সতীদাহ প্রথা ব্যাখ্যা কর। 

সতীদাহ প্রথা ব্যাখ্যা কর। 

ভূমিকাঃ হিন্দু সমাজে প্রচলিত এক অমানবিক প্রথা হল সতীদাহ প্রথা। বিগত এক সময় ছিল যখন এ প্রথার মাধ্যমে সদ্য বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় জীবন্ত দাহ করা হতো। এটি ছিল নারীর প্রতি চরম বৈষম্যমূলক এবং নিষ্ঠুর আচরণের জলন্ত উদাহরণ। সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও আদিমকাল থেকে শুরু করে ১৮২৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত লোমহর্ষক,অমানবিক, বর্বর এ প্রথাটি  সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ছিল। 

১. সতীদাহ প্রথাঃ ‘সতী’ থেকে সতীদাহ শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ সতীসাধ্বী বা ধর্মপরায়ণা স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর পর নারীর স্বেচ্ছায় অথবা জোরপূর্বক সহমরণে যাওয়াই হল সতীদাহ প্রথা। যদিও প্রচলিত কোন ধর্মগ্রন্থে সতীদাহের আদেশ নেই, তবুও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি অমানবিক, নিচু এবং ঘৃণিত দৃষ্টি প্রদর্শনের ফলে তৎকালীন সমাজে এই প্রথার প্রচার ও প্রসার  লাভ করেছিল।

২. সতীদাহ প্রথার ব্যাখ্যাঃ মৃত স্বামীর চিতায় চড়িয়ে বিধবা স্ত্রীকে পুড়িয়ে দেওয়ার প্রাচীন এক হিন্দু প্রথার নাম হল সতীদাহ প্রথা। নিম্নে সতীদাহ প্রথার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হল। 

৩. সতীদাহ প্রথার অর্থ: স্বামীর মৃত্যুর পর সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করাই ছিল সতীদাহ প্রথা।

উৎপত্তি: প্রথাটির সুনির্দিষ্ট উদ্ভবকাল জানা না গেলেও খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বিবরণে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

৪. পৌরাণিক ভিত্তি: দেবী সতীর আত্মাহুতির কাহিনি এবং মহাভারতের মাদ্রীর সহমরণের কাহিনি সতীদাহ প্রথার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৫. ধর্মের দোহাই: পৃথিবীতে প্রচলিত কোন ধর্মগ্রন্থে এ প্রথার সরাসরি কোনো সমর্থন নেই তবুও ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এই প্রথা প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

৬. নারী নির্যাতন: পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি শোষণমূলক আচরণ এই প্রথার  জন্ম দেয়।  আর বিধবার কান্না ঢাকতে ঢাকঢোল ও শঙ্খ বাজানোর রীতি চালু করে। 

৭. প্রচলিত কৌশল: নারীদের জোরপূর্বক, মাদক খাইয়ে বা মাথায় আঘাত করে চিতায় তোলা হতো। পালানোর চেষ্টা করলে তাদের আবার আগুনে ফেলে দেওয়া হতো।

৮. সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ: সম্পত্তি দখল এবং বিধবাদের বোঝা হিসেবে গণ্য করার মানসিকতা এই প্রথার মূল কারণ।

৯. বন্ধে প্রথম উদ্যোগ: মোগল সম্রাট শাহজাহান প্রথাটি বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাঁর নির্দেশ প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছায়নি।

১০. রামমোহন রায়ের আন্দোলন: ১৮১২ সালে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তিনি যুক্তি দেন যে এই প্রথা ধর্মগ্রন্থসম্মত নয়।

১১. আইন প্রণয়ন: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের উদ্যোগে ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন পাস করা হয়।

১২. প্রতিক্রিয়া: রক্ষণশীল হিন্দুরা আইনটির বিরোধিতা করে এবং লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করে।

১৩. প্রিভি কাউন্সিলের রায়: রামমোহনের যুক্তি প্রমাণিত হলে ১৮৩২ সালে প্রিভি কাউন্সিল আপিল খারিজ করে আইন বহাল রাখে।

১৪. প্রথার বিলুপ্তি: পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচার এবং প্রগতিশীল হিন্দুদের আন্দোলনের ফলে প্রথাটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, সতীদাহ প্রথা নারীর প্রতি সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্যের চূড়ান্ত রূপ। এ প্রথার মাধ্যমে ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়ে ছিল। এই প্রথার বিলুপ্তি  মানবতার বিজয় এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক অবিস্মরণীয় পদক্ষেপ। রাজা রামমোহন রায়ের মতো সমাজ সংস্কারকদের প্রচেষ্টা এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এর বিলুপ্তি সম্ভব হয়েছে। 

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *