আধুনিক রাষ্ট্রে শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণগুলো

আধুনিক রাষ্ট্রে শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণগুলো আলোচনা কর।

earn money

ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শাসনবিভাগের ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় শাসন বিভাগ শুধুমাত্র আইন বাস্তবায়নের ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে এটি নীতিনির্ধারণ, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, সামাজিক কল্যাণ, নিরাপত্তা, এবং কূটনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব ও নাগরিকদের প্রত্যাশার ফলে শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণসমূহ

১. কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা: একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রগুলো এখন কেবল আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নয়; বরং জনকল্যাণমূলক কাজেও ব্যাপকভাবে নিয়োজিত। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, এবং দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শাসনবিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

২. যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চাহিদা: আন্তর্জাতিক অস্থিরতা, সন্ত্রাসবাদ, এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত উদ্বেগ আধুনিক রাষ্ট্রকে সামরিক খাতে অধিক ব্যয় করতে বাধ্য করছে। প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধারণ, সামরিক বাজেট ব্যবস্থাপনা, এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের গারো উপজাতির আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা সম্পর্কে আলোচনা কর।

৩. শিল্পায়ন ও নগরায়ন: শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে পরিবেশদূষণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সমস্যা, যানজট, এবং আবাসন সংকট দেখা দিয়েছে। এগুলো সমাধানের জন্য সরকারকে নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে অধিক ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়েছে।

৪. আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব: বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, যেমন সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল গোয়েন্দাবৃত্তি, তথ্য নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ। শাসনবিভাগ এসব ক্ষেত্রেও তার ক্ষমতা বিস্তার করেছে।

৫. জরুরি অবস্থার মোকাবিলা: বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন ভূমিকম্প, বন্যা, মহামারি) ও মানবসৃষ্ট সংকট (যেমন যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা) মোকাবিলার জন্য সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করতে হয়। কোভিড-১৯ মহামারির সময় সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে, যা শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির একটি বড় উদাহরণ।

৬. অর্থনৈতিক নীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ: অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান সমস্যা, এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সরকার এখন সরাসরি অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে হস্তক্ষেপ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ, ট্যাক্স নীতি নির্ধারণ, বাণিজ্য নীতি নির্ধারণ এবং ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে সরকার তার ক্ষমতা বাড়িয়েছে।

৭. গণতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যাশা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারকে বিভিন্ন সেবামূলক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হয়। ফলে, সরকার প্রশাসনিক শক্তি ও ক্ষমতা বাড়াতে বাধ্য হয়।

আরো পড়ুনঃ চাকমা ও গারো এথনিক গোষ্ঠীর জীবনধারা আলোচনা কর। 

৮. প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি: আধুনিক প্রশাসন আগের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ও বিস্তৃত হয়েছে। প্রশাসনের মাধ্যমে শাসনবিভাগ এখন স্থানীয় পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন নতুন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর গঠন করে সরকার তার ক্ষমতা সম্প্রসারণ করছে।

৯. বৈদেশিক সম্পর্ক ও কূটনীতি: বিশ্বায়নের ফলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে শাসনবিভাগের ক্ষমতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তি, বাণিজ্য চুক্তি, এবং কূটনৈতিক আলোচনায় সরকার এখন বড় ভূমিকা পালন করছে।

১০. আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণ: সন্ত্রাসবাদ, সাইবার অপরাধ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ মোকাবিলার জন্য শাসনবিভাগের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিশেষত, ইন্টেলিজেন্স সংস্থা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতা এখন অনেক বেশি।

১১. তথ্য ও প্রচারমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন, সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র এখন মিথ্যা তথ্য ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা প্রতিরোধের জন্য মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছে।

১২. বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান: জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, অভিবাসন সমস্যা, এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সরকার এখন আন্তর্জাতিক নীতিগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। ফলে, সরকারকে বেশি ক্ষমতা প্রদান করা হচ্ছে।

১৩. বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ: বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও অনেক সময় প্রশাসন এর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। শাসনবিভাগ বিভিন্ন নীতিমালা ও আইনি কাঠামো তৈরি করে বিচার ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করে।

১৪. সরকারি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রকল্প: সরকারি অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, পরিবহন ব্যবস্থা, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রশাসনিক ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের তদারকি ও বাস্তবায়নে শাসনবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

১৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে শাসনবিভাগ বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। হরতাল, আন্দোলন দমন, সামরিক আইন জারি ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার তার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাস আলোচনা কর। 

১৬. সামাজিক সংস্কার ও মানবাধিকার: বিভিন্ন সামাজিক সংস্কার কার্যক্রম, যেমন নারীর অধিকার, শিশু অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা, এবং শ্রম আইনের বাস্তবায়নের জন্য সরকার শক্তিশালী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ফলে, সরকার ও শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

উপসংহার: আধুনিক রাষ্ট্রে শাসনবিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো জনগণের চাহিদা ও প্রত্যাশা বৃদ্ধি, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, নিরাপত্তার প্রয়োজন, এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব। যদিও শক্তিশালী শাসনবিভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়, তবে এটি যেন স্বৈরতান্ত্রিক রূপ না নেয়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। সঠিকভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রেখে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করাই একটি আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক