প্রশ্নঃ বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট কী? এখানকার আর্থ-সামাজিক জীবনধারায় ভূ-প্রকৃতির প্রভাব আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি নদীমাতৃক দেশ। বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হচ্ছে বাংলাদেশ। ব-দ্বীপ গড়ে ওঠে নদীর অববাহিকায়। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী দেশটির উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এই বৃহত্তম ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছে। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের উচ্চভূমি ছাড়া সমগ্র দেশ এক বিস্তীর্ণ সমভূমি। এদেশের ভূ-খণ্ড উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু। এজন্য প্রবাহিত সব নদ-নদী এবং উপনদী-শাখা নদীগুলো উত্তরদিক হতে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য: ভূমির পার্থক্য ও গঠনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।যথা:-
১. টারশিয়ারী যুগের পাহাড় সমূহ
২. প্লাইস্টোসিনকালের সোপান সমূহ
৩. সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি।
১. টারশিয়ারী যুগের পাহাড় সমূহ: বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি মূলত সমতল হলেও, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কিছু পাহাড় রয়েছে। এই পাহাড়গুলি টারশিয়ারী যুগে হিমালয় পর্বতমালা গঠনের সময় সৃষ্টি হয়েছিল।
আরো পড়ুনঃ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পাহাড়গুলিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বলা হয়। এই পাহাড়গুলির মধ্যে রয়েছে: রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার কিছু অংশ । এই পাহাড়গুলির উচ্চতা ৫০০ থেকে ১০০০ মিটার পর্যন্ত। এগুলি প্রধানত বেলেপাথর, কর্দমশিলা এবং চুনাপাথর দ্বারা গঠিত। এখানে বাংলাদেশের বৃহত্তম পর্বত শৃঙ্গ তাজিংডং (বিজয়) অবস্থিত, যার উচ্চতা ১২৩১ মিটার। আবার বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্বত শৃঙ্গ কিউক্রাডং এই অঞ্চলেই অবস্থিত। এর উচ্চতা ১২৩০ মিটার। বর্তমানে এই অঞ্চল দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন এলাকা হিসেবে স্বীকৃত।
উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ: বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পাহাড়গুলিকে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল বলা হয়। এই পাহাড়গুলির মধ্যে রয়েছে: সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা। এই পাহাড়গুলির উচ্চতা ২০০ থেকে ১০০০ মিটার পর্যন্ত। এই পাহাড়গুলিতে লৌহ আকরিক, ইউরেনিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ের মধ্যে পার্থক্য: দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্যগুলি লক্ষ্য করা যায়:
- দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলির তুলনায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলির উচ্চতা কম।
- দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলিতে প্রধানত বেলেপাথর, কর্দমশিলা এবং চুনাপাথর পাওয়া যায়, তবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলিতে লৌহ আকরিক, ইউরেনিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়।
- দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলিতে জুম চাষ পদ্ধতি প্রচলিত, তবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলিতে প্রধানত কৃষি ও বনজ সম্পদ রয়েছে।
আরো পড়ুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ আলোচনা কর
২. প্লাইস্টোসিনকালের সোপান সমূহ: প্লাইস্টোসিনকালের সোপান হলো সেই সকল সোপান যা প্লাইস্টোসিন যুগে গঠিত হয়েছিল। প্লাইস্টোসিন যুগ ছিল প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে থেকে ১১,৭০০ বছর আগে পর্যন্ত বিস্তৃত একটি ভূতাত্ত্বিক যুগ। এই যুগে পৃথিবীতে বেশ কয়েকটি হিমবাহ যুগ সংঘটিত হয়েছিল। হিমবাহ যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা হ্রাস পেয়েছিল, ফলে নদীগুলির নতিমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে নদীগুলি তাদের উপত্যকাগুলিকে দ্রুত ক্ষয় করে দিয়েছিল। হিমবাহ যুগের অবসানে সমুদ্রপৃষ্ঠ আবার উচ্চতা লাভ করে এবং নদীগুলির ক্ষয়প্রাপ্ত উপত্যকাগুলি পলি দ্বারা ভরাট হয়ে যায়। এইভাবে প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ গঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ নিম্নরূপ: বাংলাদেশে প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূ নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যায়।
বরেন্দ্রভূমি: উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশে অবস্থিত বরেন্দ্রভূমি হলো প্লাইস্টোসিনকালের সোপানের একটি বৃহৎ অঞ্চল। রাজশাহী বিভাগের ৯৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই অঞ্চল বিস্তৃত। এটি একটি নিম্নভূমি যা পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১০০ কিলোমিটার বিস্তৃত।
আরো পড়ুনঃ যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বর্ণনা কর
মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়: মধ্য বাংলাদেশে অবস্থিত মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় হলো প্লাইস্টোসিনকালের সোপানের আরেকটি বৃহৎ অঞ্চল। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার বিস্তৃত কিছু এলাকা নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। এটি একটি উঁচু ভূমি যা উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বিস্তৃত। এই অঞ্চলের মাটির রং সাধারণত লালচে হয়ে থাকে।
লালমাই পাহাড়: কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত লালমাই পাহাড় হলো প্লাইস্টোসিনকালের সোপানের একটি ছোট অঞ্চল। কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে লালমাই থেকে ময়নামতি পর্যন্ত এই অঞ্চল বিস্তৃত। এটি একটি পাহাড়ি এলাকা যা পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১০০ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত।
প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহের বৈশিষ্ট্য:
- প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ সাধারণত স্তরে স্তরে গঠিত হয়।
- এগুলির উচ্চতা সাধারণত ১০ থেকে ২০ মিটার হয়।
- এগুলির অবক্ষেপ সাধারণত পলি, বালু, এবং কাদা দ্বারা গঠিত।
- এগুলির ভূমিরূপ সাধারণত সমতল, ঢালু, বা পাহাড়ি হতে পারে।
আরো পড়ুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ আলোচনা কর
প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহের গুরুত্ব:
- প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
- এগুলি কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত ভূমি।
- এগুলিতে বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়।
- এগুলি অঞ্চল পর্যটকদের আকর্ষন করে।
৩. সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি: টারশিয়ারি এবং প্লাইস্টোসিনকালের ভূপ্রকৃতি ছাড়াও সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ৮০% ভূমি নদীবিধৌত এবং বিস্তীর্ণ সমভূমি নিয়ে গঠিত। বছরের পর বছর বন্যার সঙ্গে পরিবাহিত মাটি সঞ্চিত হয়ে এ প্লাবন সমভূমি গঠিত হয়েছে। এর আয়তন প্রায় ১,২৪,২৬৬ বর্গকিলোমিটার। সমগ্র সমভূমির মাটির স্তর খুবই গভীর এবং খুবই উর্বর। সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
- পাদদেশীয় অঞ্চল: রংপুর ও দিনাজপুর পাদদেশীয় সমভূমি এলাকার অন্তর্ভুক্ত।
- বন্যা প্লাবন সমভূমি: ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, পাবনা, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের অন্তর্গত বন্যা প্লাবন সমভূমি।
- ব-দ্বীপ সমভূমি: ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনা ও ঢাকা অঞ্চলের অংশবিশেষ নিয়ে ব-দ্বীপ সমভূমি গঠিত।
- উপকূলীয় সমভূমি: নোয়াখালী ও ফেনী নদীর নিম্নভাগ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল হলো উপকূলীয় সমভূমি।
- শ্রোতজ সমভূমি: খুলনা ও পটুয়াখালী অঞ্চল এবং বরগুনা জেলার কিয়দাংশ নিয়ে শ্রোতজ সমভূমি গঠিত।
আরো পড়ুনঃ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি আলোচনা কর
সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমির বৈশিষ্ট্যঃ সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ভূমিরূপ গঠনের প্রক্রিয়া: ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, আত্রাই, ব্রহ্মপুত্রের শাখা-প্রশাখা ও তাদের উপনদীসমূহের প্রবাহে পলিমাটি জমা হওয়ার ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের উঁচু ভূমি ও দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে এই প্লাবনভূমি গঠিত হয়েছে।
আয়তন ও অবস্থান: বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ৭০% জুড়ে প্লাবনভূমি অবস্থিত। এর অঞ্চলের আয়তন ১,২৪,২৬৫ বর্গ কিলোমিটার। এই প্লাবনভূমি মূলত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত।
ভূমির উচ্চতা: প্লাবনভূমির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ৩০ মিটার। তবে কিছু কিছু এলাকায় এর উচ্চতা ১০০ মিটার পর্যন্ত রয়েছে।
মৃত্তিকা: প্লাবনভূমির মৃত্তিকা সাধারণত উর্বর এবং কৃষি উপযোগী। এই মৃত্তিকাতে প্রচুর পরিমাণে পলি, জৈব পদার্থ, এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস রয়েছে।
জলবায়ু: প্লাবনভূমির জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। এই এলাকায় বছরে গড় বৃষ্টিপাত হয় ২২০০ মিলিমিটার।
প্রাকৃতিক সম্পদ: প্লাবনভূমিতে প্রচুর পরিমাণে বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, এবং মৎস্য সম্পদ রয়েছে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব: প্লাবনভূমি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই এলাকায় প্রধান ফসল হলো ধান, পাট, গম, এবং শাকসবজি। এছাড়াও, প্লাবনভূমিতে প্রচুর পরিমাণে মৎস্য শিকার ও বনজ সম্পদ আহরণ করা হয়।
উপসংহার: উপরের তথ্যগুলো পর্যালোচনা করে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি দেশের আর্থ-সামাজিক অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এদেশের ভূপ্রকৃতি এদেশের জীবনধারা ও সামগ্রিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তাই এদেশের ভূপ্রকৃতিকে রক্ষায় আমাদের সজাগ থাকতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।এত সুন্দর করে প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য।।
আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালো রাখুক 🥰