রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা কর

 প্রশ্নঃ রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা কর। অথবা, রাষ্ট্র বলতে কী বুঝ? রাষ্ট্রের উপাদানগুলো আলোচনা কর।

ভূমিকা: রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা সমাজস্থ মানুষের সমগ্র জীবন প্রণালী পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা সকলেই রাষ্ট্রের সদস্য। রাষ্ট্র ছাড়া কোনো মানুষই বসবাস করতে পারে না। এজন্য এরিস্টটল বলেছেন, “মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব।” রাষ্ট্রের মধ্যে আমরা জন্মগ্রহণ করি, লালিতপালিত হই এবং মৃত্যুবরণ করি। তাই মানবজীবনে রাষ্ট্রের গুরুত্ব অপরিসীম।

রাষ্ট্রের প্রামাণ্য সংজ্ঞা: রাষ্ট্র হল এমন এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস এর মতে, ‘‘একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টিই হল রাষ্ট্র।’’

বুন্টসলি এর মতে, “কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমাজই রাষ্ট্র।”

রাষ্ট্রের উপাদান: রাষ্ট্রের উপাদানসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে-

ক. মুখ্য উপাদান (Vital Elements)

খ. গৌণ উপাদান (Auxiliary Elements)

ক. মুখ্য উপাদান (Vital Elements)

রাষ্ট্রের মুখ্য উপাদান চারটি। মুখ্য উপাদানের যে কোন একটির অভাবে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। উপাদানগুলো হলো-

  • নির্দিষ্ট ভূখণ্ড,
  • জনসমষ্টি,
  • সরকার এবং
  • সার্বভৌমত্ব।

১. জনসমষ্টি (Population): রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জনগণ। জনসমষ্টি ছাড়া রাষ্ট্রের ধারণা অসম্ভব। জনবসতিহীন দেশগুলিকে রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। জনগণের আকাঙ্খা, অবস্থান এবং ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠিত হয়। তবে রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কত হবে তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কয়েক কোটি বা কয়েক হাজার হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে চীনের জনসংখ্যা প্রায় 130 মিলিয়ন। আর পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ ভ্যাটিকান, এর জনসংখ্যা মাত্র ৭৭৮ জন।

আরো পড়ুনঃ Political Theory Suggestion Exam 2023

২. সরকার (Government): রাষ্ট্র গঠনের দ্বিতীয় উপাদান হলো সরকার। সরকার রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক স্বরূপ। রাষ্ট্র পরিচালনার ভার যাদের উপর ন্যস্ত থাকে, তাদেরকে সমষ্টিগতভাবে সরকার বলে। সরকার হলো এমন একটি সংগঠন যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, ইচ্ছা, অনিচ্ছা প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়। সরকার ব্যতীত কোনো রাষ্ট্র গঠন করা যায় না। মূলত রাষ্ট্র একটি তত্ত্বগত ধারণা, সরকার হলো রাষ্ট্রের রূপকার। অধ্যাপক গেটেল (Gettel)- এর মতে, “সরকার হলো রাষ্ট্রের একটি সংস্থা বা যন্ত্র।”

৩. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড (Definite Territory) : রাষ্ট্র একটি ভৌগোলিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এজন্য রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। রাষ্ট্রের জনগণকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে বসবাসের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সুবন্দোবস্ত করতে হয়। তবে রাষ্ট্রের সীমারেখা বা আয়তন কত হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা আইন নেই। আবার ভূখণ্ড বলতে শুধু মাটির উপরিভাগকে বুঝায় না, মাটির নিচের সম্পদ, মাটির উপরের নদী, পাহাড় পর্বত এমনকি সমুদ্রের উপকূলভাগকেও বুঝায়। সমুদ্রের জলাভূমি হতে বারো মাইল পর্যন্ত জলরাশি রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত।

৪. সার্বভৌমত্ব (Sovereignty): রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ উপাদান হলো সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত, অবাধ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী না হলে কোনো দেশ রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হয় না। জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার থাকলেই তাকে রাষ্ট্র বলা যায় না। বরং সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতা বিদ্যমান থাকলেই রাষ্ট্র বলে পরিগণিত হয়। ভারতের প্রদেশগুলোতে জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার রয়েছে কিন্তু সার্বভৌম ক্ষমতা নেই বলে সেগুলো রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত নয়। 

খ. গৌণ উপাদান (Auxiliary Elements)

উপরে উল্লিখিত উপাদানসমূহ ছাড়াও রাষ্ট্রের আরাে তিনটি গৌণ উপাদান রয়েছে। যেমন-

১. স্থায়িত্ব (Permanence): রাষ্ট্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। সরকারের পরিবর্তন হলেও রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন হয় না। 

২. স্বীকৃতি: রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি অর্জন করতে হবে। জাতিসংঘ স্বীকৃতি না দিলে, কোন রাষ্ট্র স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় না। 

৩. সাম্য: রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করলে তা ক্ষুদ্র হােক আর বৃহৎ হােক তাদের সমান অধিকার, প্রভাব ও প্রতিপত্তি অর্জনের অধিকার থাকে।

আরো পড়ুনঃ আইন কাকে বলে? আইন ও নৈতিকতার মধ্যে সম্পর্ক লিখ

৪. পূর্ণ স্বাধীনতা: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কোনো রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে এবং সন্ধি বা চুক্তি সম্পাদন করতে পারে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র মানুষের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি প্রতিষ্ঠান। তবে সরকার ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। সরকার হলো জাহাজের চালকের ন্যায়। চালকবিহীন যেমন জাহাজ চলতে পারে না, তেমনি সরকার ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। মোটকথা, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি উপাদানই গুরুত্বপূর্ণ। 

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *