারে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, জাতিবর্ণ প্রথা, শ্রেণি, বয়স ও লিঙ্গভেদে সামাজিক অসমতার সৃষ্টি করে। তবে তুলনামূলকভাবে জাতি-বর্ণ-প্রথা সামাজিক সমতার জন্য বেশি দায়ী। কেননা জাতি বর্ণের সদস্যপদ যেহেতু জন্মের দ্বারা নির্ধারিত, অন্তর্বিবাহ যার অন্যতম রীতি, তাতে জাতি-বর্ণ প্রথা সমাজে অনেকটা স্থায়ী অসমতার জন্য দায়ী।