প্রশ্নঃ গ্রামীণ বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা আলোচনা কর। এবং বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো আলোচনা কর।
ভূমিকা: বাংলাদেশের কৃষিতে বিরাজমান উৎপাদন সম্পর্ক বা ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থাই স্বল্প উৎপাদনের মৌলিক কারণ। বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থায় সত্যিকার কৃষকগণ উৎপাদন কাজে অংশ গ্রহন নিরুৎসাহিত হয়। তারা অনুপস্থিত ভূ-স্বামী ও জোতদার কর্তৃক প্রতারিত ও শোষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও এদেশে সুষ্ঠু ভূমি স্বত্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।
ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা: ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা বলতে ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার ও ধাঁচকে বুঝায়। এই অধিকারের মধ্যে জমি ব্যবহার করার এবং ব্যবহার না করার অধিকার, ভূমি থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের উপর অধিকার এবং ভূমি অথবা উৎপাদিত দ্রব্য অন্যের কাছে হস্তান্তর করার অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকে। ভূমির উপর অধিকার গ্রামাঞ্চলে মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনেকাংশে নির্ধারণ করে।
আরো পড়ুনঃ Previous Year Brief Bangladesh Sociology
বাংলাদেশে বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা: বাংলাদেশে বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা ১৯৫০ এর পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইনের ফল। এই আইনের বলে রায়ত জমির পূর্ণ স্বত্ব লাভ করে। এই স্বত্ব স্থায়ী, বংশানুক্রমিক ও হস্তান্তরযোগ্য। পরবর্তীকালে ১৯৭২ ও ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার নীতি এবং বিভিনড়ব সময়ে ভূমিস্বত্ব সম্পর্কিত জারীকৃত সরকারী আইনের মাধ্যমে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা বর্তমান রূপ নেয়। ভূমিস্বত্বের ভিত্তিতে আইনের মাধ্যমে ভূমিস্বত্ব ভিত্তিতে বর্তমানে ৪ রকম কৃষক পরিবার দেখা দেয় :
ক. মালিক কৃষক − যারা নিজেই নিজের জমি চাষ করে। কাউকে বর্গা দেয়না বা কারো কাছ থেকে বর্গা নেয়ও না।
খ. মালিক বর্গা কৃষক − যারা নিজের জমি চাষ করে। কিন্ত প্রয়োজনে অন্যের জমি বর্গা নেয় কিংবা নিজের জমি বর্গা দেয়।
গ. বর্গাচাষী − যারা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে।
ঘ. অনুপস্থিত ভূস্বামী − যারা নিজে জমি চাষ করেনা। বিভিনড়ব শর্তে অন্যকে দিয়ে নিজের জমি চাষ করায়।
১৯৯৬ সালের এক উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে কৃষক পরিবারের শতকরা ৬.৪ অংশ মালিক কৃষক এবং এরা ৫৮.৪% জমির মালিক। মালিক বর্গা কৃষক পরিবারের সংখ্যা শতকরা ৩৫.৫ অংশ এবং এরা ৩৯.৭% ভূমির মালিক। বর্গাচাষী পরিবারের সংখ্যা শতকরা ৩.৫ ভাগ এবং এদের চাষাধীন জমির পরিমাণ মোট জমির ১.৯%।
বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ: বাংলাদেশের বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ নিচে আলোচনা করা হল :
১. জমির অসম বন্টন: বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার একটি উলে−খযোগ্য ত্রুটি হল জমির অসম বন্টন। ১৯৯৫ সনের এক উপাত্ত থেকে দেখা যায় শতকরা ৪ ভাগ কৃষক পরিবার (যেসব পরিবারের মালিকানাধীন জমির পরিমাণ ৭.৫ একরের বেশি) মোট জমির ২০.৭ অংশের মালিক। অন্যদিকে শতকরা ৭২.৭ ভাগ কৃষক পরিবার শতকরা ৩৬.৮ ভাগ জমির মালিক।
২. ভূমিহীন কৃষক: ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার আরেকটি ত্রুটি হল ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক বিভিনড়ব কারণে জমি হারিয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে।
৩. বর্গাচাষ: ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার আরেকটি ত্রুটি হল বর্গাচাষ। ভূমি সংস্কার আইনে বর্গাচাষীদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ হয় না। ফলে বর্গাচাষীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভোগেন।
আরো পড়ুনঃ Bangladesh Sociology Special Brief Suggestion
৪. অনুপস্থিত মালিক: কৃষি জমির অনুপস্থিত মালিকগণ বগাধারী বা রায়তওয়ারী ব্যবস্থায় জমি চাষ করান। এর ফলে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়েনা। তছাড়া অনুপস্থিত কৃষক জমি কেনার ফলে জমির চাহিদা বাড়ে এবং ফলে দাম বাড়ে। ক্ষুদ্র কৃষক উঁচু দামে জমি কিনতে সক্ষম হয়না।
কৃষি উৎপাদনে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার প্রভাব: কৃষি উৎপাদনে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার প্রভাবসমূহ নিচে আলোচনা করা হল।
১. কম উৎপাদন: ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ফলে জমির অসম বন্টন হয়। বড় কৃষক ও মাঝারি কৃষকেরা ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা পায়। কিন্তু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ঋণের কাম্য সুবিধা পায়না। ফলে উৎপাদন আশানুরূপ হয়না। তবে বাংলাদেশে উষ্ণশী প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা যায় ক্ষুদ্র কৃষকেরাও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
২. উনড়বয়ন কর্মসূচীর সুবিধা: অসম ভূমি বন্টন অসম আয়ের জন্ম দেয়। আয় ও সম্পদের অসমতা গ্রামাঞ্চলে একটি ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বড় কৃষকদের হাতে থাকে। এর ফলে উনড়বয়নমূলক কর্মসূচীর সুবিধা ছোট কৃষক অপেক্ষা বড় কৃষকেরা বেশি ভোগ করতে পারে। ফলে কৃষি উৎপাদনের উপর উনড়বয়নের সার্বিক প্রভাব কম হয়।
৩. বর্গাচাষ: বর্গাচাষ প্রার ফলে জমির অপেক্ষাকৃত ভাল ব্যবহার হয়। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত জমি মালিক নিজে যে ব্যবহার করতে সক্ষম বর্গাচাষী তার চেয়ে ভাল ব্যবহার করে। এজন্যই মালিক বর্গাচাষীকে জমি বর্গা দেয়। কিন্তু বর্গাচাষীর কার্যকরী আইনগত নিরাপত্তা না থাকায় সে সর্বোত্তম উপকরণ ব্যবহার করে না। ফলে উৎপাদন কম হয়।
৪. অনুপস্থিত মালিক: অনুপস্থিত মালিক অনেক সময় তদারককারী ও শ্রমিক দ্বারা জমি চাষ করায়। ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধান না করায় শ্রমিক কম কাজ করতে পারে এবং ফলে উৎপাদন কম হয়।
৫. বিপণন: ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ফসলের উপর দাদন নিতে পারে। কিংবা অর্থের প্রয়োজনে ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে তা বিμয় করে দেয়। ফলে সে ফসলের লাভজনক দাম পায় না।
উপসংহার: আলোচনার পরিশেসে বলা যায় যে, ভূমি স্বত্ব ব্যবস্থা হরো ভূমির মালিকানা ও ব্যবহার সম্পর্কিত আইনকানুন। অতীতের মত বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায়ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা বিদ্যমান। এ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষক এবং মালিক উভয়ই উপকৃত হয়।