নারী শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার ভূমিকা বর্ণনা কর।

নারী শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার ভূমিকা বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সমাজ সংস্কারক, নারীবাদী চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক সাহিত্যিক। তিনি তার সাহিত্যকর্ম ও সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারী শিক্ষার প্রসার, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার কর্ম ও চিন্তাধারা বাংলার নারী সমাজের জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি নারী শিক্ষা এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে  গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

১. নারী শিক্ষা বিস্তারে বেগম রোকেয়ার অবদানঃ নারী শিক্ষা প্রসারে বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টা তৎকালীন নারী সমাজের জন্য  আশার আলো হিসেবে কাজ করেনিম্নে নারী শিক্ষার ব্যাপারে তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো উপস্থাপন করা হলো। 

নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রচার: বেগম রোকেয়া বিশ্বাস করতেন, নারীদের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ শিক্ষার অভাব। তিনি তার লেখায় নারী শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন বর্ণনা করে, নশিক্ষার মাধ্যমেই নারীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে পারবে।

২. প্রতিষ্ঠান গঠন: নারী শিক্ষা বিস্তারে বেগম রোকেয়া ১৯১১ সালে কলকাতায় ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল মুসলিম মেয়েদের জন্য একটি অগ্রণী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই বিদ্যালয়টি মুসলিম মেয়েদের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে। চারিদিকে নারী শিক্ষার বিরোধী ব্যক্তিবর্গ থাকার পরেও সেই সময়ে মেয়েদের জন্য এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং কষ্টসাধ্য  কাজ ছিল। তার উদ্যোগে মেয়েরা তাদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে স্বাবলম্বী হতে শুরু করে। 

৩. আধুনিক শিক্ষার প্রচলন: তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও বাংলা, ইংরেজি এবং গণিত শেখানো হতো। মেয়েদের জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানে সক্ষম হওয়ার জন্য বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা প্রদান প্রদান করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 

৪. বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা: বেগম রোকেয়া আর্থিকভাবে অসচ্ছল মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। এতে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

৫. নারীবাদী সাহিত্যে শিক্ষা প্রসার: বেগম রোকেয়া কর্তৃক রচিত উপন্যাস মতিচূরসুলতানার স্বপ্ন, নারীর শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। বিশেষত, সুলতানার স্বপ্ন-এ তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে শিক্ষার মাধ্যমে নারীরা একটি উন্নত সমাজ গঠন করতে পারে। 

৬. শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ: তিনি মুসলিম মেয়েদের বিরুদ্ধে থাকা ধর্মীয় এবং সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে দৃঢ় প্রচারণা চালান।  তিনি ছিলেন মেয়েদের ঘরে আবদ্ধ রাখার বিরুদ্ধে।

সমাজ সংস্কারে অবদান

৭. নারীর সামাজিক মুক্তি: বেগম রোকেয়া সর্বদা  অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। অবরোধ-বাসিনী’ (১৯৩১) গ্রন্থে অবরোধপ্রথার তীব্র সমালোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি বলেন নারী সমাজের অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হল অবরোধ। তিনি নারীদের অবরুদ্ধ জীবন থেকে বের করে আনতে আজীবন সংগ্রাম করেন। 

৮. নারীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন: তিনি আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মুসলিম মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং অধিকার আদায়ে কাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৯. বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই: রোকেয়া নারীদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈষম্য এবং শোষণের প্রতিবাদ করেন। তিনি নারীদের আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে তুলতে উদ্যোগীএবং সচেষ্ট ভূমিকা অব্যাহত রাখেন।

১০. অলঙ্কারের বিরুদ্ধে মত: – নারীদের অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি নারীদের আত্মমর্যাদা জাগ্রত করতে অলঙ্কারের ব্যবহার পরিত্যাগের আহ্বান জানান।

১১. নারী-পুরুষ সমতার প্রচার: – রোকেয়া  মনে করেন, নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। পুরুষের ন্যায় নারীরাও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের সমান অধিকার থাকা উচিত। 

১২. শিক্ষা ও পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা: তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীরা শিক্ষিত হলে নিজের পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পাবে। এতে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে হবে।  তিনি তার ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৪) উপন্যাসে তিনি নারীদের আত্মনির্ভরশীলতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। 

১৩. গণজাগরণমূলক বক্তৃতা: তিনি বিভিন্ন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে নারীদের শিক্ষার গুরুত্ব এবং সামাজিক মুক্তি বিষয়ে বক্তৃতা দেন। ১৯২৬ সালে নারীদের শিক্ষা সংক্রান্ত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

১৪. ধর্মের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে অবস্থান: রোকেয়া তার  লেখনির মাধ্যমে দেখিয়েছেন, ধর্মকে কিভাবে  নারীদের প্রতি শোষণমূলকভাবে ব্যবহার করা হয় সেটি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি নারীদের শিক্ষার মাধ্যমে এই শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার আহ্বান জানান। 

১৫. বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসার: বেগম রোকেয়া সাহিত্য কর্ম সমূহ বিজ্ঞানচিন্তায় প্রভাবিত ছিল। তিনি মেয়েদের বিজ্ঞানমনস্ক হতে উৎসাহিত করেন এবং শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।

১৬. নারীর আর্থিক স্বাধীনতা: নারীরা যাতে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী থাকে বেগম রকেয়া সে বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি নারীদের জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন এবং সে বিষয়ে আজীবন সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। 

১৭. নারীর ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ: তিনি নারীদের শুধু গৃহিণীর ভূমিকায় সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানান।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, নারী শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়া যে অবদান রেখেছেন তা বাংলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক। তার প্রচেষ্টার ফলে মুসলিম মেয়েরা ধীরে ধীরে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে শুরু করে। তার আজও প্রাসঙ্গিক এবং  নারী শিক্ষা বেগম রোকেয়ার আদর্শ, শিক্ষা, কর্ম এবং নারী অধিকার আদায়ের তার প্রচেষ্টা শুধু  অবহেলিত নারী সমাজ নয় যুগে যুগে সকল সুবিধা বঞ্চিত মানুষের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তার গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ বাঙালি নারীদের সামাজিক, রাজনৈতি্‌ অর্থনৈতিক উন্নতিসহ সার্বিক উন্নয়নে প্রেরণা জোগায়। 

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *