সার্বভৌমত্ব কাকে বলে? সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণাটি লিখ

প্রশ্নঃ সার্বভৌমত্ব কাকে বলে? সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণাটি লিখ।

earn money

ভূমিকা: রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ উপাদান হলো সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত, অবাধ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী না হলে কোনো দেশ রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হয় না। জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার থাকলেই তাকে রাষ্ট্র বলা যায় না। বরং সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতা বিদ্যমান থাকলেই রাষ্ট্র বলে পরিগণিত হয়। 

সার্বভৌমত্বের প্রামাণ্য সংঙ্গা: বিভিন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সার্বভৌমত্বের সংঙ্গা দিয়েছেন। যেমন-

মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অর্ধাপক বার্জেস (Prof.Burgess) এর মতে, সার্বভৌমিকতা হলো সকল প্রজা ও তাদের সকল সংগঠনের উপর আদি, নিরঙ্কুশ ও সীমাহীন ক্ষমতা।”

ব্লাকষ্টোন (Blackstone) এর মতে,” সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের চরম, অপ্রতিরোধ্য, শর্তহীন কর্তৃত্ব।” (The supreme, irresistible,absolute,uncontrollwd authority.)

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


উইলোবি (Willoughby) ভাষায়,” সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা।

সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণা আলোচনাঃ সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী মতবাদ অনুযায়ী সার্বভৌমিকতা চরম বা চুড়ান্ত, অবাধ, অসীম ও অবিভাজ্য নয়।  শুধু রাষ্ট্র হল এই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। রাষ্ট্র তার এলাকার সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর অপ্রতিহত বা চরম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে না।

ম্যাকাইভার এর মতে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেই মানুষ একাধিক সামাজিক সংগঠনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেছে। রাষ্ট্র ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পৃথক অস্তিত্ব রয়েছে। মানুষের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে এই সমস্ত সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ব্যক্তির বিকাশে সহায়তা করে। সুতরাং, রাষ্ট্র এককভাবে মানুষের ওপর কর্তৃত্ব দাবি করতে পারে না।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

গিয়ার্কে ও মেইটল্যান্ড এর মতে, সমাজের স্থায়ী সংগঠনগুলি স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠে। রাষ্ট্র এগুলিকে সৃষ্টি করেনি। তাই রাষ্ট্র যুক্তিসঙ্গতভাবে এদের উপর পুরোপুরি কর্তৃত্ব করতে পারে না। এই সংঘগুলিও রাষ্ট্রের মত সার্বভৌম।

লিন্ডসে এর মতে, বাস্তব ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের চরমত্বের ধারণার গুরুত্ব আর নেই।

ম্যাবট এর মতে, রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপর্যস্ত হবে এবং সমাজের অন্যান্য সংঘসমূহের স্বাভাবিক অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ সার্বভৌমিকতার উপরিউক্ত সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে এর নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা বৈশিষ্টগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-

i) চরম বা চুড়ান্ত নয়ঃ বহুত্ববাদীদের মতে, বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে কোনো রাষ্ট্রই চরম বা চুড়ান্ত ক্ষমতা দাবী করতে পারেনা। কারন বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্রকেই আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অনুগত্য প্রদর্শন করতে হয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বানিজ্যের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্র একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল।

ii) অবাধ নয়ঃ বহুত্ববাদীদের মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা কখনো অবাধ ক্ষমতা হতে পারেনা। কারন কোনো বাধানিষেধ না থাকলে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ স্বৈরাচারী হয়ে পড়বে। বর্তমানে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষমতা বা অধিকারের ওপর বিভিন্ন বাধানিষেধ আরোপ করা হয়।

iii) অসীম নয়ঃ বহুত্ববাদীদের মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা কখনো অসীম বা নিরন্তর হতে পারেনা। প্রতিটি দেশ বা রাষ্ট্র কখন কি পরিমান সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করবে তা সেই দেশের সংবিধান বা শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ থাকে।

iv) অবিভাজ্য নয়ঃ বহুত্ববাদীদের মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা কখনো অবিভাজ্য হতে পারেনা। কারন রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত অন্যান্য সংঘ-সমিতি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের মতই গুরুত্বপুর্ণ তাই এগুলির হাতেও সার্বভৌম ক্ষমতা ক্ষমতা থাকা উচিৎ। 

আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর

v) অহস্তান্তরযোগ্য নয়ঃ বহুত্ববাদীদের মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা অহস্তান্তরযোগ্য নয়। কারন সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত থাকলেও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসাবে সরকার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই সরকার একটি নিদিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হয়। ফলে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সার্বভৌম ক্ষমতারও হস্তান্তর ঘটে।

সমালোচনাঃ সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী ধারনা বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যেমন-

i) চরম বা চুড়ান্ত ক্ষমতাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা হল চরম বা চুড়ান্ত ক্ষমতা। কারন তা না হলে তা আর সার্বভৌম হবেনা। সার্বভৌম ক্ষমতার ওপর আর কোনো ক্ষমতা বা কর্তৃপক্ষ থাকতে পারেনা। রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত সকল ব্যাক্তি, গোষ্ঠি বা সংগঠন সার্বভৌমের নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য।

ii) অবাধ ক্ষমতাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা হল অবাধ ক্ষমতা। কারন এর ওপর কোনো বাধা-নিষেধ আরোপ করা যায়না। এমনকি প্রাকৃতিক আইন বা স্বাভাবিক আইন দ্বারাও একে নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা।

iii) অসীম ক্ষমতাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা হল রাষ্ট্রের অসীম ক্ষমতা। কারন এর কোনো সীমা বা শেষ নেই। রাষ্ট্র যতখুশি নাগরিক বা সংগঠনের ওপর এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।

iv) অবিভাজ্য ক্ষমতাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা হল অবিভাজ্য ক্ষমতা। কারন এই ক্ষমতাকে ভাগ করা যায়না। একমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এই ক্ষমতা ভোগ করে। রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত অন্যান্য কর্তৃপক্ষের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকেনা।

আরো পড়ুনঃ রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দাও | আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব ও ভূমিকা আলোচনা কর।

v) অহস্তান্তরযোগ্য ক্ষমতাঃ সার্বভৌম ক্ষমতা হল অহস্তান্তরযোগ্য ক্ষমতা। কারন এই ক্ষমতাকে এক কর্তৃপক্ষের হাত থেকে অন্য কর্তৃপক্ষের হাতে অর্পণ করা যায়না। একমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এই ক্ষমতা গ্রহন ও তার প্রয়োগ করে। 

উপসংহারঃ সার্বভৌমত্ব কোনো একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর সর্বোচ্চ ক্ষমতা নির্দেশকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। এটি রাষ্ট্রগঠনের সার্বভৌমত্বকেন্দ্রিক মতবাদের একটি মূলনীতি।এটি রাষ্ট্র গঠনের মূখ্য উপাদান।আর সার্বভৌমের আদর্শই হলো আইন।এই উপাদান ব্যতীত কোন রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক