Sons and Lovers
সংক্ষিপ্ত জীবনী: ডি. এইচ. লরেন্স (D. H. Lawrence)
ডেভিড হার্বার্ট লরেন্স (David Herbert Lawrence) ১৮৮৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ইস্টউড, নটিংহ্যামশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার এবং সমালোচক। তাঁর পিতা ছিলেন একজন কয়লা শ্রমিক এবং মা ছিলেন প্রাক্তন শিক্ষিকা। শৈশবে পরিবারের আর্থিক কষ্ট ও শ্রমজীবী পরিবেশ লরেন্সের মানসিকতা ও সাহিত্যকর্মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। লরেন্স অল্প বয়স থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং শিক্ষকতাও করেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু পরে তিনি পুরোপুরি লেখালেখিতেই নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর লেখায় প্রকৃতি, দেহ-মন সম্পর্ক, প্রেম, যৌনতা, শিল্পবোধ, আধুনিক সভ্যতার সংকট এবং ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো বিশেষভাবে উঠে এসেছে। লরেন্সের প্রথম উপন্যাস ছিল The White Peacock (১৯১১)। কিন্তু তাঁর খ্যাতি আসে Sons and Lovers (১৯১৩) উপন্যাসের মাধ্যমে, যা আধা-আত্মজীবনীমূলক রচনা হিসেবে ধরা হয়। পরে তিনি The Rainbow (১৯১৫) এবং Women in Love (১৯২০) প্রকাশ করেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত ও বিখ্যাত রচনা হলো Lady Chatterley’s Lover (১৯২৮), যেখানে যৌনতা ও সামাজিক ভণ্ডামিকে সাহসীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বইটি দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল। প্রধান রচনাসমূহ:
- Sons and Lovers (১৯১৩)
- The Rainbow (১৯১৫)
- Women in Love (১৯২০)
- Lady Chatterley’s Lover (১৯২৮)
লরেন্স ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভা, যিনি কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, সমালোচনা ও প্রবন্ধও লিখেছেন। সমসাময়িক সমাজ তাঁর রচনাকে প্রায়ই নৈতিকতার নামে সমালোচনা করলেও পরবর্তীতে সাহিত্য সমালোচকরা তাঁর কাজকে আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তিনি জীবনের শেষদিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় ভ্রমণ ও লেখালেখি চালিয়ে যান। ১৯৩০ সালের ২ মার্চ ফ্রান্সে যক্ষ্মাজনিত কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে আজও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী, বিতর্কিত এবং নবীনচিন্তার লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়।
আরো পড়ুনঃ The Grass is Singing Bangla Summary
Key Facts
- Full Title: Sons and Lovers
- Original Title: Sons and Lovers
- Author: David Herbert Lawrence (1885–1930)
- Title of the Author: A Pioneer of Modern Psychological Realism and Human Relationships
- Prize: (No Nobel, but Lawrence is regarded as one of the most influential English novelists of the 20th century)
- Source: Inspired by Lawrence’s own early life in a Nottinghamshire mining family, his close bond with his mother, and the struggle between personal passion and family duty
- Written Time: 1912–1913
- First Published: 1913 (by Duckworth, London)
- Publisher: Duckworth & Co. (UK); Mitchell Kennerley (US)
- Genre: Psychological Novel / Bildungsroman (Coming-of-age novel) / Modernist Fiction
- Form: Prose novel (single continuous narrative, divided into two parts and 15 chapters). Part One → 6 Chapters & Part Two → 9 Chapters
- Structure: Linear narrative with symbolic imagery, psychological depth, Oedipal themes, and working-class realism
- Tone: Intense, emotional, tragic, and analytical
- Point of View: Third-person omniscient narrator (with psychological insight into characters, especially Paul Morel)
- Significance: Considered Lawrence’s masterpiece; explores family dynamics, class struggle, mother-son relationship, sexuality, and the psychological conflicts of modern individuals torn between love and duty
- Language: English
- Famous Line:
- Setting:
- Time Setting: Late 19th to early 20th century (Industrial England, Victorian-to-Edwardian transition)
- Place Setting: Nottinghamshire coal-mining town and countryside (based on Lawrence’s own birthplace, Eastwood, England)
Key Notes- বাংলায়
Oedipus Complex (ঈডিপাস কমপ্লেক্স): মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড এই তত্ত্ব দেন। ছোট ছেলে শিশুর মধ্যে মায়ের প্রতি তীব্র আবেগ ও ভালোবাসা জন্মায়। একইসাথে সে বাবাকে প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিযোগী হিসেবে দেখে। বড় হলে এই অবচেতন টানাপোড়েন তার ব্যক্তিত্ব, সম্পর্ক ও ভালোবাসাকে প্রভাবিত করে। উপন্যাসে পল মোরেল তার মা গারট্রুড মোরেল-এর প্রতি অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠ। তার মা স্বামীর (ওয়াল্টার মোরেল) প্রতি হতাশ হয়ে আবেগিকভাবে ছেলেদের, বিশেষত পলের ওপর নির্ভর করেন। পলের প্রেমজীবনে (মিরিয়াম ও ক্লারার সাথে সম্পর্ক) সে পূর্ণতা খুঁজে পায় না, কারণ তার অবচেতনে মায়ের প্রতি এক ধরনের আসক্তি তাকে বাঁধা দেয়। ফলে মা-ছেলের সম্পর্ক একদিকে স্নেহময়, অন্যদিকে অস্বাভাবিক এবং দমবন্ধ করা।
Psychological Novel (মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস): মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হলো এমন সাহিত্যকর্ম, যেখানে কাহিনির মূল কেন্দ্রবিন্দু চরিত্রদের মানসিক অবস্থা, আবেগ, চিন্তা, স্বপ্ন, দ্বন্দ্ব ও অবচেতন মন। এখানে বাইরের ঘটনার চেয়ে ভেতরের মানসিক যাত্রাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বৈশিষ্ট্য:
- চরিত্রের অন্তর্লোক (inner life) গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়।
- আবেগ, মানসিক টানাপোড়েন ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব মুখ্য বিষয়।
- স্বপ্ন, কল্পনা, স্মৃতি, অবচেতন মনকে গল্পের অঙ্গ করা হয়।
- বর্ণনায় মনোবিশ্লেষণ (psychoanalysis) বা ফ্রয়েডীয় ধারণার প্রভাব থাকে।
- বাইরের ঘটনা কম, কিন্তু চরিত্রের মনের ভেতরের লড়াই অনেক বেশি।
“Sons and Lovers” একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের চমৎকার উদাহরণ, কারণ এতে পলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, মায়ের প্রতি তার গভীর আসক্তি এবং এর ফলে তার প্রেমজীবন ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে যে প্রভাব পড়ে, তা বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
Background (বাংলা): ডি. এইচ. লরেন্সের Sons and Lovers উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে, বিশ শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সময়ে। তখন ইংরেজ সমাজে শিল্পায়ন, শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছিল। উপন্যাসটির পটভূমি নটিংহ্যামশায়ারের খনিশ্রমিক এলাকা (Eastwood), যেখানে লরেন্স নিজে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠেছিলেন। উপন্যাসে শ্রমজীবী সমাজের কঠিন বাস্তবতা, মদ্যপ স্বামী এবং অশান্ত পারিবারিক জীবনের ভেতরে নারীর সংগ্রামকে স্পষ্টভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। লরেন্স তাঁর নিজের মায়ের প্রতি গভীর আবেগ ও বাবার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যা সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছে পল মোরেল ও গারট্রুড মোরেলের চরিত্রে।
তখনকার ইংল্যান্ডে সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বিশেষ করে প্রেম ও যৌনতার বিষয়গুলোকে খোলাখুলিভাবে আলোচনার সাহসও ছিল খুবই কম। লরেন্স এই সংকীর্ণ সমাজের ভেতরেই ব্যক্তির আবেগ, মানসিক দ্বন্দ্ব এবং মা-ছেলের জটিল সম্পর্ককে উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলেন। তাই Sons and Lovers কেবল একটি পারিবারিক উপন্যাস নয়, বরং শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ইংরেজ শ্রমজীবী সমাজের এক মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তবসম্মত প্রতিচ্ছবি, যেখানে পারিবারিক সংকট, শ্রেণি-সংগ্রাম ও মানবিক আবেগ একত্রে ধরা পড়েছে।
চরিত্রসমূহ – বাংলায়
প্রধান চরিত্র (Major Characters)
- Paul Morel (নায়ক): উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সংবেদনশীল, শিল্পপ্রবণ ও জটিল মানসিকতার অধিকারী। মায়ের প্রতি অস্বাভাবিক আবেগী ঘনিষ্ঠতার (Oedipus Complex) কারণে প্রেমজীবনে পূর্ণতা খুঁজে পায় না। তার দ্বন্দ্বই উপন্যাসের মূল চালিকা শক্তি।
- Gertrude Morel (মা): শিক্ষিত, উচ্চাভিলাষী ও সংবেদনশীল নারী। স্বামী ওয়াল্টারের প্রতি হতাশ হয়ে আবেগিকভাবে ছেলেদের, বিশেষ করে পলের ওপর নির্ভর করেন। তার সঙ্গে পলের সম্পর্ক স্নেহময় হলেও দমবন্ধ করা। সমাজে নারীর অসন্তোষ, দমন এবং অপূর্ণ স্বপ্নের প্রতীক।
- Walter Morel (পিতা): কয়লাখনির শ্রমিক, রূঢ় ও মদ্যপ স্বভাবের। স্ত্রী গারট্রুডের সাথে মানসিক দূরত্ব তার পরিবারে অশান্তি আনে। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট ও সীমাবদ্ধতার প্রতীক।
- William Morel (পলের বড় ভাই): প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল যুবক, যাকে মা খুব ভালোবাসেন। তার অকাল মৃত্যু পরিবার ও বিশেষ করে গারট্রুডের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
- Miriam Leivers: আধ্যাত্মিক ও সংবেদনশীল তরুণী, যাকে পল ভালোবাসলেও মায়ের বাঁধনে আবদ্ধ থাকায় পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। সে মনের ভালোবাসার প্রতীক হলেও শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় ব্যর্থ।
- Clara Dawes: বিবাহিত কিন্তু স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন এক আবেগী নারী। পলের সাথে তার সম্পর্ক মূলত শারীরিক আকর্ষণভিত্তিক। সে পলের জীবনে মায়ের আবেগের বিপরীতে শরীরী প্রেমের প্রতীক।
গৌণ চরিত্র (Minor Characters)
- Annie Morel: পলের বোন। সে মায়ের মতো সংবেদনশীল না হলেও পরিবারে ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ।
- Arthur Morel: পলের ছোট ভাই, পরিবারের শ্রমজীবী বাস্তবতার আরেক প্রতিচ্ছবি।
- Mr. and Mrs. Leivers: মিরিয়ামের বাবা-মা, যারা গ্রামীণ, ধর্মপ্রাণ এবং ঐতিহ্যপ্রেমী।
- Baxter Dawes: ক্লারার স্বামী, রূঢ় কিন্তু কিছুটা সহনশীল। তার সঙ্গে পলের দ্বন্দ্ব উপন্যাসে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
- Mrs. Radford: ক্লারার মা, যিনি ক্লারার স্বাধীনচেতা মনোভাবকে প্রভাবিত করেন।
প্রেমের সম্পর্ক (Couples and Love Connections)
- Paul Morel ও Gertrude Morel: মা–ছেলের সম্পর্ক উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু। গারট্রুড স্বামীর ব্যর্থতা ও অশান্ত দাম্পত্য জীবন থেকে আবেগিকভাবে ছেলেদের দিকে ঝুঁকেন, বিশেষ করে পলের প্রতি। পলও মায়ের ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই ঘনিষ্ঠতা তাকে মানসিক আশ্রয় দিলেও, তার প্রেমজীবনে (মিরিয়াম ও ক্লারা) স্বাধীনতা ও পূর্ণতা আনতে বাঁধা দেয়। এটি উপন্যাসে ফ্রয়েডীয় Oedipus Complex-এর প্রতিফলন।
- Paul Morel ও Miriam Leivers: আধ্যাত্মিক টানাপোড়েনভরা সম্পর্ক। গভীর মানসিক বোঝাপড়া থাকলেও শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অভাব সম্পর্ককে ভেঙে দেয়।
- Paul Morel ও Clara Dawes: আবেগ ও শারীরিক আকর্ষণের সম্পর্ক। কিন্তু এটি স্থায়ী হয় না, কারণ পল মায়ের আবেগিক ছায়া কাটিয়ে উঠতে পারে না।
- Gertrude Morel ও Walter Morel: ভালোবাসাহীন, অশান্ত এক দাম্পত্য জীবন। পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও শ্রমজীবী সংকটের প্রতীক।
পরিবার ও আত্মীয়স্বজন (Friends and Family)
- The Morel Family: গারট্রুড (মা), ওয়াল্টার (পিতা), উইলিয়াম, পল, আর্নি ও আথার—যাদের মাধ্যমে শ্রমজীবী পরিবার ও পারিবারিক টানাপোড়েন ফুটে ওঠে।
- The Leivers Family: মিরিয়ামের পরিবার—ধর্মনিষ্ঠ, গ্রামীণ এবং ঐতিহ্যবাদী।
- The Radford Family: ক্লারার মা—মেয়ের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন।
Plot সামারি- বাংলা
গার্ট্রুডের বিয়ে ও দাম্পত্য জীবনের দ্বন্দ্ব: গার্ট্রুড কপার্ড (Gertrude Coppard) ছিলেন এক মধ্যবিত্ত ইংরেজ পরিবারের মেয়ে। তিনি ছিলেন শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী এবং উচ্চাভিলাষী। একদিন তিনি ওয়াল্টার মোরেল (Walter Morel) নামের এক কয়লাখনির শ্রমিকের সঙ্গে পরিচিত হন। ওয়াল্টারের ছিল আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তার ছিল সরল মন ও সরল হাসি, যা গার্ট্রুডকে মুগ্ধ করে। দুজনেই একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস সুখেই কাটে। কিন্তু ধীরে ধীরে গার্ট্রুড বুঝতে পারেন যে, ওয়াল্টার তেমন অর্থশালী নন, যেমনটা তিনি ভেবেছিলেন। আসলে ওয়াল্টারের নিজের কোনো বাড়িও নেই, আর উপার্জনের বড় অংশ খরচ হয়ে যায় মদে। এতে গার্ট্রুড হতাশ হন। তবুও সংসার এগিয়ে চলে, এবং তাদের প্রথম সন্তান উইলিয়াম (William) জন্ম নেয়।
মোরেল পরিবারের সূচনা ও অশান্ত পরিবেশ: কিছুদিন পর মোরেল পরিবারে দ্বিতীয় সন্তান অ্যানি (Annie) জন্ম নেয়, আর গার্ট্রুড আবারও গর্ভবতী হন। এদিকে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি বাড়তে থাকে। গার্ট্রুড একদিন উইলিয়ামকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক মেলায় যান, সেখানে তিনি স্বামীকে মদ্যপ অবস্থায় দেখতে পান। এর কিছুদিন পর ওয়াল্টার আবারও নেশা করে বাড়ি ফিরলে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। গার্ট্রুড ধীরে ধীরে স্বামীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। তিনি পরিবারকে চালিয়ে নেন মূলত সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকে। এভাবেই উপন্যাসে মোরেল পরিবারের অশান্ত দাম্পত্য জীবন, দারিদ্র্য, আর সন্তানদের বেড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
পলের জন্ম ও মা–ছেলের সম্পর্ক: মিসেস গার্ট্রুড মোরেল আবার একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় পল মোরেল (Paul Morel)। তবে শুরুতে গার্ট্রুড পলের প্রতি অপরাধবোধ অনুভব করেন, কারণ তিনি এই সন্তানকে সত্যিই চান নি। কিন্তু ধীরে ধীরে পল বড় হতে থাকলে মা ও ছেলের মধ্যে এক গভীর আবেগিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছোট থেকেই পল ছিল সংবেদনশীল, সিরিয়াস, ও অন্তর্মুখী চিন্তাধারার ছেলে। অন্যদিকে, তার বড় ভাই উইলিয়াম মোরেল (William Morel) ছিল আনন্দপ্রিয় ও বহির্মুখী। এরপর মোরেল দম্পতির আরেক ছেলে সন্তান জন্ম নেয়, নাম আর্থার মোরেল (Arthur Morel)। আর্থারকে তার বাবা ওয়াল্টার খুব স্নেহ করতেন। এভাবে মোরেল পরিবার বড় হতে থাকে।
উইলিয়ামের লন্ডনে যাওয়া ও লুইসার আগমন: বড় ছেলে উইলিয়াম কর্মজীবনে প্রবেশ করে এবং পরে ক্লার্কের চাকরি পেয়ে লন্ডনে চলে যায়। তার এই দূরে চলে যাওয়া মিসেস মোরেলকে ভীষণ কষ্ট দেয়, কারণ তিনি উইলিয়ামের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত ছিলেন। প্রথমদিকে উইলিয়াম বাড়ি এলে মাকে টাকা দিত, কিন্তু ধীরে ধীরে সে শহুরে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেয় এবং তার হবু স্ত্রী লুইসা লিলি ডেনিসন (Louisa Lily Denys Western)–এর পেছনেই সব খরচ করতে শুরু করে। একসময় উইলিয়াম লুইসাকে পরিবারে পরিচয় করানোর জন্য বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু লুইসা অভিজাত ভঙ্গিতে আচরণ করে এবং মোরেল পরিবারের সবার সঙ্গে চাকরের মতো ব্যবহার করে। এতে উইলিয়ামের মন ভেঙে যায়, এবং সে তার বাগদত্তার প্রতি হতাশ হয়।
উইলিয়ামের মৃত্যু ও পলের ওপর মায়ের নির্ভরতা: এর কিছুদিন পর উইলিয়াম নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এই মৃত্যু ছিল মোরেল পরিবারের জন্য এক ভয়াবহ আঘাত। বিশেষ করে মিসেস মোরেল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। উইলিয়ামের মৃত্যুর পর তিনি তার সমস্ত আবেগ ও আশা পলকে ঘিরে গড়ে তোলেন। এখান থেকেই মা-ছেলের সম্পর্ক আরও গভীর, কিন্তু একই সঙ্গে দমবন্ধ করা বাঁধনে পরিণত হয়। এরই মাঝে পল মোরেল ধীরে ধীরে একজন বুদ্ধিদীপ্ত ও শিল্পপ্রবণ যুবকে পরিণত হয়। সে নটিংহ্যামে গিয়ে একটি ক্লার্কের চাকরি পায় এবং কাজটি করতে আনন্দ পায়। তবে বাড়িতে মিসেস মোরেল এখনো বড় ছেলে উইলিয়ামের মৃত্যুশোকে ডুবে থাকেন। এতে পল মায়ের ভালোবাসার ঘাটতি অনুভব করে। সে চায় মা যেন তাকে আগের মতোই স্নেহ করেন।
পলের অসুস্থতা ও মা–ছেলের সম্পর্কের গভীরতা: একদিন পল নিউমোনিয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন মিসেস মোরেল বুঝতে পারেন, তিনি হয়তো উইলিয়ামের শোকে পলকে অবহেলা করেছেন। এরপর তিনি তার সমস্ত মনোযোগ ও ভালোবাসা পলের দিকে দেন। তিনি সর্বাত্মক সেবা করে পলকে সুস্থ করে তোলেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন আর কখনো অতীত নিয়ে অতিরিক্ত শোক করবেন না। এই মুহূর্ত থেকেই পল ও তার মায়ের সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে যায়। অসুস্থতা থেকে সুস্থ হওয়ার পর পল মাঝে মাঝে মি. লিভারসের (Mr. Leivers) ফার্মে যেতে থাকে। সেখানে তার পরিচয় হয় মি. লিভারসের মেয়ে মিরিয়াম লিভারস (Miriam Leivers)–এর সঙ্গে। মিরিয়াম ছিল অত্যন্ত ধার্মিক, বুদ্ধিমতী এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মেয়ে। ধীরে ধীরে পল ও মিরিয়ামের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
মিরিয়ামের আগমন ও আধ্যাত্মিক প্রেমের সূচনা: কিন্তু মিসেস মোরেল এই সম্পর্ক একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি মনে করতেন, মিরিয়াম অতিরিক্ত ধর্মপ্রবণ এবং সে পলের প্রাণশক্তি শুষে নেবে। তাই তিনি চেয়েছিলেন তাদের বন্ধুত্ব দ্রুত শেষ হোক। অন্যদিকে, মিরিয়াম বুঝতে পারে যে সে গভীরভাবে পলকে ভালোবাসে। কিন্তু তার ধর্মীয় বিশ্বাস ও লজ্জাশীলতার কারণে সে শারীরিক সম্পর্কে যেতে ভয় পায়। মিরিয়াম তার মনের অনুভূতি প্রকাশ করে না, সবকিছু চেপে রাখে নিজের ভেতরে।
পলের সাফল্য ও ক্ল্যারার প্রবেশ: এরপর পল মোরেল নটিংহ্যাম এক্সিবিশনে তার আঁকা পেইন্টিংয়ের জন্য পুরস্কার লাভ করে। এই সাফল্যে তার মা গার্ট্রুড ভীষণ গর্বিত হন। এক্সিবিশনেই পলের পরিচয় হয় মিরিয়ামের এক সঙ্গিনীর সঙ্গে, যার নাম ক্ল্যারা ডজ (Clara Dawes)। ক্ল্যারা একজন লম্বা, শক্তিশালী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী। তার বিয়ে হয়েছিল ব্যাক্সটার ডজ (Baxter Dawes) নামক এক লোহার কারিগরের সঙ্গে, যিনি পলের একই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। তবে ক্ল্যারা ও ব্যাক্সটার আলাদা থাকতেন, কারণ তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক সুখী ছিল না।
মিরিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙন ও ক্ল্যারার প্রতি আকর্ষণ: এদিকে পল ধীরে ধীরে মিরিয়ামের প্রতি বিরক্তি অনুভব করতে শুরু করে। একদিন সে মিরিয়ামকে জানায় যে মিরিয়াম অতিরিক্ত ধর্মপ্রবণ। তার এই তীব্র আধ্যাত্মিকতা তাদের মধ্যে কোনো শারীরিক প্রেম গড়ে তুলতে দিচ্ছে না। পল মনে করে, মিরিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। ঠিক এই সময়েই মিসেস মোরেল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে পল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপর একদিন মিরিয়াম পল ও ক্ল্যারাকে তার বাড়িতে চায়ের দাওয়াত দেয়। শুরুতে পল ক্ল্যারার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করত না। কিন্তু সেই দিনে ক্ল্যারার উপস্থিতি, তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস পলের কাছে নতুনভাবে ধরা দেয়। পল অনুভব করতে শুরু করে যে ক্ল্যারার প্রতি তার ভেতরে এক ধরনের আকর্ষণ জন্ম নিচ্ছে। কিছুদিন পর পল মোরেল ক্ল্যারার বাসায় একটি পার্সেল পাঠায়। এতে সে জানতে পারে, ক্ল্যারা তার মা মিসেস র্যাডফোর্ড–এর সঙ্গে থাকেন এবং তার জীবনে সুখ প্রায় নেই। পল তাকে সহায়তা করার চেষ্টা করে এবং একই ফ্যাক্টরিতে ক্ল্যারার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়।
ক্ল্যারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ব্যাক্সটার–পলের সংঘর্ষ: অন্যদিকে, সেই বছরের গ্রীষ্মকালে পল মিরিয়ামের সঙ্গে এনগেজমেন্ট করে। মিরিয়াম আশা করে এবার তাদের সম্পর্ক পূর্ণতা পাবে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পল সেই এনগেজমেন্ট ভেঙে দেয়। কারণ তখন পর্যন্ত সে ক্ল্যারার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তবুও, পল পুরোপুরি মিরিয়ামকে ছেড়ে যেতে পারে না। মাঝে মাঝে সে মিরিয়ামের কাছে ফিরে যায়, তাকে দেখে, তার সঙ্গে সময় কাটায়। এতে তার দ্বন্দ্ব আরও গভীর হয়। এদিকে ক্ল্যারার স্বামী ব্যাক্সটার ডজ (Baxter Dawes) পলের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। একদিন তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা থেকে শুরু হয় প্রচণ্ড মারামারি। ব্যাক্সটার ছিল বলিষ্ঠ ও রূঢ় প্রকৃতির, আর পল রাগে-ক্ষোভে প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই সংঘর্ষ তাদের জীবনে নতুন উত্তেজনা ও অস্থিরতা নিয়ে আসে।
মিসেস মোরেলের অসুস্থতা ও মৃত্যুর শোক: এদিকে মিসেস গার্ট্রুড মোরেলের স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হয়। চিকিৎসকেরা জানান তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। এতে পল গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় এবং মায়ের সেবায় পুরোপুরি নিজেকে নিয়োজিত করে। এই সময় পল জানতে পারে যে ব্যাক্সটার ডজ সম্প্রতি টায়ফয়েড জ্বর থেকে সেরে উঠেছে। সে হাসপাতালে গিয়ে ব্যাক্সটারকে দেখতে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে, যাদের মধ্যে আগে তীব্র বিদ্বেষ ছিল, তারা ধীরে ধীরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, কিছুদিন পর মিসেস মোরেল বাসায় ফেরত আসেন। তবে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন যে আর বেশিদিন বেঁচে থাকবেন না। তার অসুস্থতা পরিবারকে স্তব্ধ করে দেয়। এই সময় পল একই সঙ্গে মিরিয়াম লিভারস এবং ক্ল্যারা ডজ–এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। কিন্তু তার মনোযোগ আর প্রেমের দিকে যায় না। সে অনুভব করে, তাদের কারোর প্রতিই প্রকৃত আকর্ষণ নেই। তার সমস্ত ভালোবাসা ও শক্তি নিবদ্ধ হয় মায়ের সেবায়।
ক্ল্যারার ব্যাক্সটারের কাছে ফেরা ও পলের একাকিত্ব: অবশেষে, মিসেস মোরেল মারা যান। তাকে তার প্রিয় ছেলে উইলিয়ামের পাশেই কবর দেওয়া হয়। মায়ের মৃত্যু পলকে ভীষণভাবে ভেঙে দেয়। এই শোক সহ্য করতে না পেরে সে ক্রমাগত পেইনকিলার খেতে শুরু করে। পরে পল ও তার বাবা ওয়াল্টার মোরেল বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। কারণ পুরোনো বাড়ি ছিল মিসেস মোরেলের স্মৃতিতে ভরা, যা তাদের প্রতিনিয়ত কষ্ট দিত। একদিন সমুদ্র সৈকতে ব্যাক্সটার ডজ পল এবং ক্ল্যারাকে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু পল বুঝতে পারে, এখন আর তার মধ্যে ক্ল্যারার প্রতি কোনো প্রকৃত আগ্রহ নেই। কারণ তার মায়ের মৃত্যু তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। তার মাথায় কেবল আত্মহত্যার চিন্তা ঘুরপাক খায়। পল মনে করে, ক্ল্যারা আসলে আবারও তার স্বামী ব্যাক্সটারের কাছে ফিরতে চায়। তাই সে তাদের জন্য একটি কটেজের ব্যবস্থা করে দেয়। এই ঘটনাটি ক্ল্যারাকে প্রচণ্ড রাগিয়ে তোলে, কারণ এতে মনে হয় পল যেন তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তবুও ক্ল্যারা অবশেষে ব্যাক্সটারের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মিরিয়ামের শেষ প্রত্যাখ্যান ও পলের জীবনের প্রতি ফিরে আসা: এখন পলের জীবনে আর কোনো ভালোবাসা বা আশা অবশিষ্ট থাকে না। তার কাছে জীবন হয়ে ওঠে শুধু শূন্যতা ও মৃত্যুর অপেক্ষা। একদিন চার্চের বাইরে পলের দেখা হয় মিরিয়ামের সঙ্গে। সে মিরিয়ামকে তার বাড়িতে আসতে বলে। কিন্তু মিরিয়াম তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, কারণ সে মনে করে, এভাবেই পলকে রক্ষা করা যাবে। পল স্পষ্টভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয়। এতে মিরিয়াম শপথ করে যে আর কখনো পলের মুখ দেখবে না। অবশেষে পল একা অন্ধকার মাঠের মধ্যে হাঁটতে থাকে। তার মায়ের স্মৃতিগুলো মনে ঘুরে বেড়ায়। সে গভীরভাবে মৃত্যুর কথা চিন্তা করে, আত্মহত্যার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় যে সে মরবে না, বরং বাঁচবে। উপন্যাসের একেবারে শেষে, সে অন্ধকার থেকে মুখ ফিরিয়ে আলোর দিকে, শহরের দিকে হাঁটা দেয়। এই দৃশ্যটি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় জীবনের প্রতি ফিরে আসা এবং আশার ক্ষীণ আলোকরেখার।
Detailed Summary- বাংলায়
পার্ট-১, অধ্যায় ১ : মোরেল দম্পতির প্রারম্ভিক দাম্পত্য জীবন
গল্পের শুরু হয় একটি খনি শ্রমিক গ্রামকে দেখিয়ে “বেস্টউড”-এ। চারপাশে অনেক কয়লার খনি। খনি শ্রমিকরা ছোট ছোট ঘরে থাকে, যাদের বলা হয় “দ্যা বটমস”। বাইরে থেকে ঘরগুলো মোটামুটি ভালো দেখায়, কিন্তু ভেতরের জীবন সুখকর নয়। পরিবারগুলোকে থাকতে হয় ছাইভর্তি গর্ত, সরু গলি আর কোলাহলের মাঝে। মিসেস গারট্রুড মোরেল এই ঘরগুলোর একটিতে ওঠেন। তখন তার বয়স একত্রিশ বছর। তার দুটি সন্তান আছে, উইলিয়াম এবং অ্যানি। তিনি আবারও সন্তানসম্ভবা। তার স্বামী ওয়াল্টার মোরেল একজন খনি শ্রমিক। গারট্রুড বটমস একেবারেই পছন্দ করেন না, তবে এটিই তার সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে ভালো।
ওয়াল্টার মোরেল মেলা, মদ্যপান আর বাইরে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। গ্রামে ওয়েকস (মেলা)-এ তিনি টাকা উড়ান আর প্রচুর মদ খান। যদিও তিনি খনিতে কাজ করেন, তবু যা উপার্জন করেন তার চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলেন। মিসেস মোরেল একাকী বোধ করেন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। তার মনে হয় জীবন খুব কঠিন, আরেকটি সন্তান আসছে। তিনি যেন সমস্যার ভেতর চাপা পড়ছেন।
উপন্যাসে গারট্রুডের অতীত তুলে ধরা হয়। তিনি এক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে এসেছেন। তার বাবা ছিলেন গর্বিত ও কঠোর স্বভাবের মানুষ। তিনি একসময় জন ফিল্ড নামের এক যুবককে ভালোবাসতেন, কিন্তু সে অন্য কাউকে বিয়ে করে। পরে এক ক্রিসমাস পার্টিতে তার সাথে ওয়াল্টার মোরেলের দেখা হয়। ওয়াল্টার ছিল সুদর্শন, প্রাণবন্ত আর রসিক। গারট্রুড ছিলেন গম্ভীর, ধর্মপ্রাণ আর চিন্তাশীল। ওয়াল্টারের প্রাণশক্তি আর উষ্ণতায় তিনি মুগ্ধ হন। তারপর তারা বিয়ে করেন।
বিয়ের পর প্রথমে গারট্রুড সুখী ছিলেন। কয়েক মাস সবকিছু ভালোই চলল। ওয়াল্টার তখন হাসিখুশি আর যত্নবান ছিলেন। কিন্তু খুব শিগগিরই তিনি জানতে পারেন ওয়াল্টার টাকা-পয়সা নিয়ে মিথ্যা বলেছেন। তাদের ঘর আর আসবাবপত্রের মূল্য পুরোপুরি পরিশোধ করা হয়নি। অর্থাৎ ঘর আর আসবাবের দামের এখনো কিছু কিস্তি শোধ হয়নি। এমনকি ঘরটিও ওয়াল্টারের নিজের নয়, বরং তার মায়ের। এই ঘটনা গারট্রুডকে গভীরভাবে আঘাত করে। তিনি প্রতারিত বোধ করেন। তিনি এমন এক সঙ্গী চেয়েছিলেন, যে হবে গম্ভীর, ভেবেচিন্তে কথা বলবে, আর বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা শেয়ার করবে। কিন্তু ওয়াল্টার কেবল মদ, কাজ আর সাধারণ আনন্দ নিয়েই ব্যস্ত। কাঠমিস্ত্রির কাজ করতে ভালোবাসেন। তবে, তিনি স্ত্রীর গভীর চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে পারেন নি। এখান থেকেই তাদের বিবাহিত জীবনের ভাঙন শুরু হয়।
যখন তাদের ছেলে উইলিয়াম জন্ম নিল, গারট্রুড তার সমস্ত ভালোবাসা ও যত্ন সন্তানের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। ওয়াল্টার এতে ঈর্ষান্বিত হলেন। ধীরে ধীরে গারট্রুড স্বামীকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন। তার কাছে ওয়াল্টার দুর্বল, বেপরোয়া আর নীতিহীন মনে হলো। ওয়াল্টার প্রায়ই মদ খেতেন এবং টাকা নষ্ট করতেন। তিনি ঘরের চেয়ে পাবলিক হাউসে বেশি সময় কাটাতে চাইতেন। একদিন অনেক ঝগড়া হলো, যখন ওয়াল্টার সন্তানের কোঁকড়ানো চুল গারট্রুডকে না জানিয়ে কেটে ফেললেন। এতে গারট্রুড ভেঙে পড়লেন। মনে হলো তার হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। সেই মুহূর্ত থেকে তিনি আর কখনো সত্যিকারভাবে স্বামীকে ভালোবাসতে পারলেন না। তিনি শুধু সন্তানদের জন্যই বাঁচতে লাগলেন।
তাদের বিবাহিত জীবন ক্রমাগত ঝগড়া আর লড়াইয়ে ভরে উঠল। ওয়াল্টার আরও বেশি মদ খেতে লাগলেন। গারট্রুড আরও শীতল হলেন। তিনি আর স্বামীকে চাইতেন না, তবে সন্তানদের জন্য তাকে ছাড়তেও পারতেন না। তবুও তিনি লড়াই চালিয়ে গেলেন। তিনি চাইলেন ওয়াল্টার দায়িত্বশীল ও নৈতিক হোক। কিন্তু ওয়াল্টার তা মানতে রাজি ছিলেন না। তাদের জীবন হয়ে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র। গারট্রুড এখন কেবল সন্তানদের মধ্যে আশা খুঁজতে লাগলেন। তিনি সংকল্প নিলেন সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করবেন এবং তাদের একটি ভালো জীবন দেবেন। অধ্যায়টির শেষে তার সংগ্রাম, তার তিক্ততা, আর এক কঠিন বিবাহিত জীবনের বিরুদ্ধে তার নীরব শক্তি ফুটে ওঠে।
(অধ্যায় ১ এ– গারট্রুড একজন খনি শ্রমিক ওয়াল্টার মোরেলকে বিয়ে করেন, কিন্তু শিগগিরই তার মদ্যপান, মিথ্যা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় প্রতারিত বোধ করেন। তাদের দাম্পত্য জীবন তিক্ত হয়ে যায়। ভালোবাসা দ্রুত নিভে যায়। তিনি স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে সব ভালোবাসা সন্তানদের দিকে দেন।)
আরো পড়ুনঃ To The Lighthouse Bangla Summary
পার্ট-১, অধ্যায় ২ : পলের জন্ম এবং আরেকটি লড়াই
ওয়াল্টার মোরেল কয়েকদিন শান্ত ছিল শেষ ঝগড়ার পর। কিন্তু খুব শিগগিরই আবার উদাসীন হয়ে গেল। তার অহংকার ও শক্তি যেন শেষ হয়ে গেল। সে এখনো খনিতে কাজ করত, কিন্তু প্রায়ই ছিল রূঢ় আর স্বার্থপর। সকালে নিজের নাস্তা নিজেই বানাতো। বেকন (শুকরের মাংস) ভাজত, রুটি পোড়াতো আর চা খেত। একা খেতে তার ভালো লাগত। সকালে খনিতে যাওয়ার পথে হাঁটাটাই ছিল তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ। দাঁতে ঘাস চিবোতে চিবোতে অন্ধকার খনিতে নামত। ক্লান্ত ও চুপচাপ হয়ে প্রায়ই ঘরে ফিরত।
গারট্রুডের প্রসবকাল কাছাকাছি ছিল। মোরেল কখনো কখনো অদক্ষভাবে সাহায্য করত। আগুনের ছাই ঝাড়ত, শিক নেড়ে দিত, বা লোহার গ্রেট ঘষে পরিষ্কার করত। মনে করত, সে বড় কিছু করেছে। কিন্তু গারট্রুড তা নিয়ে তিক্ত হাসি হাসত। তার প্রতিবেশী মিসেস কার্ক আর মিসেস অ্যান্থনি তার সঙ্গে কথা বলত। হঠাৎ প্রসব বেদনা শুরু হলো। তখন মোটা প্রতিবেশী মিসেস বাওয়ার এসে সাহায্য করল। মোরেল সেদিন খনিতে কাজ করলেও আন্তরিকভাবে করেনি, শুধু অল্প মনোযোগ দিয়ে করেছে। সে ক্লান্ত, রাগী, আর কাজ শেষ করল না। শিফট শেষে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে বাড়ি ফিরল। দেরি হয়ে গেল। তার স্ত্রী তখনই কষ্ট পাচ্ছিল। অবশেষে তার একটি ছেলে হলো।
গারট্রুড সান্ত্বনা পেল। তার মনে হলো, আমি পুরুষদের জননী। শিশুটির চোখ ছিল নীল আর চুল ছিল সোনালি। গভীর ভালোবাসা জেগে উঠল তার মনে। নাম রাখলো পল। মোরেল বাড়ি ফিরে শুধু খাবার আর পানীয় চাইলো। শিশুর প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাল না। ক্লান্ত, নোংরা, আর রূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে শুধু বলল, “আশীর্বাদ করুক!” কিন্তু তা তার অন্তরের কথা ছিল না। গারট্রুড একাকী বোধ করল। কিন্তু শিশুর চোখে সে যেন নিজের হৃদয় দেখতে পেল। সে প্রতিজ্ঞা করল, সবসময় তাকে ভালোবাসবে। প্রথমে না চাইবার অপরাধবোধ ঢাকতে ভালোবাসা আরও গভীর হলো।
পল হলো তার সান্ত্বনা। তার চোখে সবসময় ভারী, চিন্তাশীল, প্রায় বিষণ্ন এক অভিব্যক্তি থাকত। সে শিশুকে বুকের কাছে ধরে বলত, “আমার মেষশাবক!” মনে হতো, সে শুধু তারই। যেন নাড়ি কাটা হয়নি কখনো। কিন্তু ওয়াল্টার আরও বিরক্ত হয়ে উঠল। সন্তানদের ওপর চিৎকার করত। খাবার, আগুন, বা শব্দ নিয়ে বকাবকি করত। তার খারাপ মেজাজ গারট্রুড কে আহত করত। সে বেশি মদ খেতে শুরু করল। এক শুক্রবার রাতে মাতাল হয়ে দেরিতে ফিরল। গারট্রুড তখন শিশুকে নিয়ে দুর্বল অবস্থায় ছিল। মোরেল রূঢ়ভাবে খাবার চাইলো। সে কিছু বলল না। মোরেল জোরে ড্রয়ার টানল। ড্রয়ার পড়ে গেল, ছুরি-চামচ ছড়িয়ে পড়ল। রাগে সে ড্রয়ারটা ছুঁড়ে মারল স্ত্রীর দিকে।
ড্রয়ার তার কপালে আঘাত করল। রক্ত বের হলো। সে শিশুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, ভয় পেল তার ক্ষতি হবে। আধা-মাতাল মোরেল বলল, “লাগল নাকি তোর?” গারট্রুড তাকে দূরে যেতে বলল। সে লজ্জা পেল, কিন্তু কিছু বলল না। গারট্রুড নিজেই ক্ষত বাঁধল। সকালে সন্তানদের বলল, সে ল্যাচে (দরজার সঙ্গে লাগানো ছোট ধাতব কপাট) ধাক্কা খেয়েছে। বাচ্চারা বিস্মিত, দুঃখভরা চোখে তাকাল। তারা ঘরের দুঃখ অনুভব করল। মোরেল শুয়ে রইল, মুখ গোমড়া করে। কখনো দুঃখপ্রকাশ করল না। বরং মনে মনে স্ত্রীকেই দোষ দিল। গারট্রুড তাকে আরও ঘৃণা করল।
দিনগুলো এভাবেই কেটে গেল। সে আরও অস্থির হয়ে উঠল, বেশি মদ খেল, টাকা অপচয় করল। একবার এমনকি স্ত্রীর থলি থেকে ছ’পেনি চুরি করল। অভিযোগ করলে মিথ্যে বলল। রাগে সে একটা গাঁটরি বেঁধে বেরিয়ে গেল। সন্তানরা কাঁদতে লাগল, এই ভেবে যে, সে আর ফিরবে না। কিন্তু গারট্রুড তিক্তভাবে হাসল। সে জানত, মোরেলের সাহস নেই সত্যিই চলে যাওয়ার। সেদিন রাতে সে লুকিয়ে ফিরে এলো। তার গাঁটরি কয়লার ঘরে লুকানো ছিল। গারট্রুড ঠাট্টা করল, কিন্তু তার মন ভারী হয়ে উঠল। সে বুঝল, স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা আর নেই। এখন তার ভালোবাসা শুধু সন্তানদের জন্য, বিশেষ করে পলের জন্য।
(এই ২ নম্বর অধ্যায়ে – পলের জন্ম হয়, আর গারট্রুড সমস্ত ভালোবাসা তাকে দেয়। ওয়াল্টার মোরেল আরও খারাপ হয়ে ওঠে, মদ খায়, স্ত্রীর ওপর রাগ ঝাড়ে। তাদের দাম্পত্য তিক্ত হয়, কিন্তু গারট্রুড আশ্রয় খুঁজে নেয় শুধু সন্তানদের মধ্যে, বিশেষ করে পলের মধ্যে।)
পার্ট-১, অধ্যায় ৩ : মোরেলের অবহেলা, উইলিয়ামের দায়িত্ব গ্রহণ
মোরেলের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে উঠল। সে ওষুধ ও ভেষজ পছন্দ করত। তেতো চা আর এলিক্সার (ওষুধ জাতীয় তরল) বানাত। কিন্তু কোনো কিছুই তার মাথার ব্যথা সারাতে পারল না। কিছুদিন পর সে গুরুতর অসুস্থ হলো। রোগ ছিল মস্তিষ্কে প্রদাহ (মস্তিষ্কে ফুলে ওঠা, জ্বালা বা সংক্রমণ ঘটে)। মিসেস মোরেলকে তাকে সেবা করতে হলো। কারণ, মোরেলের অবস্থা ছিল বেশ খারাপ। দিন-রাত পরিশ্রম করতে হলো তাকে। প্রতিবেশীরা কখনো কখনো সাহায্য করল। তারা খাবার আর ঝোল দিল, বাচ্চাদের দেখাশোনা করল। তবুও মিসেস মোরেল ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়লেন। টাকার অভাবে দিন কষ্টে চলত। খনি শ্রমিকদের ক্লাব থেকে কিছু সাহায্য পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে মোরেল সুস্থ হয়ে উঠল। তার দেহ ছিল শক্তিশালী।
অসুস্থতার পর সে আরও যত্ন চাইতে লাগল। অসুস্থতার ভান করত। প্রথমে মিসেস মোরেল তার প্রতি দয়া করতেন। পরে ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন। তার নালিশ শুনে মিসেস মোরেল বকাবকি করলেন। সে অভিমান করত ছোট ছেলের মতো। কিছুদিন ঘরে শান্তি ছিল। কিন্তু মিসেস মোরেল এক পরিবর্তন অনুভব করলেন। একসময় তিনি তাকে স্বামী ও মানুষ হিসেবে ভালোবাসতেন। এখন সেই ভালোবাসা অনেক কমে গেছে। পলের জন্মের পর তার ভালোবাসা পুরোপুরি সন্তানদের দিকে চলে গেছে। মোরেল এখন শুধু পরিস্থিতির একটি অংশ হয়ে উঠল। তিনি তাকে নীরবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে দূরে সরিয়ে দিলেন। মোরেলও নিজেকে গুটিয়ে নিল। সন্তানদের মায়ের হৃদয়ে তার জায়গা নিতে দিল।
আরেকটি সন্তান জন্ম নিল। তার নাম হলো আর্থার। সে সুন্দর আর ফর্সা ছিল। বাবাকে ভীষণ ভালোবাসত। মোরেল তাকে কোলে নিয়ে খুশি হতো। মিসেস মোরেল খুশি হতেন যে শিশু বাবাকে ভালোবাসে। এগুলো ছিল বিরল শান্তির মুহূর্ত। এদিকে উইলিয়াম দ্রুত বড় হয়ে উঠল। সে শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান ছিল। স্কুলে প্রথম হতো। মায়ের আশা তার ওপর ভর করল। পল ছিল আলাদা। সে ছিল শান্ত, নাজুক, আর স্বপ্নময়। মাঝে মাঝে হঠাৎ দুঃখের ঢেউ আসত তার মনে। মিসেস মোরেল তার জন্য চিন্তিত হতেন। তিনি তাকে অন্য সন্তানদের তুলনায় বেশি কোমলভাবে দেখতেন।
একদিন প্রতিবেশী মিসেস অ্যান্থনির সঙ্গে ঝগড়া বাঁধল। তিনি উইলিয়ামের ওপর অভিযোগ আনলেন যে সে তার ছেলের কলার ছিঁড়েছে। উইলিয়াম ব্যাখ্যা করল, এটা ছিল দুর্ঘটনা। সে তখন জুতোর কারিগরের খেলনা নিয়ে খেলছিল। মিসেস মোরেল তার ছেলের কথা বিশ্বাস করলেন। কিন্তু পরে মোরেল মিসেস অ্যান্থনির পক্ষে দাঁড়াল। সে উইলিয়ামকে মারবার হুমকি দিল। মিসেস মোরেল তীব্রভাবে তাকে থামালেন। তিনি বাবা আর ছেলের মাঝে দাঁড়ালেন। মোরেল স্ত্রীর রাগ দেখে ভয় পেল। সেই দিন থেকে উইলিয়াম আরও ঘনিষ্ঠ হলো মায়ের সঙ্গে।
মিসেস মোরেল মহিলাদের গিল্ডে (সংগঠন বা সমিতি) যোগ দিলেন। সেখানে তিনি কিছু স্বাধীনতা আর মর্যাদা পেলেন। সন্তানরা তাকে এজন্য সম্মান করত। উইলিয়ামও কাজ শুরু করল। সে কো-অপ (সমবায় সমিতি) অফিসে চাকরি পেল। তার বাবা চাইলো তাকে খনিতে নামাতে, কিন্তু মিসেস মোরেল মানলেন না। উইলিয়াম ছিল বুদ্ধিমান। সে শর্টহ্যান্ড (একধরনের বিশেষ লেখন পদ্ধতি, যেখানে খুব দ্রুত লেখার জন্য চিহ্ন, সংকেত ও সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হয়।) শিখল এবং নাইট স্কুলে পড়াত। সে ছিল তেজি, কিন্তু সবাই তাকে সম্মান করত।
সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠল। দৌড়ে জিতে কালি-দানি (যেখানে কলমে লেখার জন্য কালি রাখা হয়) পুরস্কার পেল। নিজের উপার্জন মায়ের হাতে দিত। মিসেস মোরেল গর্ব অনুভব করলেন। উইলিয়াম মধ্যবিত্ত ছেলেদের সঙ্গে মিশতে লাগল। নাচ-গান ও পার্টিতে যেত। তার মা নাচ পছন্দ করতেন না। এ নিয়ে তাদের ঝগড়া হতো। তবুও সে জীবনে এগিয়ে চলল। উনিশ বছর বয়সে উইলিয়াম নটিংহ্যামে চাকরি পেল। কিছুদিন পর সে লন্ডনে চলে গেল। তার বেতন ভালো ছিল। বাবা-মা গর্বিত হলো। মিসেস মোরেলও গর্বিত হলেন, তবে দুঃখও পেলেন। তিনি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তার চলে যাওয়ায় তিনি শূন্য অনুভব করলেন। উইলিয়াম তার পুরোনো প্রেমপত্রগুলো পুড়িয়ে দিল। উইলিয়াম মোরেলের প্রেম ছিল এক লন্ডনের ধনী, ফ্যাশনেবল তরুণীর সঙ্গে। তারপর লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হলো। তার জন্য শুরু হলো নতুন জীবন।
(এই ৩ নম্বর অধ্যায়ে – মোরেল অসুস্থ হয়, মিসেস মোরেল তাকে সেবা করেন। কিন্তু তার ভালোবাসা দূরে সরে গিয়ে সন্তানদের দিকে যায়। উইলিয়াম তার গর্ব ও আশা হয়ে ওঠে। শেষে উইলিয়াম লন্ডনে নতুন জীবন শুরু করে।)
পার্ট-১, অধ্যায় ৪ : পলের শৈশব
পল ছিল ছোট আর শান্ত স্বভাবের। দেখতে মায়ের মতোই। ধূসর চোখ, নীচে নেমে থাকা ঠোঁট। বয়সের চেয়ে বেশি পরিণত মনে হতো তাকে। সে মায়ের অনুভূতির সঙ্গে গভীরভাবে বাঁধা ছিল। মা দুঃখী হলে সেও কষ্ট পেত। তার হৃদয় সবসময় মায়ের কথা শুনত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সে শক্তিশালী হলো। উইলিয়াম তার সঙ্গে খেলত। তবে উইলিয়াম অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। তাই বোন অ্যানিই হলো তার সঙ্গী। অ্যানি তার ছোট ভাইকে ভীষণ ভালোবাসত। পল তাকে সর্বত্র অনুসরণ করত। তার বন্য খেলায় সঙ্গ দিত। অ্যানি তাকে ভালোবাসত, কিন্তু পল ছিল শান্ত ও কোমল।
একবার, পল ভুল করে অ্যানির পুতুল ভেঙে ফেলল। সে ভীষণ দুঃখ পেল। বারবার বলল, সে জানত না পুতুলটা সেখানে ছিল। পরে সে পুতুলটাকে পুড়িয়ে একধরনের ‘বলিদান’ দিল। জিনিসটা ধ্বংস করে সে হালকা অনুভব করল। অ্যানি তার এই অদ্ভুত তীব্রতায় বিচলিত হলো। এতে তার আবেগের এক অন্ধকার দিক প্রকাশ পেল। শিশুরা সবাই বাবার বিরুদ্ধে ছিল। তারা সবসময় মায়ের পক্ষে দাঁড়াত। মোরেল প্রায়ই মাতাল হয়ে সহিংস আচরণ করত। একবার পল মায়ের আঘাতের দাগও দেখল। উইলিয়াম বাবার সঙ্গে প্রায় মারামারিতে জড়িয়ে পড়ল। মিসেস মোরেল তাদের থামালেন। ঘর ভরে গেল রাগ আর ভয়ে। পলের মনে বাবার প্রতি গভীর ঘৃণা জন্ম নিল।
তারা একটি পাহাড়ের ওপর নতুন বাড়িতে চলে গেল। সেখান থেকে বিস্তৃত দৃশ্য দেখা যেত, আর ছিল একটি বিশাল অ্যাশ গাছ। রাতে বাতাস গাছের মধ্যে দিয়ে গর্জন করত। এই শব্দে পল ভয় পেত। রাতগুলো ভরে থাকত ঝগড়ার আশঙ্কায়। বিছানায় শুয়ে সে অপেক্ষা করত নীরবতার জন্য, ভয়ে থাকত বাবা মাকে আঘাত করবে কিনা। রাতে প্রার্থনা করত। ঈশ্বরের কাছে মিনতি করত যেন তার বাবা মদ্যপান বন্ধ করে। কখনো চাইত বাবা যেন মারা যায়। কখনো চাইত খনিতে কাজ করার সময় নিরাপদ থাকুক। উদ্বেগে ভরা ছিল পুরো বাড়ি। যখন মোরেল বাইরে মদ খেতে যেত, সবাই তার ফেরার অপেক্ষায় থাকত। খাবার টেবিলে ঠাণ্ডা হয়ে যেত। তার অনুপস্থিতি তাদের আহত করত।
মোরেল দেরিতে ফিরলে সে হয়ে উঠত ঘৃণ্য। সে হিংস্রভাবে খেত, পরিবারকে জ্বালাতন করত। তারপর টেবিলে বসেই ঘুমিয়ে পড়ত। সন্তানরা তাকে ঘৃণা করত। তারা মাকে সব বলত, কিন্তু বাবাকে কিছু বলত না। সে তাদের জগত থেকে বাদ পড়েছিল। শুধু যখন সে হাতের কাজ করত—মেরামত, হাতুড়ি চালানো, সোল্ডারিং—তখন শিশুরা আনন্দে তার সঙ্গে যোগ দিত। তখন সে সত্যিকারের নিজের মতো হতো, প্রফুল্ল আর গান গাইত। পল ছিল নাজুক। প্রায়ই ব্রঙ্কাইটিসে ভুগত। একদিন অসুস্থ হয়ে স্কুলে যায়নি। অসুস্থ শরীরে শুয়ে থেকে শুনছিল মা কাপড় ইস্ত্রি করছেন। সে মাকে দেখতে ভালোবাসত। মা সাহসী লাগত, কিন্তু চোখে দুঃখ ছিল। পল মনে করল, মায়ের জীবন নষ্ট হয়েছে। সে চাইল মায়ের সব কষ্ট পুষিয়ে দিতে।
অসুস্থ হলে সে শুধু মাকেই পাশে চাইত। বাবা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলে, পল মুখ ফিরিয়ে নিত। বাবার উপস্থিতি সে চাইত না। মায়ের পাশে শুয়ে থাকলেই নিরাপদ ও উষ্ণ মনে হতো। তাদের বন্ধন আরও দৃঢ় হলো। পল মাকে সাহায্য করতেও ভালোবাসত। সে মাশরুম, ব্ল্যাকবেরি, কিংবা যা-ই হোক মায়ের জন্য আনত। খালি হাতে সে কখনো ফিরত না। সবসময় একটা ফুল বা ডাল নিয়ে আসত। মা সেটাকে প্রেমের নিদর্শনের মতো গ্রহণ করতেন। তাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে চলল।
উইলিয়াম লন্ডনে চলে গেল, কিন্তু পল হয়ে উঠল মায়ের সঙ্গী। শুক্রবারে সে বাবার মজুরি আনত। পে-অফিসে যেতে তার ভীষণ ভয় লাগত। ক্লার্করা তাকে ঠাট্টা করত, খনি শ্রমিকরা গায়ে গা লাগাত। তবু মায়ের জন্য সব সহ্য করত। বাজারের রাতে সে ঘরে থেকে রান্না করত, ছবি আঁকত। মায়ের ফেরার জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করত। তারা একসঙ্গে ছোট ছোট আনন্দ ভাগ করত—একটা থালা কেনা, গাছপালা আনা, ফুল সাজানো। এই সহজ মুহূর্তগুলোতে তাদের ভালোবাসা গভীরতর হলো।
রাতে পল আর তার ভাইবোনেরা বাইরে খেলত। তারা একটি ল্যাম্পপোস্ট ঘিরে খেলত। চারদিকে বিশাল অন্ধকার। তারা ঝগড়া করত, আবার মিলত, বন্য খেলায় মেতেছিল। পলের মনে আছে, একবার রক্ত-লাল চাঁদ উঠেছিল। তাদের শৈশবের মাঝে আনন্দ ছিল, কিন্তু ঘরে সবসময় ভয় ঢেকে রাখত। ক্রিসমাস এলো। উইলিয়াম লন্ডন থেকে ফিরল। পরিবার আনন্দের প্রস্তুতি নিল। মিসেস মোরেল কেক বানালেন, সাজালেন, উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করলেন। উইলিয়াম দেরিতে এলেও, পুনর্মিলন ছিল আনন্দময়। সে অনেক উপহার আনল। মায়ের জন্য আনল সোনালি ছাতা। ঘর ভরে গেল মিষ্টি, হাসি আর আনন্দে। পরিবার গর্ব অনুভব করল। কিছু সময়ের জন্য ঘর ভরে উঠল আলো আর ভালোবাসায়।
(এই ৪ নম্বর অধ্যায়ে – পল মায়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে ওঠে। সে বাবাকে ভয় আর ঘৃণা করে, কিন্তু মাকে সীমাহীন ভালোবাসে। তার শৈশব ভরা দারিদ্র্য, ভয় আর ছোট ছোট আনন্দে। ক্রিসমাসে উইলিয়ামের আগমন ঘরে সাময়িক সুখ আর গর্ব বয়ে আনে।)
পার্ট-১, অধ্যায় ৫ : পলের জীবনের সূচনা
মি. মোরেল ছিলেন অসাবধানী। তিনি প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়তেন। একদিন এক ছেলে এসে মিসেস মোরেলকে বলল—তার স্বামীর পা খনিতে ভেঙে গেছে। এসব বিপদে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবু দৌড়ে গেলেন হাসপাতালে। পায়ের হাড় ভয়ানকভাবে চূর্ণ হয়েছিল। হাড়ের টুকরো বাইরে বের হয়ে ছিল। মোরেল গোঙাচ্ছিল আর বলছিল, সে মরবে। মিসেস মোরেল তাকে সান্ত্বনা দিলেন, কিন্তু ভেতরে ঠাণ্ডা লাগছিল। তিনি তার প্রতি দয়া অনুভব করলেন, কিন্তু পুরোনো ভালোবাসা আর ছিল না। এখন কেবল কর্তব্যবোধ থেকে যত্ন করছিলেন।
প্রতিবেশীরা দয়ালু ছিল। তারা খাবার আর ঘরের কাজে সাহায্য করল। তিনি প্রায়ই হাসপাতালে যেতেন। ঘরে, পল মায়ের জন্য চিন্তিত থাকত। সে মায়ের বোঝা ভাগ করতে চাইত। তার মনে হলো, সে বড় হয়ে গেছে। অর্থকষ্ট তখন তেমন ছিল না। অসুস্থ ক্লাব আর খনি শ্রমিকরা সাহায্য করল। মোরেল হাসপাতালে থাকায় ঘরে শান্তি ফিরল। মিসেস মোরেল নটিংহ্যাম থেকে ছোটখাটো জিনিস নিয়ে আসতেন। পল খুব ভালোবাসত তার আনা রং ও কাগজ। শিশুরা মায়ের গল্প শুনে আনন্দ পেত। ঘর যেন মুক্ত ও প্রশান্ত হয়ে উঠেছিল।
এখন পলের বয়স চৌদ্দ। তাকে কাজ খুঁজতে হলো। সে ভীষণ লাজুক ও চিন্তিত ছিল। সে মায়ের কাছ থেকে দূরে যেতে চাইত না। তার স্বপ্ন ছিল অল্প উপার্জন আর মায়ের সঙ্গে শান্ত জীবন। কিন্তু তাকে বাস্তবের মুখোমুখি হতে হলো। উইলিয়াম তখন লন্ডনে। তার জীবন পরিবর্তনে ভরা। সে কঠোর পরিশ্রম করত, পড়াশোনা করত, আর উপভোগ করত নাটক, নাচ আর বন্ধুত্ব। সে এক মেয়ের কথা বারবার বলত—লুইসা লিলি ডেনিস ওয়েস্টার্ন। সে ছিল সুন্দরী, ফ্যাশনেবল আর গর্বিত। মিসেস মোরেল ভয় পেলেন—মেয়ে খরুচে মনে হচ্ছে। তিনি চিন্তিত হলেন, উইলিয়াম কষ্ট পাবে।
এদিকে, পল কাজের জন্য আবেদন করল। উইলিয়ামের পরামর্শে তার চিঠি লেখা হতো। অবশেষে থমাস জর্ডান, সার্জিক্যাল পণ্যের ব্যবসায়ী, তাকে ডেকে পাঠাল। সাক্ষাৎকারের কথা ভেবে পলের ভীষণ ভয় লাগছিল। সে মায়ের সঙ্গে গেল। তারা নটিংহ্যামে সময় কাটাল। দোকান, ফুল, আর খাবারের দোকান দেখল। ভেতরে কষ্ট পেলেও, মায়ের সামনে পল হাসল। সে মাকে ভীষণ ভালোবাসত। মায়ের হাসি, হাত, সঙ্গ—সব ছিল তার কাছে মধুর। মা সেদিন ছিলেন উচ্ছ্বসিত, যেন প্রেয়সীর মতো আনন্দে ভরা।
কারখানায় পৌঁছে পল দেখল জায়গাটা অন্ধকার ও বিষণ্ন। সে মি. জর্ডানের মুখোমুখি হলো। ফরাসি ভাষায় পরীক্ষা নেওয়া হলো। সে ব্যর্থ হলো। নিজেকে বোকা মনে হলো। তবুও তাকে চাকরি দেওয়া হলো—জুনিয়র ক্লার্ক। সাপ্তাহিক মজুরি আট শিলিং। মা গর্বিত হলেন। পল কাজ শুরু করল। কারখানার বাতাস খারাপ, জায়গা অস্বাস্থ্যকর। তার বস, পাপলওয়ার্থ, দ্রুত কাজ করত, খুঁতখুঁতে হলেও দয়ালু ছিল। পল চিঠি নকল করত, অর্ডার সামলাত, প্যাকেজ করত। সে লাজুক ছিল, কিন্তু দ্রুত কাজ শিখল।
সে কারখানার মেয়েদের পছন্দ করত। পলি তার জন্য খাবার রান্না করত। ফ্যানি, এক কুঁজো মেয়ে, তার সঙ্গে গান গাইত। লাল চুলওয়ালা কনি তার আঁকায় অনুপ্রেরণা দিত। মেয়েরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত, কিন্তু সে তাদের মুগ্ধ করত। তার কোমল স্বভাব তাদের টানত। সে তাদের সঙ্গ উপভোগ করত। সন্ধ্যায় সে ক্লান্ত হয়ে ফিরত। দীর্ঘ সময়, খারাপ বাতাস, আর ভারী কাজ তার দিন ভরিয়ে রাখত। তবুও ঘরে ফিরে সে খুশি থাকত। প্রতিদিন মাকে সব বিস্তারিত বলত। রাতের পর রাত তার দিন হয়ে উঠত মায়ের গল্প। যেন তার জীবনটাই ছিল মায়ের জীবন।
(এই ৫ নম্বর অধ্যায়ে – মোরেলের পা ভাঙে; মিসেস মোরেল দয়া করলেও আর ভালোবাসা অনুভব করেন না। পল জর্ডানের কারখানায় চাকরি শুরু করে। লাজুক হলেও সে কাজ শেখে, মেয়েদের সঙ্গে আনন্দ খুঁজে পায়, আর প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে তার জীবন ভাগ করে নেয়। তাদের বন্ধন আরও গভীর হয়।)
পার্ট-১, অধ্যায় ৬ : পরিবারের মৃত্যু
আর্থার বড় হচ্ছিল। সে ছিল চঞ্চল, অসাবধানী, হঠকারী। দেখতে ছিল দারুণ সুন্দর—নীল চোখ, বাদামি চুল, প্রাণচঞ্চল ভরপুর। মানুষ তার প্রশংসা করত। কিন্তু তার মেজাজ ছিল তীব্র, প্রায়ই বদমেজাজি। সে মাকে ভালোবাসত, তবে মাকে জ্বালাত। সে কেবল নিজের কথাই ভাবত। আর্থার বাবাকে ঘৃণা করত। মোরেল তখন বদলে যাচ্ছিল। সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তার ব্যবহার আরও খারাপ হচ্ছিল। সন্তানরা তার এমন অভ্যাস ঘৃণা করত। সে ছিল রূঢ় ও জঘন্য। আর্থার রাগে ফেটে পড়ত, বাবাকে সহ্য করতে পারত না। কখনো মোরেল চেঁচিয়ে বলত—সে পরিবারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। কিন্তু কেউ শুনত না। লড়াইটা চলছিল বাবা আর সন্তানদের মধ্যে। শেষে আর্থারকে নটিংহ্যামে খালার কাছে পাঠানো হলো।
অ্যানি তখন রোজগার করছিল। সে ছিল শিক্ষিকা। ঘরে একটু নিরাপত্তা এলো। পল শান্ত ছিল। সে মায়ের কাছাকাছি থাকত। আঁকত, কাজ করত। সে মায়ের সান্ত্বনা হয়ে উঠেছিল। তারা পরস্পরের সঙ্গে মনের ভাব ভাগ করত। এদিকে উইলিয়ামের বাগদান হলো। তার বাগদত্তা ছিল লিলি ওয়েস্টার্ন। সে তাকে দামি আংটি কিনে দিল। মিসেস মোরেল মেয়েটিকে পছন্দ করলেন না। তার মনে হলো, মেয়েটি গভীর চিন্তাশীল বা আন্তরিক নয়। উইলিয়াম তার প্রেমিকাকে (লন্ডনের ধনী তরুণী) বাইরের দিক থেকে সবসময় সম্মান ও সুরক্ষা দিতেন, যেন তাকে কেউ আঘাত না করে। কিন্তু নিজের ভিতরে তিনি মানসিক টানাপোড়েন ও অস্বস্তি অনুভব করতেন।
ক্রিসমাসে উইলিয়াম লিলিকে বাড়িতে আনল। লিলি ভদ্রমহিলার মতো আচরণ করল। সে সুন্দর পোশাক পরেছিল, আভিজাত্যপূর্ণ ভঙ্গিতে কথা বলত। পরিবার তার সামনে ছোট মনে করল। মোরেল ভদ্রতা দেখাল, কিন্তু অগোছালো ছিল। সন্তানরা তাকে রাজকন্যার মতো প্রশংসা করল। মিসেস মোরেল আহত হলেন। তিনি দেখলেন, ছেলে তার কাছে নতি স্বীকার করছে। লিলি অ্যানি ও পলকে চাকরের মতো ব্যবহার করল। তাদের দিয়ে জিনিস আনাত। কখনো উইলিয়াম তাকে বকত, আবার রক্ষা করতও। মিসেস মোরেল দেখলেন, ছেলে ভেতরে ভেতরে লড়ছে। সে মেয়েটিকে ভালোবাসে, আবার ঘৃণাও করে। একদিন সে মাকে বলল—লিলি গভীর চিন্তাশীল বা আন্তরিক নয়, সে তাকে কখনো বুঝবে না।
তাদের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ল। উইলিয়াম ও লিলি ঝগড়া করল। সে মেয়েটিকে বোকা, অসাবধানী, অহংকারী বলল। লিলি প্রায়ই কাঁদত। মিসেস মোরেল ছেলের আচরণে লজ্জিত হলেন। তবু বুঝলেন, ছেলে অখুশি। তিনি ভয় পেলেন, ছেলের বিয়ে ব্যর্থ হবে। কিছুদিন পর উইলিয়াম অসুস্থ হলো। সে গুজ ফেয়ারের সময় বাড়ি এলো। (এটি ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়া এক বিখ্যাত মেলা। এর ইতিহাস বহু পুরনো; একসময় এখানে হাঁস (goose) বিক্রি হতো, তাই এর নাম “Goose Fair”।) তাকে শুকনা আর দুর্বল লাগছিল। গলায় ফুসকুড়ি উঠেছিল। সে আবার লন্ডনে ফিরল। অল্পদিনের মধ্যেই টেলিগ্রাম এলো—সে মারাত্মক অসুস্থ।
মিসেস মোরেল লন্ডনে দৌড়ে গেলেন। তিনি ছেলেকে অচেতন অবস্থায় পেলেন। তার নিউমোনিয়া ও এরিসিপেলাস হয়েছিল। জ্বরে অজ্ঞান হয়ে সে ভুলভাল কথা বলছিল। মা তার জন্য প্রার্থনা করলেন। সেবা করলেন। কিন্তু অবশেষে সে মায়ের বুকে মারা গেল। কফিন ঘরে আনা হলো। ছয়জন খনি শ্রমিক সেটি ঘরে তুলল। মিসেস মোরেল নরম কণ্ঠে কাঁদলেন—“ওহ, আমার ছেলে!” পল তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। কফিন ছিল লম্বা আর ভারী। উইলিয়াম আর নেই। তাকে কবর দেওয়া হলো। মিসেস মোরেল ভেঙে পড়লেন। তিনি আর দৈনন্দিন জীবনে মন দিলেন না। নীরব হয়ে বসে থাকতেন। পল তাকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করত, নিজের খবর শোনাত। কিন্তু তিনি সামান্যই শুনতেন। তিনি বাঁচতেন শুধু দুঃখে।
ক্রিসমাসে পল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলো। মা ভয় পেলেন, তাকেও হারাতে পারেন। তিনি সযত্নে সেবা করলেন। পল বেঁচে গেল। ধীরে ধীরে সে সুস্থ হলো। তাদের বন্ধন আরও গভীর হলো। এখন মায়ের জীবন পুরোপুরি বাঁধা পড়ল পলের সঙ্গে। লিলি একটি ছোট চিঠি পাঠাল, তারপর হারিয়ে গেল। আর কখনো ফিরল না। উইলিয়ামের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলো। সে দ্রুত তাকে ভুলে গেল। মিসেস মোরেল তিক্ত হয়ে উঠলেন, তবে নিজের সব ভালোবাসা ঢেলে দিলেন পলের ওপর।
(এই ৬ নম্বর অধ্যায়ে – আর্থার বাবাকে ঘৃণা করে ঘর ছাড়ে। উইলিয়াম লিলিকে ঘরে আনে, যে পরিবারের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। পরে উইলিয়াম অসুস্থ হয়ে হঠাৎ মারা যায়। মিসেস মোরেল শোকে ভেঙে পড়েন, কিন্তু আশার আলো খুঁজে নেন পলের মধ্যে।)
পার্ট-২, অধ্যায় ৭ : ছেলে-মেয়ের প্রেম
পল প্রায়ই উইলি ফার্মে যেত (উইলি ফার্মে থাকত লিভার পরিবার)। সে লিভারদের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল। মিরিয়াম, লিভারদের মেয়ে, পলের কাছে থেকে দূরে থাকত। সে লাজুক আর গর্বিত ছিল। সে ভয় পেত, পলও যেন ভাইদের মতো তাকে অবহেলা না করে। সে চাইত পল তাকে বিশেষভাবে দেখুক। মিরিয়াম স্বপ্নে বাঁচত। সে রোমান্স উপন্যাস পড়ত। নিজেকে যেন গোপন রাজকুমারী মনে করত। কিন্তু বাস্তবে সে ঘরের কাজ করত। ভাইদের নোংরা জুতোর দাগ তার অপছন্দ ছিল। সে জ্ঞান আর সৌন্দর্যের জন্য আকুল ছিল।
মা ছিল তার নিকটতম বন্ধু। দুজনেই ধর্মপ্রাণ ও আধ্যাত্মিক। তারা প্রকৃতিতে ও প্রার্থনায় ঈশ্বরকে খুঁজত। মিরিয়াম বই, ভাষা আর জ্ঞান জানতে চাইত। সে ভাবত এতে তার সম্মান বাড়বে। সে চাইত পল তাকে এজন্য শ্রদ্ধা করুক। পলের সামান্য জ্ঞান তাকে মুগ্ধ করত। সে ছবি আঁকত, ফরাসি পড়ত। সে গ্রামের ছেলেদের মতো ছিল না। মিরিয়াম তাকে নায়ক ভেবে বসেছিল। কিন্তু ভয় পেত, পল হয়তো শুধু তাকে গরিব কৃষক-কন্যা হিসেবেই দেখবে।
যখন পল অসুস্থ হলো, মিরিয়াম মনে করল সে তাকে সেবা করতে পারে। তার কাছে প্রেম মানেই ছিল লালন-পালন, শক্তি হওয়া। এই ভাবনায় তার অনুভূতি গভীর হলো। সে পলের জন্য ব্যাকুল হলো। বসন্তে পল আবার ফার্মে এলো। সে গ্রাম্য প্রকৃতি ভালোবাসত। দরজায় দাঁড়িয়ে মিরিয়ামকে দেখে সে তার সৌন্দর্য টের পেল। পলের দৃষ্টি পড়ে যেতেই মিরিয়াম লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
রাতে খাওয়ার টেবিলে ভাইরা মিরিয়ামকে পোড়া আলুর জন্য বিদ্রূপ করল। সে অপমানিত হলো। পল তাদের নিষ্ঠুরতা বুঝল। সে ভাবল, এমন ছোট জিনিস এত কষ্ট কেন দেয়? এভাবেই সে মিরিয়ামের নিঃসঙ্গতা বুঝতে শিখল। পল মিসেস লিভার্সের সঙ্গেও কথা বলত। তার মধ্যে যেন গভীর অর্থ পাওয়া যেত। মিরিয়াম ছিল তার আত্মার কন্যা। দুজনে মিলে প্রকৃতি, বাসা, ফুল, সূর্যাস্ত ভালোবাসত। পল তাদের আধ্যাত্মিক গাম্ভীর্যে আকৃষ্ট হলো।
পল আর মিরিয়াম একসঙ্গে হাঁটত। মিরিয়াম তাকে প্রকৃতির নানা জিনিস দেখাত। পল সেগুলোকে নতুন অর্থ দিত। ছোট ছোট জিনিসেই তারা মিল খুঁজে পেত। ফুল, পাখি, বন—এসব তাদের কাছে পবিত্র হয়ে উঠত। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। মিরিয়াম ছিল আবেগপ্রবণ। তার ভালোবাসা ছিল তীব্র কিন্তু অস্বস্তিকর। তার চোখের গভীর দৃষ্টি আর কাঁপা শরীর মাঝে মাঝে পলকে ভয় দেখাত। তার প্রেম ভারী মনে হতো।
পল তাকে অ্যালজেব্রা শেখাতে লাগল। মিরিয়াম কষ্ট করে পড়ত। পল রেগে যেত, বকাবকি করত। কখনো জিনিস ছুড়ে ফেলত। পরে অনুতপ্ত হতো। মিরিয়াম চুপচাপ সহ্য করত। তার নীরব কষ্ট পলকে লজ্জিত করত। কিন্তু তবুও সে তার কাছেই ফিরত। মিরিয়াম চাইত ঘর থেকে মুক্তি, শেখার সুযোগ। সে শুধু মেয়ে হয়ে থাকতে চাইত না। পল অবাক হতো। তার বোন অ্যানি কখনো এমন ভাবেনি। কিন্তু মিরিয়াম আলাদা। সে বড় জীবনের স্বপ্ন দেখত।
তারা গ্রাম্য পথে হাঁটত। মিরিয়াম তাকে তার প্রিয় বুনো গোলাপ গাছ দেখাল। তার কাছে সেটা ছিল পবিত্র। গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে পলের সঙ্গে থাকা তার কাছে উপাসনার মতো। পল সেটি প্রশংসা করল, কিন্তু অস্বস্তি বোধ করল। তার পক্ষে মিরিয়ামের আবেগ পুরোপুরি ভাগ করা সম্ভব ছিল না। তাদের সম্পর্ক ছিল শক্তিশালী কিন্তু অদ্ভুত—খুব পবিত্র, বিমূর্ত, আধ্যাত্মিক। শারীরিক প্রেম মিরিয়ামকে ভয় দিত। পল তার মেজাজে ভেসে যেত। তাই তারা পবিত্রতা রক্ষা করল, চিন্তা আর অনুভূতিতে বাঁধা থাকল।
মিসেস মোরেল মিরিয়ামকে অপছন্দ করত। তার মনে হতো, মেয়েটি পলের আত্মা গ্রাস করবে। সে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল। বাড়িতে পল মায়ের প্রভাবেই বেশি বাঁধা থাকত, মিরিয়ামের চেয়ে। ছুটির দিনে মোরেল পরিবার সমুদ্রতীরে গেল। মিরিয়ামও যোগ দিল। কখনো পল তার সঙ্গ উপভোগ করত, আবার কখনো অস্থির লাগত। মিরিয়াম তার আত্মার কাছে থাকার দাবি করত। পল চাইত সহজতা আর আনন্দ, কিন্তু তার সঙ্গে থাকলে সে বাঁধা লাগত। তাদের বন্ধুত্ব গভীর হলেও, পলের মনে দ্বন্দ্ব জাগত। সে মিরিয়ামের জ্ঞানকে ভালোবাসত, কিন্তু তার দখলদারি ভয় পেত। মিরিয়াম তাকে গম্ভীর, বিষণ্ণ, আর অন্যদের থেকে আলাদা করে দিত। তাদের প্রেম সহজ ছিল না। তা ছিল ভাবনা, ধর্ম আর তীব্রতায় ভারী।
(এই ৭ নম্বর অধ্যায়ে –পল উইলি ফার্মে মিরিয়ামের ঘনিষ্ঠ হয়। তাদের সম্পর্ক আধ্যাত্মিক আর প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরা। কিন্তু মিরিয়ামের অতিরিক্ত তীব্রতা পলকে ভীত করে তোলে। মিসেস মোরেল ঈর্ষান্বিত হয়, মিরিয়ামের প্রভাবকে ভয় পায়।)
পার্ট-২, অধ্যায় ৮ : প্রেমে সংঘাত
আর্থার তার প্রশিক্ষণ শেষ করে মিন্টন পিটে কাজ পেল। বেতন কম ছিল, কিন্তু ভবিষ্যতে সুযোগ ছিল। তবুও সে বেপরোয়া আর অসাবধান রইল। প্রায়ই বাইরে থাকত, ঝামেলায় জড়াত। একদিন সে বাড়িতে লিখল যে সে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছে। পরে সে অনুতপ্ত হলো এবং মাকে অনুরোধ করল তাকে ফিরিয়ে আনতে। মিসেস মোরেল খুব অবাক হলেন। পল বলল, আর্থারকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। এতে মায়ের খুব খারাপ লাগল। তবুও তিনি ডার্বি গেলেন। কিন্তু কোনো ফল হলো না। শেষ পর্যন্ত আর্থার সৈনিকই হয়ে রইল।
মোরেল, বাবা, খুব রেগে গেলেন। আর্থারকে অভিশাপ দিলেন এবং বললেন তিনি আর কোনো সাহায্য করবেন না। মিসেস মোরেল ছেলের জন্য কাঁদলেন। তার ভয় হলো সেনা জীবন ছেলেকে নষ্ট করে দেবে। তবু মনে মনে তিনি একটু গর্বও করলেন, কারণ ডাক্তার আর্থারের শরীরের প্রশংসা করেছিলেন। পল মাকে সান্ত্বনা দিল। সে তার আঁকা ছবি দেখাল। ক্যাসেল প্রদর্শনীতে সে দুটি পুরস্কার জিতেছিল। এতে মা খুশিতে ভরে উঠলেন। তিনি গর্ব অনুভব করলেন। তার মনে হলো, জীবনের কষ্ট বৃথা যায়নি। পলের সাফল্য যেন তার নিজের সাফল্য।
গোপনে তিনি গ্যালারিতে গেলেন। ছেলের ছবি দেখলেন। তার নাম দেখে গর্ব অনুভব করলেন। মনে হলো তিনি ধনীদের সমান। তার ছেলে কিছু করেছে। তিনি পূর্ণতা অনুভব করলেন। এদিকে পল শহরে মিরিয়ামের সঙ্গে দেখা করল। মিরিয়ামের সঙ্গে ছিল ক্লারা ডজ। ক্লারা ছিল লম্বা, গর্বিত, ঠাণ্ডা। সে স্বামীকে ছেড়ে এসেছিল। সে নারী অধিকারের পক্ষে ছিল। তার চেহারায় অবজ্ঞা, তবু দৃঢ়তা ছিল। পল মুগ্ধ হলো। ক্লারার স্বামী, ব্যাক্সটার ডজ, পলকে ঘৃণা করত। সে ছিল কামার। রূঢ়, শক্তিশালী, অসচ্চরিত্র। সে পলের সমালোচনামূলক দৃষ্টি সহ্য করত না। পলও তাকে অবজ্ঞা করত। তারা নীরবে একে অপরকে ঘৃণা করত। ক্লারা দূরে থাকত, কিন্তু আকর্ষণীয় ছিল। এদিকে মিরিয়াম ও পলের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলো। তারা একসঙ্গে পড়াশোনা করত। বই ভাগাভাগি করত। ভাবনা শেয়ার করত। মিরিয়াম তাকে ভক্তির মতো ভালোবাসত। কিন্তু পল অস্বস্তি বোধ করত। তার ভালোবাসা ছিল ভারী—অতিরিক্ত আধ্যাত্মিক, অতিরিক্ত গভীর।
পল চাইত, মিরিয়াম যেন একটু হাসিখুশি হয়। কিন্তু মিরিয়াম সবসময় গম্ভীর আর তীব্র ছিল। এতে পলের দমবন্ধ লাগত। তবুও সে তার কাছেই ফিরে যেত। পল তাকে ছবি বা শিল্পকর্ম উপহার দিত, আর মিরিয়াম সেগুলো যত্ন করে রাখত। মিরিয়াম তার জন্য ফরাসি ডায়েরি লিখত, পল সেগুলো ঠিক করে দিত। মিরিয়াম তার সমস্ত মন আর আত্মা ঢেলে দিত পলের জন্য। কিন্তু এতে পল অস্থির হয়ে উঠল। এদিকে বিয়াট্রিস নামের আরেক মেয়ে মিরিয়ামকে ঠাট্টা করত এবং পলকে খেপাত। সে খেলাচ্ছলে পলকে চুমু দিত। এতে পল অপরাধবোধ করল, আবার উত্তেজিতও হলো। মিরিয়াম বিষয়টি দেখে কষ্ট পেল। কিন্তু পল অনুতপ্ত হলো না। বরং ভেতরে ভেতরে সে মিরিয়ামের ওপর রাগ জমিয়ে রাখল।
বাড়িতে মিসেস মোরেল অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাজার থেকে জিনিস বহন করতে গিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। পল দেখল, মায়ের শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছে। এতে সে চিন্তিত হলো। কিন্তু তারপরও সে মিরিয়ামের কাছে গেল। মা এতে ঈর্ষান্বিত হলেন। তিনি মনে করলেন, মিরিয়াম পলকে পুরোপুরি দখল করে নিচ্ছে। এতে তিনি নিজেকে বঞ্চিত ভাবলেন। পল মায়ের কথায় মিরিয়ামের প্রতি একদিকে ঘৃণা অনুভব করল, কিন্তু আবার তাকে ভালোও বাসলো। ফলে সে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্বে পড়ল। তার হৃদয় মা আর প্রেমিকার মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেল। মিরিয়াম চাইত পলকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে পেতে, আর মা-ও চাইতেন। তাই পল চরম টানাপোড়েনে বন্দী হয়ে গেল।
এক রাতে পল মাকে স্নেহভরে চুমু দিল। তখন মা কেঁদে ফেললেন। তিনি স্বীকার করলেন যে, মিরিয়ামকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। তিনি বললেন, মিরিয়াম একদিন পলের সবকিছু কেড়ে নেবে। এতে পল প্রতিশ্রুতি দিল যে সে শুধু মাকেই ভালোবাসবে। এতে তার নিজের হৃদয় ভেঙে গেল। সেই রাতেই পিতা মদ্যপ হয়ে বাড়ি ফিরল এবং পলের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল। হঠাৎ মিসেস মোরেল অজ্ঞান হয়ে গেলেন। পল ছুটে গিয়ে মায়ের ওপর ঝুঁকে কাঁদতে লাগল। আবারও সে মায়ের দিকেই দাঁড়াল। শেষ পর্যন্ত পিতা পরাজিত হলো। ঘরের ভেতর প্রেম আর সংঘাত একসঙ্গে ভরে উঠল।
(এই ৮ নম্বর অধ্যায়ে – আর্থার সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। পল পুরস্কার জেতে, মিসেস মোরেল গর্বিত হন। পল মিরিয়ামের ভালোবাসা আর মায়ের দাবি নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে। এক তীব্র পারিবারিক সংঘাত শেষে সে আবার মায়ের কাছেই বাঁধা পড়ে যায়।)
পার্ট-২, অধ্যায় ৯ : মিরিয়ামের পরাজয়
পল অস্থির ছিল। সে তৃপ্ত ছিল না। নিজের উপর সন্দেহ করত। মিরিয়ামের উপরও সন্দেহ করত। তার হৃদয় মায়ের কাছে বাঁধা ছিল। সে দ্বিধায় পড়েছিল। মিরিয়ামও ভয় পেত। সে বুঝত, পল কখনো পুরোপুরি তার হবে না। তার কাছে পলের সঙ্গে জীবন মানে ছিল শুধু ত্যাগ। সে সুখ দেখত না, কেবল ট্র্যাজেডি দেখত। ত্যাগে সে দৃঢ় ছিল, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে দুর্বল। ইস্টারের সময় পল উইলি ফার্মে গেল। সে শীতল ভঙ্গিতে এল। মানুষকে বিদ্রূপ করল। মিরিয়ামকে উপেক্ষা করল। তার অহংকারে আঘাত লাগল। সে নতুন ব্লাউজ পরেছিল। পল লক্ষ্য করল, কিন্তু কোনো উষ্ণতা দেখাল না। মিরিয়াম ভেঙে পড়ল। তারা বাগানে গেল। মিরিয়াম ড্যাফোডিল ফুল ভালোবাসত। সে ফুলে চুমু খেল। পল তাকে বিদ্রূপ করল। বলল, সে জিনিসগুলোকে অতিরিক্ত আদর করে। তাকে ভালোবাসার ভিক্ষা করার অভিযোগ করল। মিরিয়াম আঘাত পেল। পলকে নিষ্ঠুর মনে হলো। মিরিয়াম নিরাশ হল।
পরে তারা বনে হাঁটল। পল খিটখিটে ছিল। সে লাঠি দিয়ে মাটিতে খোঁচা মারছিল। মিরিয়াম জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। অবশেষে পল বলল, “আমাদের সম্পর্ক ভেঙে ফেলা ভালো।” মিরিয়ামের বুক ভেঙে গেল। পল বলল, সে কেবল বন্ধুত্ব দিতে পারবে, প্রেম নয়। সে বলল, সে অক্ষম। সে বলল, স্বামীর মতো ভালোবাসতে পারে না। মিরিয়াম দুঃখে শুনল। সে অপমানিত হলো। তবুও হার মানল না।
মিরিয়াম মনে করল, পলের পরিবার, বিশেষ করে তার মা, তাকে সবসময় প্রভাবিত করে। কিন্তু পল তা অস্বীকার করল। তবু ভেতরে ভেতরে সে জানত—এটাই সত্য। তার সবচেয়ে দৃঢ় বাঁধন ছিল মায়ের সঙ্গে। সে সবসময়ই মায়ের কাছে ফিরে আসত। মা-ই ছিল তার আসল আশ্রয়। ফলে মিরিয়াম যেন ধীরে ধীরে ছায়ায় পরিণত হলো। তবুও পল আবার উইলি ফার্মে গেল। সেখানে মিরিয়ামের মা তাকে সান্ত্বনা দিলেন। মিরিয়াম ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল, যদিও ভেতরে ভেতরে ভয় পেল যে পল তাকে ছেড়ে যাবে। পল স্বীকার করল, সে এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। মিরিয়াম তা মেনে নিল। তবুও তার ভালোবাসা একটুও কমল না।
মিরিয়াম পলের সঙ্গে ক্লারা ডজের পরিচয় করিয়ে দিল। ক্লারা ছিল দৃঢ়চেতা, গর্বিত ও উদাসীন স্বভাবের। পল সঙ্গে সঙ্গেই তাকে লক্ষ্য করল। তার অবাধ্যতা আর দৃঢ়তা পলকে আকর্ষণ করল। এটা দেখে মিরিয়ামের মন ভেঙে গেল। সে বুঝতে পারল, ক্লারাকে দেখে পল উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তার মনে ভয় ঢুকল, পলকে হয়তো সে হারাবে। যদিও পল উইলি ফার্ম ও মিরিয়ামের পরিবারকে ভালোবাসত, এডগারের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব হয়েছিল, তবুও মিরিয়ামের সঙ্গ পলকে অস্বস্তিকর লাগত। মিরিয়াম তার পুরোপুরি পলকে চাইত, কিন্তু এতে পল নিজেকে বন্দী মনে করত। তার ভেতরে তীব্রভাবে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠত।
আরো পড়ুনঃ A Passage to India Bangla Summary
কখনো কখনো পল আর মিরিয়াম মিল খুঁজে পেত, একসঙ্গে পড়াশোনা করত। পল নিজের সন্দেহ আর চিন্তা শেয়ার করত, মিরিয়াম ধৈর্য ধরে শুনত। কিন্তু এতে পল পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিল না। সে চাইত শারীরিক প্রেম, অথচ মিরিয়াম দিত শুধু আধ্যাত্মিক ভালোবাসা। এতে পল বিরক্ত হয়ে উঠত। তাই সে বারবার ক্লারার দিকে আকৃষ্ট হতো, যেখানে আবেগ আর তীব্রতা ছিল। মিরিয়ামের সঙ্গে থাকলে তার মনে হতো, সে ভারী বোঝা বহন করছে—যেন মিরিয়াম তার বিবেক হয়ে সবসময় তাকে দাবিতে বেঁধে রাখছে।
এক রাতে পল মিরিয়ামকে চিঠি লিখল। সে লিখল, তাদের প্রেম কেবল আধ্যাত্মিক। সে তাকে “সন্ন্যাসিনী” বলল। বলল, তারা কখনো সাধারণ প্রেমিক-প্রেমিকার মতো বাঁচতে পারবে না। মিরিয়ামের হৃদয়ে গভীর আঘাত লাগল। তার আত্মা বিদীর্ণ হলো। এতে তাদের সম্পর্কের প্রথম পর্ব শেষ হলো। তখন পলের বয়স ছিল তেইশ। সে এখনো শুদ্ধ ছিল, কিন্তু কামনা প্রবল। মিরিয়াম তখনও বিশ্বাস করত, পল তারই। কিন্তু ক্লারা অপেক্ষা করছিল।
(এই ৯ নম্বর অধ্যায়ে – পল স্বীকার করে যে সে সত্যিই মিরিয়ামকে ভালোবাসে না। মিরিয়াম কষ্ট পেলেও আঁকড়ে ধরে। পল মায়ের প্রতি ও ক্লারার দিকে ঝুঁকে যায়। তাদের প্রেম আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠে, শারীরিক নয়।)
পার্ট-২, অধ্যায় ১০ : ক্লারা
পল নটিংহ্যামের প্রদর্শনীতে একটি ছবি পাঠাল। সে প্রথম পুরস্কার জিতল। ছবিটি বিশ গিনিতে বিক্রি হলো। মা আনন্দে ভরে উঠলেন। তিনি নেচে উঠলেন, কেঁদে ফেললেন। পল গর্ব অনুভব করল, তবে শান্ত ছিল। পিতাও গর্বিত হলেন। কিন্তু তাঁর মনে পড়ল উইলিয়ামের কথা। সেই স্মৃতি মিসেস মোরেলকে দুঃখ দিল। তবু পলের সাফল্যে তিনি শক্তি পেলেন। তিনি পলের মাধ্যমে নতুন করে আশা দেখলেন।
পলের একটি ইভনিং স্যুট প্রয়োজন ছিল। মা তাকে উইলিয়ামের স্যুট দিলেন। প্রায় ঠিকই মানিয়ে গেল। তাতে তার মনে আনন্দও হলো, বেদনাও হলো। এক ছেলে মৃত, অন্য ছেলে তার পোশাক পরছে। মনে হলো মৃত ছেলে যেন আবার জীবিত হলো। পল উইলিয়ামের শার্ট ও বোতামও পরত। সে ডিনার পার্টিতে যেত। মা গর্ব করতেন। তাঁর মনে হতো, ছেলে এখন সত্যিকারের পুরুষ হয়ে উঠেছে। পল সবকিছু মাকে বলত। মা অনুভব করতেন, তিনি ছেলের নতুন জীবনেরও অংশ।
এখন মা-ছেলে আরও অন্তরঙ্গভাবে আলাপ করত। তারা জীবন ও সমাজ নিয়ে কথা বলত। পল বলত, সে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায়। কিন্তু মা চাইতেন, সে সামাজিকভাবে আরও ওপরে উঠুক। তার আশা ছিল, একদিন পল কোনো ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করবে। কিন্তু পল ছিল অস্থির—মিরিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও সে সুখী ছিল না। এতে মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি চাইতেন, পল যেন মুক্ত থাকে। এমনকি মনে মনে কামনা করতেন, পল মিরিয়ামকে ছেড়ে অন্য কাউকে ভালোবাসুক।
পল ধীরে ধীরে মিরিয়াম থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই তার দেখা হলো ক্লারা ডজের সঙ্গে। ক্লারা বিবাহিতা হলেও স্বামীর থেকে আলাদা থাকত। সে ছিল লম্বা, শক্তিশালী এবং গর্বিত স্বভাবের। লেস কারখানায় কাজ করত বলে তার জীবন কষ্টময় ছিল। একদিন পল তার বাড়িতে গিয়ে ক্লারার মা, মিসেস র্যাডফোর্ডের সঙ্গে দেখা করল। বাড়িটিতে ছিল গরিব অবস্থার ছাপ, তবে চারপাশ লেসে ভরা ছিল। ক্লারাকে এমন সাধারণ কাজ করতে দেখে পল একটু অস্বস্তি বোধ করল, কিন্তু একই সঙ্গে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেল। ক্লারার শক্ত গলা আর বাহু দেখে পলের মনে হলো, সে যেন শিকলবন্দি এক রাণী। তার প্রতি মায়া জাগল, আর মনে হলো—সে তাকে সাহায্য করতে চায়।
ক্লারা আবার জর্ডানের কারখানায় কাজে ফিরল। কিছু মেয়ে তাকে অপছন্দ করত, কারণ তার মধ্যে ছিল একধরনের গর্ব ও উদাসীনতা। তবুও পল তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। ক্লারা কখনো তাকে চ্যালেঞ্জ করত—তার শিল্পকর্মকে ব্যঙ্গ করত, আবার কখনো আন্তরিকভাবে প্রশংসা করত। ক্লারার কাছে আসলে পল অস্থির হয়ে উঠত। তাদের মধ্যে প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হতো, কিন্তু তারা একে অপর থেকে আলাদা থাকতে পারত না। একদিন পল তাকে চকলেট দিল। প্রথমে ক্লারা নিতে চাইল না, পরে নিল। সেই মুহূর্ত থেকে তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল।
পলের জন্মদিনে মেয়েরা তাকে রং-তুলি দিল। শুধু ক্লারা দিল না। পরে সে একটি বই উপহার দিল। এই উপহার পলকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেল। সে ক্লারার উষ্ণতা অনুভব করল। তারা একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। জীবন নিয়ে কথা বলল। ক্লারা তাকে তার ব্যর্থ বিবাহের কথা জানাল। বলল, তার স্বামী ছিল নিষ্ঠুর। পল তার প্রতি দয়া অনুভব করল। তারা আরও ঘনিষ্ঠ হলো। তবুও পলের মনে মিরিয়াম জায়গা করে রইল। সে তাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখত, কখনো দেখা করতও। আসলে পল দুই নারীর মাঝে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল—মিরিয়াম ছিল তার আত্মার প্রতীক, আর ক্লারা ছিল তার দেহের কামনা। সে দুজনকেই ধরে রাখতে চাইত এবং মনে করত, এতে কোনো দোষ নেই। তার বিশ্বাস ছিল, মিরিয়াম অতীতের অংশ, আর ক্লারা বর্তমানের। মিসেস মোরেল আশা করলেন, হয়তো ক্লারা পলকে মিরিয়ামের প্রভাব থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু মিরিয়াম তখনও অপেক্ষায় থেকে গেল, মনে করল একদিন পল তার কাছেই ফিরবে।
(এই ১০ নম্বর অধ্যায়ে – পল চিত্রকলায় প্রথম পুরস্কার জেতে। তার ক্লারা ডজের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। ক্লারা তার ব্যর্থ বিবাহের কাহিনি শোনায়। কিন্তু পল এখনও মিরিয়াম ও ক্লারার মাঝে টানাপোড়েনে ভোগে।)
পার্ট-২, অধ্যায় ১১ : মিরিয়ামের উপর পরীক্ষা
বসন্ত এলো, আর পল অস্থির হয়ে উঠল। সে জানত, তাকে আবার মিরিয়ামের কাছে ফিরতে হবে। তবু মনে ভেতরে এক ধরনের ভয় ছিল। সে মিরিয়ামকে ভালোবাসত, কিন্তু মিরিয়ামের কাছে আসতে পারত না। মিরিয়ামের পবিত্রতা যেন তাকে দূরে সরিয়ে রাখত। তাদের প্রেম তাই অসম্পূর্ণ লাগত। পল বিয়ের কথা ভাবত, চাইত সত্যিকারের ইচ্ছা জাগুক। কিন্তু তার মধ্যে সেই আনন্দ বা আকাঙ্ক্ষা জাগল না। আনন্দ ছাড়া সে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। ফলে সে নিজের ভেতরেই বন্দী হয়ে গেল। মিরিয়ামের সঙ্গে থেকে সে কখনো মুক্তির অনুভূতি পেত না।
সে মিরিয়ামের প্রতি করুণা অনুভব করল। মিরিয়াম ভক্তির মতো তাকে ভালোবাসত। তার কাছে পল যেন এক ধর্ম। পল ব্যর্থ হতে চাইত না। সে অন্য পুরুষদের কথা ভাবল, যারা তার মতো। কোমল মায়ের ছেলে। পুরুষেরা অতিরিক্ত লাজুক। তারা নারীদের আঘাত দিতে ভয় পায়। তারা হৃদয়ে মা’কে বহন করে চলে। পল আবার মিরিয়ামের কাছে ফিরল। কখনো সে সন্ন্যাসিনীর মতো গান গাইত। পল তাকে শ্রদ্ধা করত, তবু কষ্ট পেত। তার মনে একদিকে কোমলতা, অন্যদিকে সংগ্রাম। সে নিজেকে বলল—তার দায়িত্ব আছে। তাকে চেষ্টা করতেই হবে।
মিসেস মোরেল আবার দেখলেন, পল মিরিয়ামের সঙ্গে আছে। তিনি তিক্ত হলেন। তিনি মিরিয়ামকে ক্ষমা করতে পারলেন না। তার মনে হলো, মিরিয়াম পলের আনন্দ শুষে নেয়। পল হয়ে উঠল গম্ভীর, অস্থির, খিটখিটে। এতে তিনি উইলিয়ামের কথা মনে করলেন। নিজেকে নিরর্থক মনে হলো। পল নিজের মতো চলত। তিনি শুধু রান্না করতেন আর অপেক্ষা করতেন। উইলি ফার্মে গিয়ে পল মিরিয়ামকে পরীক্ষা করল। সে মিরিয়ামের সঙ্গে বিয়ের কথা তুলল। বলল, তার জীবনে একজন নারী দরকার। মিরিয়াম লাজুকভাবে সম্মতি জানাল। তারা চুম্বন করল। এতে পল একদিকে আনন্দ পেল, আবার ভেতরে বেদনা অনুভব করল। তার আবেগ জ্বলে উঠল, কিন্তু দ্রুত নিভেও গেল। মিরিয়াম নিজেকে তার হাতে সমর্পণ করল, কিন্তু তাতে ছিল ভয় আর দ্বিধা। পল তাকে গভীরভাবে চাইছিল, তবু শেষ পর্যন্ত মিরিয়াম ভয়ে সরে গেল।
পরে তারা চেরি তুলতে গেল। সূর্যাস্তের আলোয় পলের মনে প্রবল আবেগ জাগল। তার চোখে মিরিয়াম তখন নরম আর ক্ষুদ্র মনে হলো। তারা অন্ধকার পাইন বনের ভেতর ঢুকল। সেখানে পল তাকে জড়িয়ে ধরল। মিরিয়াম নিজেকে তার হাতে সমর্পণ করল, কিন্তু তাতে ছিল ভয় আর দ্বিধা। এটি ছিল না আনন্দের অভিজ্ঞতা, বরং একধরনের ত্যাগ। পল ভেতরে শুন্যতা অনুভব করল। তার মনে হলো, সে চাইছে শুধু স্থিরতা—অথবা মৃত্যু। মিরিয়াম তাকে সত্যিই ভালোবাসত, কিন্তু তার তীব্র আবেগ আর আকাঙ্ক্ষায় ভয়ে সরে যেত।
তার দাদীর কটেজে তারা কয়েকদিন একসঙ্গে কাটাল। রান্না করল, গল্প করল, ফুল তুলল—সব মিলিয়ে যেন বিবাহিত জীবনের মতো মনে হলো। সেখানে পল মিরিয়ামকে চুম্বন করল। কটেজ যেন তাদের একান্ত ব্যক্তিগত জগৎ হয়ে উঠল। অবশেষে মিরিয়াম নিজেকে সম্পূর্ণভাবে পলের হাতে সমর্পণ করল। তার ভালোবাসা ছিল গভীর, কিন্তু শরীর ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধ করছিল। সে শুয়ে রইল যেন ত্যাগের শয্যায়। পল তাকে ভালোবাসল, তবুও গভীর বেদনা অনুভব করল। আবেগ তাদের দুজনকেই ক্লান্ত করে দিল। পলের কাছে সেই মিলন ছিল ব্যর্থতা, যেন ভালোবাসার বদলে মৃত্যু এসে ধরা দিল।
সে মাকে স্বীকার করল যে আর মিরিয়ামের কাছে এত ঘন ঘন যাবে না। একসময় সে মিরিয়ামকে সত্যিই ভালোবাসত, কিন্তু এখন আর তা নেই। সে মনে করছিল, এই সম্পর্ক থেকে পালিয়ে যেতে হবে। তার মনে হচ্ছিল, মিরিয়ামের সঙ্গে সে বাঁধা পড়ে আছে। ক্লারার কাছে গেলে সে হালকা ও মুক্ত বোধ করত, কিন্তু মিরিয়ামের সঙ্গে থাকলে যেন শুষে যেত। মিরিয়ামের দৃষ্টি এখন তার কাছে বিরক্তিকর মনে হতো। সে সবসময় যেন তাকে বিচার করত, অথচ কোনো উষ্ণতা দিত না। মিরিয়ামের এই অতিরিক্ত ভক্তি পলের কাছে বন্দিত্বের মতো মনে হতো। তাদের প্রেম যেন কেবল টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কোনো আনন্দ দিচ্ছিল না।
শেষ পর্যন্ত পল ভেঙে পড়ল। মাকে বলল, সে মিরিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করবে। রবিবারে গিয়ে সে মিরিয়ামকে জানাল। মিরিয়াম হতবাক হলো, যদিও পুরোপুরি বিস্মিত নয়। পল বলল, সে বিয়ে করতে চায় না। মিরিয়াম অভিযোগ করল, পল সবসময় তার সঙ্গে লড়াই করে। এতে পল তিক্ত হয়ে উঠল। তাদের বছরের পর বছর প্রেম তার কাছে হঠাৎ মিথ্যা মনে হলো। পল উল্টো অভিযোগ করল, মিরিয়াম তাকে সবসময় অবজ্ঞা করেছে। তবুও মিরিয়াম মনে করল, সে এখনো পলের সঙ্গে বাঁধা, কিন্তু শেষমেশ তাকে ছেড়ে দিল। পল চলে গেল, মনে অপরাধবোধও ছিল, আবার স্বস্তিও। সে পাব-এ গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে হেসে কথা বলল, কিন্তু হৃদয়ের ভেতর ভার থেকেই গেল। বাড়ি ফিরে মাকে সব বলল। মা তাকে সান্ত্বনা দিলেন। সম্পর্ক শেষ হলেও দুজনের মনেই দুঃখ রয়ে গেল।
(এই ১১ নম্বর অধ্যায়ে – পল আবার মিরিয়ামের কাছে ফিরে যায়, কিন্তু আবেগ ব্যর্থ হয়। প্রেম শুন্য মনে হয়। অবশেষে সে সম্পর্ক ছিন্ন করে। সে অপরাধবোধ করে, তবু স্বস্তি পায়।)
পার্ট-২, অধ্যায় ১২ : আবেগ
পল শিল্পে মন দিল। ছোট নকশা বিক্রি করল। মৃৎশিল্প শিখল। আলো দিয়ে মানুষের ছবি আঁকল। সে তার কাজে বিশ্বাস রাখল। মাকে বলল, একদিন সফল হবে। মা হাসলেন। পল মায়ের গর্ব ভালোবাসল। সে মায়ের সঙ্গে আইল অফ ওয়াইটে গেল। জায়গাটা ছিল সুন্দর। একবার মা অসুস্থ হলেন। পল ভয় পেল। মা সেরে উঠলেন। কিন্তু সেই উৎকণ্ঠার ক্ষত সে ভুলতে পারল না।
মিরিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করার পর পল ক্লারার দিকে ফিরল। প্রথমে তারা লাজুকভাবে ছুঁল একে অপরকে। হাত ধরা, চুমু। পল আবেগে কাঁপল। শিগগিরই সে সবসময় ক্লারাকে চাইতে লাগল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার জন্য অপেক্ষা করত। রবিবারে অস্থির হতো। তারা নটিংহ্যামে হাঁটল। পল তাকে কার্নেশন ফুল দিল। গাছের নিচে তারা চুমু খেল। পল আনন্দ, বেদনা আর ক্ষুধা অনুভব করল। সে ক্লারাকে পুরোপুরি চাইত। ক্লারা নিজেকে পলের হাতে সমর্পণ করল, কিন্তু তাতে ছিল এক ধরনের বিষণ্ণতা। তার ভেতরের আত্মা যেন ভারে নত হয়ে ছিল, আনন্দের বদলে বোঝা হয়ে উঠেছিল। তবুও পল তাকে গভীরভাবে চাইত, তার প্রতি আকাঙ্ক্ষা থামাতে পারত না।
পল ক্লারাকে মায়ের সঙ্গে পরিচয় করাল। মিসেস মোরেল ভদ্র ও শান্তভাবে আচরণ করলেন, কিন্তু স্পষ্টতই কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখলেন। ক্লারা প্রথমে নার্ভাস ছিল, তবু কথোপকথন ভালোভাবেই চলল। পল নিজেকে দুই নারীর মাঝে বিভক্ত অনুভব করল—মা ছোটখাটো, ক্লান্ত হলেও ভেতরে দৃঢ়; আর ক্লারা গর্বিত, রানীর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। পল দুজনকেই ভিন্নভাবে ভালোবাসল। এদিকে বাগানে মিরিয়াম পলকে ক্লারার সঙ্গে দেখে সব বুঝে গেল। তার মনে গভীর তিক্ততা জমে উঠল। পল অপরাধবোধ অনুভব করল, কিন্তু একই সঙ্গে নিষ্ঠুরও হলো। মা আর ক্লারা মিরিয়ামের বিরুদ্ধে কথা বললেন, পল ভেতরে ঘৃণা বোধ করল, তবুও তাদের সঙ্গে সম্মতি জানাল। শেষ পর্যন্ত মিরিয়াম একা হয়ে রইল।
পল আর ক্লারার সম্পর্ক ধীরে ধীরে আরও গভীর হলো। মাঝেমধ্যেই তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। ক্লারা মিরিয়ামকে নিয়ে ঈর্ষান্বিত থাকত, আর পল বাঁধা পড়া ঘৃণা করলেও তীব্র আবেগে তাকে চুম্বন করত। তাদের রাগ আর ভালোবাসা একসঙ্গে মিশে যেত। প্রায়ই হাঁটার শেষে তারা প্রবল চুম্বনে ডুবে যেত, যেন একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারত না। একদিন থিয়েটারে ক্লারা সবুজ পোশাক পরে এল। পল তার পাশে বসে কামনায় জ্বলে উঠল। গোপনে তার হাত চুম্বন করল, রক্ত দ্রুত বইতে লাগল। নাটক ভুলে গিয়ে শুধু ক্লারাকেই ভাবল। পরে ট্রেন মিস হয়ে গেল, আর ক্লারা তাকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাল।
ক্লারার বাড়িতে তাদের দেখে ফেললেন তার মা, মিসেস র্যাডফোর্ড। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণভাষী, ঠাট্টাপূর্ণ, তবে অমায়িকও বটে। এতে পল অস্বস্তি বোধ করল আর ক্লারা লজ্জা পেল। সেদিন পল রাতে থেকে গেল। রান্নাঘরে তাদের আবার দেখা হলো। সেখানে গভীর আবেগে তারা চুম্বনে ডুবে গেল। ক্লারা নিজেকে সমর্পণ করল। মুহূর্তটি ছিল প্রবল আবেগে ভরা, প্রায় বেদনাদায়ক। পল একইসঙ্গে আনন্দ ও দুঃখ অনুভব করল। ক্লারা আবার একধরনের গর্ব ফিরে পেল। পল মিসেস র্যাডফোর্ডের সতর্ক দৃষ্টি ঘৃণা করল, তবুও ক্লারা তাকে আঁকড়ে ধরল। পল তাকে নিজের মানুষ মনে করল। তারা হাসল, ভালোবাসল, ঝগড়া করল, আবার আবেগভরে চুমু খেল। তাদের সম্পর্ক হয়ে উঠল প্রবল আবেগ আর যন্ত্রণায় জড়ানো এক বন্ধন।
শেষে পল ক্লারা ও তার মায়ের সঙ্গে ছুটির পরিকল্পনা করতে লাগল। সে রসিকতা, পরিকল্পনা আর নিজের শিল্পের স্বপ্ন মিশিয়ে চলল। ক্লারা তখন নীরব কিন্তু ভেতরে গর্বে ভরা। পল অনুভব করল, যেন আগুনের শিখার মতো সে ক্লারার সঙ্গে বাঁধা। তার আবেগ হয়ে উঠল পূর্ণ, অস্থির আর বিপজ্জনক।
(এই ১২ নম্বর অধ্যায়ে – পল মিরিয়ামকে ছেড়ে ক্লারার দিকে যায়। তাদের প্রেম পরিণত হয় আবেগ আর কামনায়। ক্লারার সঙ্গে মায়ের পরিচয় হয়; মিরিয়াম সত্য বুঝে নেয়। পল ও ক্লারার গভীর, ঝড়ো সম্পর্ক শুরু হয়।)
পার্ট-২, অধ্যায় ১৩ : ব্যাক্সটার ডজ
পলের দেখা হলো ক্লারার স্বামী ব্যাক্সটার ডজের সঙ্গে। ডজ তখন ভেঙে পড়া মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। সে অতিরিক্ত মদ খেত, প্রায়ই মারামারিতে জড়াত। কাজ হারিয়েছে, সম্মানও গেছে। লোকজনের সামনে সে পলকে বিদ্রূপ করল এবং ক্লারাকে অপমান করল। এতে পল প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ডজের মুখে বিয়ার ছুড়ে মারল। প্রায় মারামারি শুরু হয়ে যেত, কিন্তু বারমেইড এসে থামাল। পল ডজকে ঘৃণা করল, তবু তার প্রতি একধরনের করুণা অনুভব করল। পরে পল সব ক্লারাকে জানাল। ক্লারা রেগে গিয়ে বলল, ডজ নিষ্ঠুর, আর তাকে প্রতিরোধ করতে হবে। সে চাইত, পল ডজের সঙ্গে লড়াই করুক। কিন্তু পল অস্বীকার করল। সে বলল, সে এমন মানুষ নয়। ক্লারা তাকে বোকা বলল, কারণ তার চোখে পল দুর্বল ছিল। পল বাহ্যিকভাবে হেসে উড়িয়ে দিলেও ভেতরে ভেতরে অস্থির ও অশান্ত রইল।
কাজের জায়গায় ডজ আবার পলের উপর হামলা করল। সে চিৎকার করে গালি দিল। নাম ধরে ডাকল। পল উপেক্ষা করল। অবশেষে ডজ তাকে ধরে ফেলল। মিস্টার জর্ডান এলেন। ঝগড়া থেমে গেল। ডজ চাকরি হারাল। পরে আদালতে পলকে সাক্ষ্য দিতে হলো। সে থিয়েটারের ঝগড়ার কথা স্বীকার করল। ক্লারার নাম উঠল। ক্লারা রেগে গেল। সে বলল, পল তাকে লজ্জায় ফেলেছে। পল বলল, এটা গুজবের চেয়ে ভালো। তাদের প্রেম টানাপোড়েনে পড়ল। পল মায়ের সঙ্গে কথা বলল। সে স্বীকার করল, কিছু একটা ভুল আছে। সে বলল, সে কখনো পূর্ণরুপে ভালোবাসতে পারেনি। ক্লারাকে ভালো লাগে, কিন্তু গভীরভাবে নয়। সে বলল, সে কোনো নারীকে সত্যিই ভালোবাসেনি। দোষ নিজেকেই দিল। অপরাধবোধ অনুভব করল। মা চুপচাপ শুনলেন। তিনি জানতেন, পলের ভালোবাসা সবসময় মায়ের কাছেই ফিরে আসে।
পল আর ক্লারা একসঙ্গে চলতে থাকল। তারা সময় কাটাল। রাতে তারা ঘনিষ্ঠ হতো। দিনে পল এড়িয়ে চলত। ক্লারা আরও চাইত। পল বাঁধা বোধ করত। অস্থির হয়ে উঠত। ক্লারা আরও আঁকড়ে ধরত। তাদের প্রেম ঝগড়ায় পরিণত হলো। কখনো আবেগ তাদের আবার মিলিয়ে দিত। তারা খালপাড়ে হাঁটত। প্রবলভাবে চুমু খেত। তারা যেন প্রকৃতি, তারা আর বাতাসে ভেসে যেত। কিন্তু তা স্থায়ী হলো না। ক্লারা স্থায়িত্ব চাইত। পল তা দিতে পারল না। তার জীবন অর্ধেক মায়ের, অর্ধেক ক্লারার। ভেতরে ভেতরে সে পুড়ে যাচ্ছিল।
সমুদ্রতীরের ছুটি নানা অনুভূতিতে ভরা ছিল। তারা একসঙ্গে হাসল, দৌড়াল, সাঁতার কাটল আর আবেগভরে চুমু খেল। ক্লারা তখন রাজকীয়, শক্তিশালী আর ভারী লাগছিল, যা দেখে পল মুগ্ধ হলো। কিন্তু তার ভেতরে এক ধরনের দূরত্বও অনুভূত হচ্ছিল। একসময় পল ক্লারাকে জিজ্ঞেস করল, সে কি স্বামীকে তালাক দেবে? ক্লারা না বলল, কারণ সে এখনও ডজের সঙ্গে বাঁধা বোধ করত। এটা শুনে পল বুঝল, ক্লারা কখনোই পুরোপুরি তার হবে না। শেষ পর্যন্ত সে তা মেনে নিল। তারা সম্পর্ক চালিয়ে গেল, তবে ভেতরে অসম্পূর্ণতাই থেকে গেল।
আবার পলের দেখা হলো ডজের সঙ্গে অন্ধকারে। ডজ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। মারামারি শুরু হলো। ডজ তাকে প্রচণ্ড আঘাত করল। পল পাগলের মতো লড়ল। সে ডজকে চেপে ধরল। নিয়ন্ত্রণ হারাল। প্রায় পশুর মতো হয়ে গেল। তারপর ডজ তাকে মারল ভীষণভাবে। পল আহত হয়ে রক্তাক্ত হলো, প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
পল হামাগুড়ি দিয়ে ব্যথায় বাড়ি ফিরল। মাকে বলল, সাইকেলের দুর্ঘটনা। মা আরও কিছু আন্দাজ করলেন। তিনি নিঃশব্দে যত্ন করে তার সেবা করলেন। ক্লারা এল, কিন্তু পল তার প্রতি ক্লান্তি বোধ করল। মিরিয়ামও এল, কিন্তু দূরে মনে হলো। পল বুঝল, তার কাছে কেবল মা-ই গুরুত্বপূর্ণ। মা-ই তার কেন্দ্র। শিগগিরই মা অসুস্থ হলেন। পল আতঙ্কে ভরে উঠল। মাকে হারানোর ভয় পেল। মাকে আঁকড়ে ধরল। ক্লারা সান্ত্বনা দিল, কিন্তু সে জানল—কেবল মা-ই তাকে সত্যিকারের ধরে রেখেছেন। তার জীবন, তার প্রেম, তার হৃদয় সবই মায়ের কাছে ফিরে আসে।
(এই ১৩ নম্বর অধ্যায়ে – পলের লড়াই হয় ক্লারার স্বামী ব্যাক্সটার ডজের সঙ্গে। এতে ক্লারা লজ্জিত হয়, প্রেমে টানাপোড়েন আসে। পল বুঝতে পারে, সে কখনো পুরোপুরি ভালোবাসতে পারে না। শেষে মায়ের অসুস্থতা আবার তাকে মায়ের কাছেই বেঁধে ফেলে।)
পার্ট-২, অধ্যায় ১৪ : মুক্তি
পল ডাক্তার অ্যানসেলের কাছ থেকে খবর পেল। ব্যাক্সটার ডজ হাসপাতালে আছে। তার টাইফয়েড হয়েছে। সে খুব দুর্বল। চুপচাপ পড়ে আছে, কথা বলছে না। পলের অপরাধবোধ হলো। তাদের লড়াই হয়েছিল। এখন সে তাকে দেখতে চাইল। পল হাসপাতালে গেল। নার্স ডজকে ঠাট্টা নিয়ে করল। ডজকে ভীত আর তিক্ত দেখাল। পল কোমলভাবে কথা বলল। ডজ সামান্যই কথা বলল। সে নীরব, অবিশ্বাসী। তবু পল করুণা অনুভব করল। সে টেবিলে টাকা রেখে এল, যদিও ডজ নিতে চায়নি।
পল ক্লারাকে ডজের কথা বলল। ক্লারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে অপরাধবোধে ভুগল যে তাকে ছেড়ে গেছে। সে বলল, ডজ তাকে পলের চেয়ে বেশি ভালোবাসত। সে দুজনকে তুলনা করল। বলল, পল তাকে সম্মান করে না। পল তার দোষারোপে ক্লান্ত হয়ে উঠল। পরে ক্লারা ফল আর টাকা নিয়ে ডজের কাছে গেল। সে নিজেকে বিনম্র করতে চাইত। শান্তি আনতে চাইত। পল আবার ডজকে দেখতে গেল। ধীরে ধীরে অদ্ভুত এক সম্পর্ক গড়ে উঠল। তারা ড্রাফট খেলল। কম কথা বলল। তারা দুজনেই কষ্ট পাচ্ছিল। তারা দুজনেই ক্লারার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু তার কথা তারা বলল না।
এদিকে মিসেস মোরেল আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার ক্যান্সার হয়েছে। তিনি প্রতিদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলেন। পল অ্যানির সঙ্গে মিলে তার সেবা করল। তার চুল আঁচড়ে দিল, দুধ বানাল, ঘুম পাড়াল। সে মায়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিল না। মা শিশুর মতো হেসে তাকালেন। পল তাকে মরিয়া কোমলতায় ভালোবাসল। রাতগুলো দীর্ঘ হয়ে উঠল। মা দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করলেন, কোনো শব্দ করলেন না। তিনি মৃত্যুকে মানতে চাননি। করুণা চাননি। তিনি বাঁচতে চাইতেন। পল তার একগুঁয়ে সাহস দেখল। এতে তার হৃদয় ভেঙে গেল।
পল গভীরভাবে কষ্ট পেল। কাজ করতে পারল না। মাঠে ঘুরে বেড়াল। হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে উঠল। মুক্তি চাইত—মায়ের জন্যও, নিজের জন্যও। ক্লারা তাকে সান্ত্বনা দিতে পারল না। সে ভীত হলো। পলের অদ্ভুত, নীরব হতাশায় আতঙ্ক বোধ করল। মিরিয়াম চেষ্টা করল, কিন্তু পল তার চুমু ফিরিয়ে দিল। তার হৃদয়ে জায়গা ছিল শুধু মায়ের জন্য। যখন মিসেস মোরেলের অবস্থা খারাপ হলো, পল আর অ্যানি এক সিদ্ধান্ত নিল। তারা মরফিয়ার বড়ি গুঁড়ো করে তার দুধে মিশিয়ে দিল। মা শিশুর মতো বিশ্বাস করে খেলেন। বললেন, “এটা তেতো, পল।” পল তাকে সান্ত্বনা দিল। সেদিন রাতে তিনি ঘুমালেন।
শিগগিরই তার শ্বাস ভারী হয়ে এল, দীর্ঘ বিরতি হলো। অ্যানি আর পল নীরবে অপেক্ষা করল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা দেখল। অবশেষে তিনি মারা গেলেন। পল ফিসফিস করে বলল, “আমার ভালোবাসা, আমার ভালোবাসা।” সে তার দেহ আঁকড়ে ধরল। নার্স আস্তে বলল, “এখন তিনি ভালো আছেন।” পল ভেঙে পড়ল। শুন্যতা অনুভব করল। তার পিতা কাঁদলেন, কিন্তু দাবি করলেন, তিনি নিজের সর্বোচ্চ করেছেন। পল তার পিতার এই মিথ্যা শোককে ঘৃণা করল। সে মায়ের দেহ দেখল, সুন্দর, তরুণীর মতো। সে তাকে চুমু খেল, কিন্তু মুখ ঠাণ্ডা ছিল। সে তীব্রভাবে কাঁদল, ফিসফিস করে বলল, “মা, মা!”
শেষকৃত্যে প্রবল বৃষ্টি হলো। কফিন কবরের ভেতরে নেমে গেল। পল আর অ্যানি নীরবে কষ্ট সহ্য করল। জীবন ভাঙা লাগল। পল দায়িত্বের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখল, কিন্তু ভেতরে শুন্য রইল। ডজ ধীরে ধীরে সুস্থ হলো। ক্লারা শেষ পর্যন্ত তার কাছে ফিরে গেল। সে অনুরোধ করল, ডজ যেন তাকে আবার গ্রহণ করে। ডজ রাজি হলো। পল একা রইল। মা চলে গেলেন, ক্লারাও চলে গেল। জীবন শুন্য হয়ে গেল। সামনে শুধু এক অন্ধকার পথ রইল।
(এই ১৪ নম্বর অধ্যায়ে – পল হাসপাতালে অসুস্থ ডজকে দেখে করুণা অনুভব করে। ক্লারা অপরাধবোধে স্বামীর কাছে ফিরে যায়। মিসেস মোরেল দীর্ঘ যন্ত্রণার পর মারা যান, পল তার পাশে থাকে। মা আর ক্লারা দুজনকেই হারিয়ে পল একা, ভগ্ন ও শুন্য হয়ে পড়ে।)
পার্ট-২, অধ্যায় ১৫ : পরিত্যক্ত
ক্লারা স্বামীর কাছে ফিরে গেল। সে শেফিল্ডে চলে গেল। পলের আর তার সঙ্গে দেখা হলো না। পিতাও বন্ধুদের সঙ্গে থাকত। পল নটিংহ্যামে কক্ষ ভাড়া নিল। মাকে ছাড়া ঘর ফাঁকা লাগত। পলের জীবন ভেঙে পড়ল। সে আর ছবি আঁকতে পারল না। তার শেষ ছবি ছিল মায়ের মৃত্যুর দিন। তার সব ইচ্ছা নিভে গেল। ক্লারা নেই, মা-ও নেই। আর কিছুই বাকি রইল না। সে শহরে ঘুরে বেড়াত। পুরুষদের সঙ্গে মদ খেত, গল্প করত। নারীদের সঙ্গে কথা বলত, কিন্তু তাদের কোনো অর্থ ছিল না। তার মুখে অস্থিরতা, চোখে হাহাকার। তার চোখ যেন হারানো কিছু খুঁজত। জীবন অবাস্তব লাগত। রাস্তা, ঘরবাড়ি অর্থহীন লাগত। মানুষ চলত, কথা বলত, বাঁচত—কিন্তু কেন, তা সে অনুভব করতে পারত না। কেবল রাতের অন্ধকারই সত্য মনে হতো। তাতেই শান্তি পেত। কিন্তু হঠাৎ মায়ের চোখের স্মৃতি তাকে যন্ত্রণা দিত।
সময় অর্থ হারাল। দিন, সপ্তাহ, জায়গা—সব মিশে গেল। সে ভুলে যেত কী করেছে। যেন মায়ার ঘোরে ভাসত। সময় থেমে যাক, যেন আবার মায়ের সঙ্গে থাকতে পারে—এই আকাঙ্ক্ষা জাগত। এক রাতে সে একা বসেছিল। ঘর নিস্তব্ধ। সে আগুনের দিকে তাকিয়ে ছিল। দুটো ইঁদুর দৌড়াচ্ছিল। সে নড়ল না। নিজেকে অর্ধমৃত মনে হলো। অন্তরে এক কণ্ঠ বলল, “নিজেকে ধ্বংস করো।” অন্য কণ্ঠ বলল, “তার জন্য বাঁচো।” কিন্তু সে প্রতিরোধ করল। হার মানতে চাইল। তবুও তার ইচ্ছাশক্তি তাকে টেনে রাখল।
সে দিকনির্দেশ চাইছিল। কাজ করার চেষ্টা করল, ব্যর্থ হলো। মদ খেল, কোনো সান্ত্বনা পেল না। কখনো পাগলের মতো রাস্তায় ছুটল। অস্থির, হতাশ হয়ে উঠল। শান্তি চাইত, পেল শুধু বেদনা। সে মিরিয়ামের কথা ভাবল। হয়তো সে তাকে বাঁচাতে পারবে। গির্জায় গেল। তাকে গান গাইতে দেখল। মিরিয়াম যেন আশা জাগায়, স্বর্গের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি। হঠাৎ টান অনুভব করল। তাকে অনুসরণ করল। তারা একসঙ্গে হাঁটল। সে মিরিয়ামকে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানাল।
মিরিয়াম তার ঘরে এল। চারদিকে তাকাল। ঘর ফাঁকা, কঠিন। তার স্কেচ আর জিনিসপত্র দেখল। সে আগ্রহ দেখাল, কিন্তু দূরত্বও রাখল। তারা একসঙ্গে খেল। কাজ, জীবন, নারী নিয়ে কথা বলল। পল বলল, নারী কাজের প্রতি নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করতে পারে না। মিরিয়াম রেগে গেল। খাবারের পর তারা আগুনের পাশে বসল। মিরিয়ামকে এখন বয়স্ক মনে হলো। সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। তবু সে এখনও পলকে চাইত। সে বলল, “আমাদের বিয়ে করা উচিত।” মিরিয়ামের আশা ছিল, পল যেন তার জীবন নষ্ট না করে ফেলে। সে চাইত, পলকে আবার নিজের কাছে টেনে নিতে এবং ক্লারার মতো নারীর হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে।
পল দ্বিধায় ভুগছিল। তার মনে হলো, বিয়ে করলে সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে। মিরিয়াম নীরবে অনুনয় করল, হাঁটু গেড়ে প্রার্থনার মতো তার কাছে এলো। এতে পলের মনে করুণা জাগল। সে দুর্বলভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিল। কিন্তু মিরিয়াম সঙ্গে সঙ্গেই বুঝল, পল আসলে সত্যিই তা চায় না। এতে তার হৃদয় ভেঙে গেল। তবুও সে পলকে সান্ত্বনা দিল। কিন্তু পল ধীরে ধীরে সরে গেল, কারণ সে নিজেকে মিরিয়ামের হাতে পুরোপুরি দিতে পারল না। এভাবেই তাদের দীর্ঘ সম্পর্কের শেষ হলো। মিরিয়াম দুঃখে চলে গেল। পল তাকে শেষবার পৌঁছে দিল। মিরিয়াম তার দুর্বলতা আর অস্থিরতাকে ঘৃণা করল। পল ভেতরে শুন্য অনুভব করল। মিরিয়াম চিরতরে চলে গেল।
একা পল রাতের সামনে দাঁড়াল। তার চোখে ধরা দিল বিশাল নীরবতা আর অন্তহীন অন্ধকার। সে নিজেকে ক্ষুদ্র, প্রায় অর্থহীন এক সত্তা বলে অনুভব করল। মায়ের জন্য হাহাকার করে কাঁদল, এমনকি মৃত্যুর পথে তার পিছু নিতে চাইলো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নিল—মুঠি শক্ত করে বাঁধল। অন্ধকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। চোখ রাখল আলোকিত শহরের দিকে। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে গেল জীবনের পথে। মৃত্যুর টানকে অস্বীকার করে সে বেছে নিল বেঁচে থাকার পথ।
(এই ১৫ নম্বর অধ্যায়ে – ক্লারা পলকে ছেড়ে যায়, মিরিয়ামও তাকে বাঁচাতে পারে না। মা আর প্রেয়সীহীন পল শুন্য ও ভগ্ন হয়ে ভেসে বেড়ায়। মৃত্যু প্রায় টেনে নেয় তাকে। শেষমেষ সে অন্ধকার ছেড়ে জীবনের দিকে হাঁটে।)
থিমসমূহ:
মা–ছেলের সম্পর্ক এবং Oedipus Complex: Sons and Lovers উপন্যাসের প্রধান থিম হলো পল ও তার মা গারট্রুডের গভীর সম্পর্ক। গারট্রুড তার স্বামী ওয়াল্টারের সঙ্গে অসুখী ছিলেন, কারণ ওয়াল্টার ছিল রূঢ় স্বভাবের এবং অতিরিক্ত মদ খেত। তাই তিনি ভালোবাসা ও সমর্থনের জন্য ছেলেদের দিকে ঝুঁকলেন। বিশেষ করে তিনি পলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। পলও মায়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। এই ঘনিষ্ঠতা তাকে নিরাপত্তা দিলেও, একই সঙ্গে সমস্যাও তৈরি করল। মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে পল অন্য নারীদের কাছে নিজেকে পুরোপুরি দিতে পারত না। তার মিরিয়ামের প্রতি ভালোবাসা ছিল আধ্যাত্মিক, কিন্তু তার সঙ্গে পল মুক্তি অনুভব করত না। ক্লারার প্রতি তার আবেগ প্রবল ছিল, কিন্তু সেটিও অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে তার মায়ের উপস্থিতি সবসময় তার হৃদয়কে আঁকড়ে থাকত।
এটি ফ্রয়েডের Oedipus Complex তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। একজন ছেলে অবচেতনে মাকে ভালোবাসে এবং বাবাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। পলের ক্ষেত্রে, তার চোখে বাবা দুর্বল হয়ে যায়, আর মা তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। ফলে পলের অন্তর্দ্বন্দ্ব সবসময় মা ও প্রেমিকার মধ্যে টানাপোড়েনের মধ্যেই আটকে থাকে। এই থিমই উপন্যাসকে শক্তিশালী করে তোলে। এটি দেখায়, পারিবারিক ভালোবাসা যেমন সান্ত্বনা দিতে পারে, তেমনি তা বেঁধেও ফেলতে পারে। পল স্বাধীনতা চাইলেও, সে মায়ের প্রভাব থেকে বেরোতে পারে না। মায়ের মৃত্যুর পরও সে ভেঙে পড়ে, শুন্য হয়ে যায়। এই বন্ধন একদিকে ভালোবাসায় ভরা, আবার অন্যদিকে শ্বাসরুদ্ধকর।
ভালোবাসা (Love): Sons and Lovers–এ ভালোবাসা কোনোভাবেই সরল নয়। পলের প্রেমজীবন ভরা দ্বন্দ্বে। মিরিয়ামের সঙ্গে সে বই পড়ে, ভাবনা ভাগ করে, আধ্যাত্মিক আলাপ চালায়। তাদের ভালোবাসা ছিল গভীর, কিন্তু শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় শূন্য। মিরিয়াম ছিল পবিত্র ও লাজুক, আর তার সঙ্গে থাকলে পলের মনে হতো সে ভারী এক শৃঙ্খলে বাঁধা। পল তার আত্মাকে সম্মান করত, কিন্তু পুরোপুরি নিজেকে দিতে পারত না। অন্যদিকে, ক্লারার সঙ্গে পল খুঁজে পেল ভিন্ন ধরনের ভালোবাসা। ক্লারা সাহসী, দৃঢ়, আর স্বামী থেকে আলাদা থাকা এক নারী। তাদের সম্পর্ক ভরা ছিল আবেগ আর কামনায়। পল ক্লারার দেহে মুক্তি অনুভব করত, কিন্তু হৃদয়ে নয়। সে জানত, এই সম্পর্ক স্থায়ী নয়। ক্লারা এখনো স্বামীর বাঁধনে আবদ্ধ, আর পল এখনো মায়ের আঁচলে বাঁধা।
পল দাঁড়িয়ে রইল মিরিয়াম আর ক্লারার মাঝখানে। মিরিয়াম হলো আত্মার ভালোবাসা, ক্লারা হলো দেহের ভালোবাসা। কিন্তু কেউই তাকে পূর্ণ শান্তি দিতে পারল না। ভালোবাসা উপন্যাসে পরিণত হলো বেদনাদায়ক এক সংগ্রামে। এটি কখনো সম্পূর্ণ বা সুখকর হয়নি। পল সবসময় বিভক্ত অনুভব করল। এই থিম দেখায়, ভালোবাসা গড়ে ওঠে পরিবার, সমাজ আর মানসিক দ্বন্দ্বের প্রভাবে। আবার এটি দেখায়, যখন হৃদয় অন্য কারও বাঁধনে আবদ্ধ থাকে, তখন সত্যিকারের ভালোবাসা দেওয়া কতটা কঠিন হয়ে পড়ে।
পরিবার (Family): উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পরিবার। মোরেল পরিবার বাস করত এক দরিদ্র খনিশ্রমিক শহরে। বাবা ওয়াল্টার মোরেল খনিতে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন রূঢ়, মদ্যপ, আর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অক্ষম। মা গারট্রুড মোরেল ছিলেন শিক্ষিতা ও গর্বিত। স্বামীর সঙ্গে অসুখী হয়ে তিনি আবেগের আশ্রয় খুঁজলেন সন্তানদের মধ্যে। পরিবারকে প্রতিদিন লড়তে হতো টাকার সংকট আর কলহের সঙ্গে। তবু পরিবারে ভালোবাসাও ছিল প্রবল। গারট্রুড সন্তানদের সমর্থন দিতেন এবং চেয়েছিলেন তারা যেন তাদের দারিদ্র্যের জীবন থেকে উপরে উঠতে পারে। তিনি বড় ছেলে উইলিয়ামকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, আর তার অকাল মৃত্যু তাকে চূর্ণ করেছিল। এরপর তিনি সব আশা স্থাপন করলেন পলের ওপর।
পলের জন্য পরিবার হলো একই সঙ্গে আনন্দ আর বোঝা। মায়ের প্রতি তার কর্তব্যবোধ তাকে প্রেমে মুক্ত হতে দেয়নি। পরিবার হয়ে উঠল তার পৃথিবী। এটি তার সিদ্ধান্ত, তার চিন্তা আর তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করল। উপন্যাস দেখায় পরিবার একদিকে ভালোবাসা, ত্যাগ আর আশ্রয়ের জায়গা, আবার অন্যদিকে দ্বন্দ্ব আর যন্ত্রণার কেন্দ্র। পরিবারিক বাঁধন মানুষকে যেমন দিকনির্দেশ দিতে পারে, তেমনি আটকে রাখতেও পারে।
সংগ্রাম (Struggle): পুরো Sons and Lovers উপন্যাস জুড়েই রয়েছে সংগ্রামের চিত্র। মোরেল পরিবার প্রতিদিন লড়াই করেছে অর্থকষ্টের সঙ্গে। বাবা ওয়াল্টার মোরেল সামান্য আয় করতেন, কিন্তু তার বড় অংশ মদে নষ্ট করতেন। মা গারট্রুডকে লড়তে হয়েছে অসুখী দাম্পত্য জীবন আর সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে। সন্তানরাও সংগ্রাম করেছে নিজেদের জন্য ভালো জীবন গড়তে। পলের মূল সংগ্রাম ছিল তার ভেতরে। সে মায়ের প্রতি ভালোবাসা আর অন্যান্য নারীর প্রতি আকর্ষণের মধ্যে দোদুল্যমান থেকেছে। শিল্পীসত্তা আর পারিবারিক দায়িত্ব, আবেগ আর অপরাধবোধের মাঝেও তার লড়াই চলেছে। সে স্বাধীন হতে চাইত, কিন্তু পরিবারের বাঁধন তাকে ছাড়তে দিত না। এই ভেতরের দ্বন্দ্ব তার জীবনের শেষ পর্যন্ত থামেনি।
উপন্যাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম হলো শ্রেণিসংগ্রাম। মোরেল পরিবার ছিল দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণির প্রতীক। খনিশ্রমিক শহরের জীবন ছিল কঠিন—কাজ ছিল ভারী, মজুরি ছিল কম, আর ভবিষ্যতের আশা ছিল সামান্য। তবু শিক্ষার আলো আর শিল্পের প্রতি টান নতুন জীবনের সম্ভাবনা এনে দিয়েছিল। সংগ্রামের এই থিম উপন্যাসকে বাস্তব করে তোলে। এটি দেখায় জীবন কতটা কঠিন, বেদনাদায়ক এবং দ্বন্দ্বপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাশক্তিও প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত, মা-কে হারানোর শোক আর প্রেমে ব্যর্থতার কষ্ট সত্ত্বেও পল জীবনকে বেছে নেয়। তার এই সিদ্ধান্ত মানব সংগ্রামের শক্তি ও টিকে থাকার মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে।
Quotes
- “There was a feeling of misery over all the house.” – (Part I, Chapter 2 – Narrator- Personification) Atmosphere of the house
Explanation: This line describes the unhappiness in the Morel household. Walter’s drinking and quarrels create an atmosphere of constant misery. It sets the tragic tone of family life.
“সারা ঘরজুড়ে ছিল এক ধরনের দুর্দশার অনুভূতি।”
ব্যাখ্যা: মোরেল পরিবারের কলহ ও দুঃখকে এই লাইনটি প্রকাশ করে। স্বামীর মদ্যপান ও ঝগড়া ঘরে ক্রমাগত অশান্তি আনে। এটি পরিবারিক জীবনের ট্র্যাজিক আবহ তৈরি করে।
- “Each forgot everything save the hatred of the other.” – (Part I, Chapter 1 – Narrator – Conflict)
Explanation: This line shows Walter and Gertrude’s failed marriage. Their love turns into pure hatred. It highlights man–woman conflict at the heart of the novel.
“তারা দুজনেই সব ভুলে শুধু একে অপরের প্রতি ঘৃণায় ভরে উঠেছিল।”
ব্যাখ্যা: ওয়াল্টার ও গারট্রুডের ব্যর্থ দাম্পত্য জীবনকে এখানে দেখানো হয়েছে। ভালোবাসা রূপ নেয় ঘৃণায়। এটি উপন্যাসের মূল পুরুষ–নারী দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করে।
- “His [Paul] soul seemed always attentive to her [Gertrude].” – (Part I, Chapter 4 – Narrator – Mother-fixation)
Explanation: This line captures Paul’s deep attachment to his mother. His soul is bound to Gertrude, showing the Oedipus Complex theme.
“তার [পলের] আত্মা সবসময় তার [গারট্রুডের] প্রতি সজাগ থাকত।”
ব্যাখ্যা: এই লাইনটি পলের মায়ের প্রতি গভীর আসক্তি বোঝায়। তার আত্মা মায়ের সঙ্গে বাঁধা। এটি উপন্যাসের মূল থিম Oedipus Complex প্রকাশ করে।
আরো পড়ুনঃ The Grass is Singing Bangla Summary
- “He could not be free to go forward with his own life, really love another woman.” – (Part II, Chapter 13 – Narrator – Tragedy of Paul)
Explanation: This line shows Paul’s failure in love. His mother’s hold prevents him from truly loving Miriam or Clara. It reveals the tragic effect of mother-fixation.
“সে মুক্ত হতে পারল না, নিজের জীবনে এগোতে পারল না, আরেকজন নারীকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসতে পারল না।”
ব্যাখ্যা: এই লাইনটি পলের প্রেমের ব্যর্থতা দেখায়। মায়ের বাঁধন তাকে মিরিয়াম বা ক্লারাকে ভালোবাসতে দেয় না। এতে মা–ফিক্সেশনের করুণ প্রভাব প্রকাশ পায়।
- “Her [Gertrude’s] proud, honourable soul had crystallised out hard as rock.” – (Part I, Chapter 1 – Narrator –Simile, Character of Gertrude)
Explanation: This line shows Gertrude’s strength after losing faith in her husband. Her soul becomes hard, proud, and withdrawn.
“তার [গারট্রুডের] গর্বিত, সৎ আত্মা যেন পাথরের মতো কঠিন হয়ে জমে গিয়েছিল।”
ব্যাখ্যা: স্বামীর প্রতি আস্থা হারিয়ে গারট্রুডের আত্মা কঠিন ও গর্বিত হয়ে যায়। এটি তার অন্তর্দৈন্য ও দৃঢ়তা বোঝায়।
- “He was a master of skittles and of dominoes.” – (Part I, Chapter 1 – Narrator – Morel’s Weakness)
Explanation: This line highlights Walter Morel’s careless love for pub games. It symbolizes his neglect of family and waste of life.
“সে স্কিটলস আর ডমিনো খেলার ওস্তাদ ছিল।”
ব্যাখ্যা: এই লাইনটি মোরেলের খেলাধুলা ও পানশালার আসক্তিকে প্রকাশ করে। এটি তার পরিবার অবহেলা ও জীবনের অপচয়কে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে।
- “They wanted genuine intimacy, but they could not get even normally near to anyone.” – (Part II, Chapter 7 – Narrator – Theme of failed intimacy)
Explanation: This shows the tragic struggle for real closeness in relationships. Characters long for intimacy but fail, blocked by pride, fixation, or fear.
“তারা সত্যিকারের ঘনিষ্ঠতা চেয়েছিল, কিন্তু কারো সাথেই স্বাভাবিকভাবে ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি।”
ব্যাখ্যা: এখানে চরিত্রদের অন্তরঙ্গতার ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। তারা ভালোবাসা চাইলেও অহংকার, আসক্তি ও ভয়ের কারণে তা সম্ভব হয়নি।
- “She had borne so long the cruelty of belonging to him and not being claimed by him.” – (Part II, Chapter 15 – Narrator on Gertrude – Marriage conflict)
Explanation: Gertrude feels trapped in marriage. She belongs to Walter by law, but he does not value or cherish her. This highlights the cruelty of failed love.
“সে বহুদিন ধরে এই নিষ্ঠুরতা সহ্য করেছে—তার ছিল স্বামীর অধিকার, কিন্তু স্বামী তাকে নিজের বলে দাবি করেনি।”
ব্যাখ্যা: গারট্রুডের ব্যর্থ দাম্পত্য জীবন প্রকাশ পেয়েছে। আইনি ভাবে স্বামীর হলেও, ভালোবাসা ও মর্যাদা পাননি।
- “Recklessness is almost a man’s revenge on his woman.” – (Part II, Chapter 8 – Narrator – Metaphor, Gender conflict)
Explanation: Lawrence shows male recklessness as a form of revenge on women. It reflects the deep battle between man and woman in love.
“উচ্ছৃঙ্খলতা প্রায়ই একজন পুরুষের প্রতিশোধ তার নারীর ওপর।”
ব্যাখ্যা: এই লাইনটি পুরুষ–নারীর দ্বন্দ্বকে বোঝায়। পুরুষের অবহেলা বা বেপরোয়া আচরণ প্রায়শই নারীর প্রতি প্রতিশোধের রূপ নেয়।
- “Night, in which everything was lost, went reaching out, beyond stars and sun.” – (Part II, Chapter 9 – Narrator – Symbolism, Loneliness)
Explanation: This poetic line symbolizes emptiness and despair. Night becomes a metaphor for Paul’s inner darkness and loss.
“রাত্রি—যেখানে সবকিছু হারিয়ে যায়—ছুটে যায় নক্ষত্র আর সূর্যেরও ওপারে।”
ব্যাখ্যা: এখানে রাত্রিকে শূন্যতা ও হতাশার প্রতীক করা হয়েছে। এটি পলের অন্তরের অন্ধকার ও একাকিত্ব প্রকাশ করে।
- “He always ran away from the battle with himself.” – (Part I, Chapter 2 – Narrator on Paul – Inner conflict)
Explanation: Paul avoids confronting his inner struggles, his divided love, guilt, and fixation. This shows his psychological weakness.
“সে সবসময় নিজের সঙ্গে লড়াই থেকে পালিয়ে যেত।”
ব্যাখ্যা: এই লাইনটি পলের মানসিক দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে। মা, প্রেমিকা ও স্বাধীনতার টানাপোড়েন থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিত।
- “Sleep is still most perfect, in spite of hygienists, when it is shared with a beloved.” – (Part I, Chapter 4 – Narrator – Theme of intimacy)
Explanation: This line shows Lawrence’s belief in the natural closeness of love. Real intimacy is found in physical and emotional sharing.
“ঘুম তখনই সবচেয়ে নিখুঁত, স্বাস্থ্যবিদদের কথা বাদ দিলেও, যখন তা প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়।”
ব্যাখ্যা: এখানে প্রেমে প্রকৃত ঘনিষ্ঠতার ধারণা প্রকাশিত হয়েছে। মানসিক ও শারীরিক মিলনেই মানুষ সম্পূর্ণতা খুঁজে পায়।
ভাষার অলংকার
- ব্যঙ্গ (Irony): এটি তখন ঘটে যখন প্রত্যাশার বিপরীতে বাস্তবতা প্রকাশ পায়। উদাহরণ: গারট্রুড মোরেল ওয়াল্টারকে বিয়ে করেন। তিনি আশা করেছিলেন ভালোবাসা ও সুখী জীবনের। কিন্তু বিয়ে তাকে এনে দেয় দারিদ্র্য, কলহ আর অসুখী জীবন। স্বাধীনতার বদলে তিনি হয়ে পড়েন বন্দী। এটি দেখায় কিভাবে ভালোবাসা তিক্ততায় রূপ নেয় এবং পারিবারিক জীবনের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায়।
- উপমা (Simile): “like” বা “as” ব্যবহার করে তুলনা করা। উদাহরণ: পল মিরিয়ামের ভক্তিকে দেখেছিল “সন্ন্যাসিনীর মতো”। এই উপমা দেখায়, মিরিয়ামের ভালোবাসা ছিল পবিত্র ও আধ্যাত্মিক, তবে শারীরিক আবেগ থেকে দূরে।
- প্রতীকবাদ (Symbolism): কোনো বস্তু বা ঘটনার মাধ্যমে গভীর অর্থ প্রকাশ করা। উদাহরণ: খনি (pit) প্রতীক খাটুনি, অন্ধকার আর শ্রমজীবী মানুষের বন্দিত্বপূর্ণ জীবনের। এটি মোরেল পরিবারের সংগ্রামকে আকার দেয়। উদাহরণ: ফুল ও প্রকৃতি প্রতীক মিরিয়ামের আধ্যাত্মিক ভালোবাসার এবং পলের সৌন্দর্য খোঁজার আকাঙ্ক্ষার। এসব প্রতীক দমন ও আশার মধ্যে বৈপরীত্যকে ফুটিয়ে তোলে।
- খনি (পিট): সংগ্রাম ও বন্দিত্বের প্রতীক। কয়লাখনি মোরেল পরিবারের জীবনে আধিপত্য বিস্তার করে। ওয়াল্টার মোরেল সেখানে কাজ করে, সারাদিন অন্ধকার আর কঠিন শ্রমে কাটায়। খনি দারিদ্র্য, বিপদ আর শ্রমজীবী মানুষের বন্দিত্বপূর্ণ জীবনের প্রতীক। এটি দেখায়, পরিবার কোনোভাবেই শিল্পবিপ্লবের সংগ্রামের ভার থেকে পালাতে পারে না।
- ফুল ও প্রকৃতি: আধ্যাত্মিক ভালোবাসার প্রতীক। মিরিয়াম ফুল, মাঠ আর গ্রামাঞ্চল ভালোবাসে। তার কাছে একটি বুনো গোলাপ বা ড্যাফোডিল প্রায় পবিত্র। প্রকৃতি প্রতীক পবিত্রতা, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক ভালোবাসার। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, পলের প্রতি তার গভীর কিন্তু ভারী ভক্তি। পলের কাছে প্রকৃতি একই সঙ্গে অনুপ্রেরণাদায়ক আবার দমবন্ধ করা, কারণ এটি মিরিয়ামের তীব্রতাকেই প্রতিফলিত করে।
- উইলিয়ামের মৃত্যু: ভাঙা স্বপ্নের প্রতীক। উইলিয়াম, বড় ছেলে, ছিল প্রতিশ্রুতিশীল আর মায়ের গভীর প্রিয়। তার অকাল মৃত্যু শুধু পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়—এটি প্রতীক একটি ভালো জীবনের আশার ভেঙে পড়ার। উইলিয়ামের মৃত্যুর পর গারট্রুডের সব স্বপ্ন গিয়ে পড়ে পলের ওপর, ফলে পল আরও বেশি মায়ের বাঁধনে জড়িয়ে পড়ে।
- চাঁদের আলো: আকাঙ্ক্ষা ও দ্বন্দ্বের প্রতীক। যখন পল আর মিরিয়াম চাঁদের আলোয় হাঁটে, সেটি যেন তাদের ভালোবাসাকে প্রতিফলিত করে। চাঁদের আলো তাদের মুহূর্তগুলোকে সুন্দর করে তোলে, আবার টানটানও করে। এটি প্রতীক একদিকে আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক ভালোবাসা আর শারীরিক ইচ্ছার মধ্যে দ্বন্দ্বের।
Moral Lesson:
- A mother’s control can block a child’s freedom.
- Love without balance brings pain.
- Poverty breaks families apart.
- Inner conflict destroys peace.

Helpful
Great