আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব

প্রশ্নঃ আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য এবং এর প্রভাব বর্ণনা কর।

ভূমিকা: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালিদের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এ আন্দোলন পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহকে একধাপ এগিয়ে দেয়। অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগণের মধ্যে এ আন্দোলন এক নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এসব চেতনাই ক্রমে-ক্রমে পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় এ আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই অর্জিত হয় বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা।

ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য: বাঙালি জাতির প্রথম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নাম হলো আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে নিচে সকল কিছু ভালোভাবে উপস্থাপন করা হলো।

১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশঃ ১৯৪৭ সালের শুরু হওয়া পাকিস্তানের পূর্ব অংশ অর্থাৎ বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে শোষিত ও শাসিত হতে থাকে। এরপর বাঙালিরা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম বাঙালিরা তাদের জাতীয়তাকে পুঁজি করে সংঘটিত হয় সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে।

আরো পড়ুনঃ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর

২. গণতান্ত্রিক চেতনার সৃষ্টি: পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে মুষ্টিমেয় লোকের মুখের ভাষা উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার পাঁয়তারা চালায় । বাঙালিরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটি অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে রুখে দাঁড়ায় । ভাষা আন্দোলন এ সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে যে, গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ও স্বীকৃতি । যেকোনো পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হলে তা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয় । গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে বীর বাঙালি বারবার ব্যর্থ করে দেয় সকল কূটচক্র ও ষড়যন্ত্র ।

৩. রাজনীতির নতুন মেরুকরনঃ ভাষা আন্দোলন যখন থেকে শুরু হয় তখন থেকে অভিভুক্ত বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক চেতনার তথা বলতে গেলে মুসলিম লীগের বেস্ট অবদান ছিল এবং প্রভাব ছিল। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালি যে সকল মুসলমান ছিল তাদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ অনেক বেশি ঘুরতে শুরু করেছিল। বলতে গেলে ফলশ্রুতিতে উদারপন্থী দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা রাজনীতিতে একক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।

৪. মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অংশঃ ভাষা আন্দোলন এমন একটি আন্দোলন যেখানে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে এই আন্দোলনের মধ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেদের ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। এখানে সকলেই অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন এর বিজয় লাভ করে বাঙালিরা। এটা এমন একটি আন্দোলন ছিল এখানে মধ্যবিত্তরা আন্দোলনের মধ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু অন্য কোথাও মধ্যবিত্তরা অংশগ্রহণ করেন।

আরো পড়ুনঃ যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বর্ণনা কর

৫. কুসংস্কার দূরঃ ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে যত আন্দোলন এবং সংগ্রাম হয়েছিল তার মধ্যে সবচাইতে বেশি মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল আন্দোলনের মধ্যে। যার কারণে বাঙালি সমাজ এবং মুসলিম কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামী দূরীকরণে অনেক বেশি সহায়তা করে এই ভাষা আন্দোলন।

৬. ধর্মনিরপেক্ষ জাগতিক চিন্তার বিকাশ: পাকিস্তানের ধর্মীয় ভিত্তি দুর্বল করে দেয় ভাষা আন্দোলন। তদস্থলে জাতি গঠনে নিরপেক্ষ ও জাগতিক ধারণার জন্ম দেয় । ধর্ম যেকোনো জাতির ঐক্যবদ্ধতার একমাত্র প্রতীক নয়; বরং ভাষাও যে অপরিহার্য উপাদান তার স্বীকৃতি প্রথম সূচিত হয় এ আন্দোলনে । পৃথিবীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ভাষাকে কেন্দ্র করে এ জাতীয় আন্দোলনে বাঙালি জাতিই সর্বপ্রথম এ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে ।

ভাষা আন্দোলনের প্রভাব: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলা ভাষার জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভাষা আন্দোলনের প্রভাবগুলিকে নিম্নরূপ শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে:

১. ভাষাগত প্রভাব: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে বাংলা ভাষার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়তে থাকে। বাংলা ভাষার উপর গবেষণা ও উন্নয়নের কাজও বৃদ্ধি পায়।

২. সাংস্কৃতিক প্রভাব: ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের শহীদরা বাঙালি জাতির অমর বীরে পরিণত হন। তাদের স্মরণে গড়ে ওঠা শহীদ মিনার আজও বাঙালি জাতির গর্ব ও অহংকারের প্রতীক।

আরো পড়ুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ আলোচনা কর

৩. রাজনৈতিক প্রভাব: ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও গভীর প্রভাব ফেলে। এই আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতির মধ্যে ঐক্য ও সংহতির বন্ধন দৃঢ় হয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়।

৪. অন্যান্য প্রভাব: ভাষা আন্দোলনের প্রভাব শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই আন্দোলনের প্রভাবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ভাষা আন্দোলনও প্রভাবিত হয়।

উপসংহার: সবশেষে আমরা এটা বলতে পারি ভাষা আন্দোলনের জন্য লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এবং তারা সকলে বিজয় হয়েছেন। ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালির যত আন্দোলন তার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। আর তাই বাংলাদেশ সৃষ্টিতে আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *