স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

প্রশ্নঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

earn money

ভূমিকা: সাধারণ অর্থে স্বাধীনতা বলতে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো কাজ করাকে বোঝায়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা বলতে এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতাকে বোঝায় না। কারণ, সীমাহীন স্বাধীনতা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কাউকে ইচ্ছামত সবকিছু করার স্বাধীনতা দিলে সমাজে অন্যদের ক্ষতি হতে পারে, যা এক অশান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। স্বাধীনতা হলো এমন সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ, যেখানে কেউ কারও ক্ষতি না করে সকলেই নিজের অধিকার ভোগ করে। স্বাধীনতা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করে এবং অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বাধা অপসারণ করে।

স্বাধীনতা: অপরের কাজে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করে নিজের কাজ সম্পাদন করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে। স্বাধীনতা হলো অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার পরিপূর্ণভাবে ভোগ করা। সুতরাং বলা যায়, অপরের অধিকার বা কার্যাবলির ওপর হস্তক্ষেপ না করে স্ব-ইচ্ছানুসারে কার্য করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে।

অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, স্বাধীনতা বলতে এমন এক পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণকে বোঝায় যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যাক্তিসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে এই পরিবেশকে সংরক্ষণ করে।

স্বাধীনতা কি তা বোঝাতে টি এইচ গ্রিন (T. H. Green) বলেন, কোন কিছু উপভোগ ও সম্পাদন করার ক্ষমতাকে স্বাধীনতা বলে।

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর

স্বাধীনতার রক্ষাকবচ: প্রবাদ আছে “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা বেশি কঠিন”। ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে জাতীয় স্বাধীনতা, সব ধরনের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করতে হয়। জাতীয় স্বাধীনতা লাভের পর দেখা যায় অন্যান্য স্বাধীনতার সংগ্রাম বিদ্যমান। রাষ্ট্রের প্রাণ যেমন জাতীয় স্বাধীনতা, তেমনি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হল ব্যক্তি স্বাধীনতা। গণতন্ত্রই ব্যক্তিকে সর্বাধিক স্বাধীনতা দিয়ে থাকে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা করা হলো:

১. সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ঘোষণাঃ শাসনতন্ত্র জনগণের আশা-ভরসার মূর্ত প্রতীক। এতে জনগণের মৌলিক অধিকারের তালিকা স্পষ্টরূপে লিপিবদ্ধ হয় ও এদের সংরক্ষণ বা প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করা হয়। এগুলোর একটি বিশেষ মর্যাদাও থাকে। জনসাধারণ জানতে পারে তাদের অধিকার কি কি। নির্দিষ্ট অধিকার ভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিকার বিধানের প্রচেষ্টা অনির্দিষ্ট স্বাধীনতার ব্যাঘাতের অভিযোগে আন্দোলন অপেক্ষা অনেক বেশি কার্যকর।

২. আইনঃ আইন হচ্ছে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত ও রক্ষক। আইন আছে বলেই স্বাধীনতা ভোগ করা সম্ভব হয়। আইনবিহীন সমাজে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নেয়। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লকের মতে, “যেখানে আইন নেই, সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।”

৩. আইনের অনুশাসনঃ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে আইনের অনুশাসন। আইনের চোখে সবাই সমান ও কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়। ধনী-দরিদ্র, উচু-নিচু সকলেই আইনের দৃষ্টিতে সমান। আর এই আইনের অনুশাসন, স্বাধীনতাকে সংরক্ষিত রাখতে পারে। তাই লাস্কি বলেন, বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা থাকলে অধিকারের অস্তিত্ব থাকে না।

আরো পড়ুনঃ রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দাও | আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব ও ভূমিকা আলোচনা কর।

৪. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণঃ অধিকার রক্ষা করার জন্য আইন, শাসন ও বিচার বিভাগকে পরস্পর পৃথক করা আবশ্যক। এতে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মার্কিন লেখক ব্লাকস্টোনের মতে, ক্ষমতা একত্রীকরণ স্বৈরাচারেরই নামান্তর। এতে অধিকার ক্ষুন্ন হয়।

৫. দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থাঃ স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হলো দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ তার কার্যাবলির জন্য আইন সভার নিকট দায়ী থাকে। এছাড়া বিরোধী দলের অস্তিত্বের জন্য সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষিত হয়। Ivor Jennings বলেন, দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা, যেখানে বিরোধী দল সরকারকে সমালোচনা করতে পারে, সেখানে স্বাধীনতা অব্যাহত থাকে।

৬. বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতাঃ এটা স্বাধীনতা সংরক্ষণের অন্যতম প্রধান রক্ষাকবচ। স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত রাখতে হবে।বিচার বিভাগ স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকলে কোন নাগরিকের অধিকার ক্ষুন্ন হলে আদালত তার প্রতিকারের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

৭. নাগরিকদের সতর্কতাঃ নাগরিকদের চেতনাবোধ ও সতর্কতা অধিকারের শ্রেষ্ঠতম রক্ষাকবচ। নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকারকে সুরক্ষিত করার জন্য নাগরিকদের সংগ্রাম করতে হবে। স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকা প্রয়ােজন। লর্ড ব্রাইমের ভাষায়, সদা সতর্ক থাকাই হচ্ছে স্বাধীনতার মূল্য।

৮. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণঃ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক সংস্থাগুলোকে আঞ্চলিক বিষয়ে ক্ষমতা প্রদান করতে হবে ও এদেরকে কেন্দ্রের দৌরাত্ম্য হতে মুক্ত রেখে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে কেন্দ্রের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে নাগরিকদের স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করতে হবে।

৯. গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাঃ এ ব্যবস্থায় জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়। গণ উদ্যোগ, গণভোট, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগ করে শাসকচক্রের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে স্বাধীনতা রক্ষা পায়। যেহেতু সাম্য ও স্বাধীনতা গণতন্ত্রের ভিত্তি সেহেতু গণতন্ত্রকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ করা যায়।

আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

১০. সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থাঃ সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থা স্বাধীনতার অন্যতম একটি রক্ষাকবচ। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের কার্যাবলীর প্রতি তীক্ষ দৃষ্টি রাখে ও জনস্বার্থ বিরোধী কাজের তীব্র সমালোচনা করে জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করে।

১১. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা: রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক কাঠামো স্বাধীনতা রক্ষা করার একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। নির্বাচন, পদগ্রহন ও পদচ্যুতি, প্রশাসন পরিচালনা, স্বায়ত্তশাসন – ইত্যাদি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কাঠামো বলবৎ থাকলে জনগণ সরাসরি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অংশগ্রহন করতে পারে এবং নিজেদের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে পারে। 

১২. সর্বজনীন শিক্ষা: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বজনীন শিক্ষাকে স্বাধীনতা রক্ষার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসাবে মনে করা হয়। শিক্ষিত ও সচেতন জনগণ নিজেদের অদিকারগুলি সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন এবং স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সমাজে শিক্ষার অভাব স্বাধীনতাকে খর্ব করে।

১৩. সংবিধান মান্যতা: সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনগণের অধিকারের দলিল। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা হলে জনগণের স্বাধীনতা সহজেই নিশ্চিত হয়। যেমন, বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে জনগণের অনেক অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সরকার যদি সংবিধান মান্য করে তাহলে স্বাধীনতা খর্ব হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না।

১৪. সুশাসন: সুশাসন স্বাধীনতা রক্ষার অন্যতম কবচ। সুশাসন হল নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রযন্ত্রের সুষ্ঠু পরিচালনা। রাষ্ট্রে সুশাসন থাকলে স্বাধীনতা রক্ষা করায় নাগরিককে খুব বেশি বিচলিত হতে হয় না।

উপসংহার: স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গুলোর সকল উপাদানই স্বাধীনতা সংরক্ষণে বিরাট ভূমিকা রাখে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল স্বাধীনতা সংরক্ষণ করতে হলে নিজেদের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিজেদের সতর্ক থাকতে হবে। ল্যাস্কি, ঠিকই বলেছেন, সদা সতর্কতাই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য এবং জনগণের সাহসিকতার মধ্যেই ইহার সাফল্য নিহিত। ল্যাস্কি আরও বলেন, “In democratic state liberty is the most essential thing for human rights.”

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক