রাষ্ট্র কী? আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি আলোচনা কর

প্রশ্নঃ রাষ্ট্র কী? আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি আলোচনা কর।

earn money

ভূমিকা: রাষ্ট্র হচ্ছে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যাকে কেন্দ্র করেই মানুষের রাজনৈতিক জীবন আবর্তিত হয়। প্রাচীন কালে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং এরিস্টটল এর কাছে রাষ্ট্র ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ গ্রিক দার্শনিকদের মতানুসারে সুন্দর ও মঙ্গলময় জীবন প্রতিষ্ঠার জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিদ্যমান। রাষ্ট্র একটি বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন হওয়ার ফলে এর উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যও ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। আর রাষ্ট্রের প্রকৃতির উপর তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ভর করে।

রাষ্ট্রের প্রামাণ্য সংজ্ঞা: রাষ্ট্র হল এমন এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস এর মতে, ‘‘একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টিই হল রাষ্ট্র।’’

অধ্যাপক গার্নারের মতে, ‘‘রাষ্ট্র হল সাধারণভাবে বৃহৎ এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যার একটি সুসংগঠিত সরকার রয়েছে এবং এই সরকারের প্রতি অধিকাংশ জনগণ স্বাভাবিক আনুগত্য প্রদর্শন করে থাকে।

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


আরো পড়ুনঃ আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর

আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি (Functions of the modern state)

জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart. Mill) আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রের প্রকৃত কার্যাবলি সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট অভিমত জ্ঞাপন করা অসম্ভব। কারণ বিভিন্ন সামাজিক অবস্থায় তা বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। সামগ্রিকভাবে জনকল্যাণই হলো রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

ক. অপরিহার্য কার্যাবলি এবং

খ. ঐচ্ছিক কার্যাবলি।

ক. অপরিহার্য কার্যাবলি (Essential functions)

যেসব কাজ সম্পন্ন না করলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয় সেগুলোকে মৌলিক বা অপরিহার্য কার্যাবলি বলে। নিম্নে রাষ্ট্রের অপরিহার্য কার্যাবলি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলোঃ

(১) প্রশাসন পরিচালনা সংক্রান্ত কাজ: রাষ্ট্রের অপরিহার্য কার্যাবলির মধ্যে প্রধান কাজ হলো প্রশাসন পরিচালনা সংক্রান্ত কার্যাবলি সম্পাদন করা। আর এজন্য সরকারকে আইন বিভাগ প্রদত্ত আইন দ্বারা শাসন বিভাগ গঠন করতে হয়। তাছাড়া সঠিকভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন, কর্মচারী নিয়োগ করা এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ।

(২) অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা: দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্র পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে থাকে। এজন্য পুলিশ বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ক্রয়, তাদের উপযুক্ত বেতন ভাতা প্রদান, অপরাধীদের জন্য জেলখানা প্রতিষ্ঠা এবং দ্রুত সাজা প্রদান ও ভোগের ব্যবস্থা রাষ্ট্র করে থাকে।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

(৩) সার্বভৌমত্ব রক্ষা: সার্বভৌমত্ব অর্জন না করলে যেমন রাষ্ট্র গঠিত হয় না, তেমনি সার্বভৌমত্ব হারালেও রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়। তাই সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজ। সার্বভৌমত্ব রক্ষা না করলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন হতে বাধ্য।

(৪) অর্থনৈতিক কাজ: রাষ্ট্রের সকল কার্যাবলি যথার্থভাবে সম্পাদন করার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া আর্থিক কার্যাবলি ছাড়া রাষ্ট্রের সার্বিক কার্যাবলি অচল হয়ে পড়ে। তাই বিভিন্ন প্রকার কর নির্ধারণ ও তা সুষ্ঠুভাবে আদায় করা আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ।

(৫) বিচারকার্য: ন্যায়বিচারের স্বার্থে রাষ্ট্রকে বিচার বিভাগ গঠন এবং সৎ ও দক্ষ বিচারক নিয়োগ করতে হয়। অর্থাৎ ন্যায়বিচার সম্পন্ন করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। আর এ ন্যায়বিচারের মাধ্যমেই কেবল অপরাধীদের শাস্তি বিধান করা এবং নিরপরাধীকে রক্ষা করা সম্ভব।

(৬) আইন প্রণয়ন: আইন প্রণয়ন, আইন পরিবর্তন বা বাতিল প্রভৃতির জন্য রাষ্ট্রকে আইন বিভাগ গঠন করতে হয়। আইনগুলো যাতে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় তার সঠিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিয়ে থাকে।

(৭) কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন: অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ। কেননা বর্তমানে কোন রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও উন্নতির জন্য প্রতিবেশী ও দূরের রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা প্রয়োজন।

(৮) জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান: রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণ যাতে অত্যন্ত নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে বাস করতে পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ। আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে।

আরো পড়ুনঃ রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দাও | আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব ও ভূমিকা আলোচনা কর।

(৯) অধিকার রক্ষা: আধুনিক রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য কাজ হলো নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা। নাগরিকের এ অধিকারগুলো তাদের জীবন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই রাষ্ট্র নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকে।

খ. ঐচ্ছিক বা গৌণ কার্যাবলি (Optional functions) 

একটি রাষ্ট্রের জন্য যেসব কার্যাবলি বাধ্যতামূলকভাবে করণীয় নয়, তবে সমাজের সার্বিক কল্যাণসাধনের জন্য করতে হয় সেগুলোকে ঐচ্ছিক কার্যাবলি বলে। নিম্নে রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

(১) শিক্ষা সংক্রান্ত কাজ: শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। তাই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ হলো শিক্ষামূলক কার্যাবলি সম্পাদন করা। আধুনিক রাষ্ট্রকে শিক্ষাবিস্তারের জন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি স্থাপন করতে হয়।

(২) সামাজিক নিরাপত্তা বিধান: সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা অপরিহার্য। রাষ্ট্র সামাজিক নিরাপত্তা বিধানেও যথেষ্ট তৎপর থাকে। এজন্য রাষ্ট্র নাগরিকদের চাকরির ব্যবস্থা করে, বয়স্কদের বার্ধক্য ভাতা প্রদান করে ও দরিদ্রদের সাহায্য করে থাকে।

(৩) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন: একটি দেশের উন্নয়ন এবং সভ্যতার মাপকাঠি হলো তার যোগাযোগ ব্যবস্থা। দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে যাতায়াত এবং যোগাযোগ যাতে দ্রুত ও আরামদায়ক হয় সেজন্য আধুনিক রাষ্ট্রগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও পুল নির্মাণ, ডাক ও তার ব্যবস্থা স্থাপন ও পরিচালনার ব্যবস্থা রাষ্ট্র করে থাকে।

আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

(৪) জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কাজ: আধুনিক রাষ্ট্র জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হাসপাতাল, শিশুসদন, মাতৃসদন, পরিবার কল্যাণকেন্দ্র প্রভৃতি স্থাপন ও পরিচালনা করে থাকে। নাগরিকের সুস্বাস্থ্য রক্ষা রাষ্ট্রের একটি অন্যতম কাজ।

(৫) শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজ: শিল্পায়ন ব্যতীত রাষ্ট্রের উন্নয়ন অসম্ভব। শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজে রাষ্ট্র সহায়তা করে থাকে। তাই নতুন নতুন শিল্প স্থাপন ও শিল্পপতিদের শিল্প স্থাপনে উৎসাহ প্রদান, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।

(৬) শ্রমিক কল্যাণ: আধুনিক রাষ্ট্র শ্রমিকদের কল্যাণে নানাবিধ কাজ সম্পাদন করে। রাষ্ট্র শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বেতন, বাড়িভাড়া, ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদান করে।

(৭) কৃষি উন্নয়ন: কৃষি তথা কৃষকদের উন্নয়নে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কৃষকদের পুনর্বাসনে রাষ্ট্র তাদেরকে ঋণ সহায়তা প্রদান, সার, কীটনাশক ও কৃষি যন্ত্রপাতি প্রদান করে থাকে।

আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্র বিভিন্ন প্রকার গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। তাছাড়া জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারতার সাথে সাথে মানুষের চিন্তাচেতনা ও ধ্যানধারণার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। যার ফলে আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলিও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জনগণের সামগ্রিক কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করা যে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক