প্রশ্নঃ গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলতে কি বুঝ? গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদানসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি গ্রামপ্রধান দেশ। এদেশের শতকরা আশি ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। গ্রামকে কেন্দ্র করেই আমাদের সমাজে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। এ গ্রামীণ নিম্নবিত্ত মানুষের মুখপাত্র হিসেবেই গ্রামের কিছু ব্যক্তি যারা সম্পদশালী, শিক্ষিত ও ব্যক্তিগত গুণাবলির অধিকারী অথবা বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন এ শ্রেণিকে নিয়েই আমাদের দেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো গড়ে ওঠে।
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো: ক্ষমতা কাঠামো একটি ব্যাপক ধারণা। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলতে আমরা বুঝি যে ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামের মানুষের অধিকার ও শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত ক্ষমতা বলতে একটি শক্তিকে বুঝায় যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার সিদ্ধান্তকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। ক্ষমতা কাঠামো নির্ভর করে প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপর। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি গ্রাম প্রধান দেশ। আমাদের সামাজিক কাঠামোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা তা অনেক দেশের চেয়ে ভিন্নতর।
আরো পড়ুনঃ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
মার্কসের মতে, “গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থান তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপে শ্রেণিসমূহের ভূমিকা, যা গ্রাম সমাজের কাঠামোর মধ্যে বিস্তার লাভ করে, তাই হচ্ছে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো।”
ওয়েবারের মতে, “গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় যারা কর্তব্য স্থাপন করে আর কিরূপে সে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কোনো কোনো উপাদানের সাহায্যে এগুলো সংঘটিত হয় এর সমন্বয়ই হচ্ছে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো।”
ড. আতিউর রহমান তাঁর ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের সংগ্রাম’ গ্রন্থে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলতে বুঝিয়েছেন, “শ্রেণিসমূহের অবস্থান পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এদের ভূমিকা ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ সামাজিক যুক্তিসমূহ যেসব কাঠামোর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় বা হয়ে থাকে, তাকে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলা হয়।”
আরো পড়ুনঃ সামাজিকীকরণ বলতে কি বুঝ? সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর।
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদান বা উৎসসমূহ: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদনসমূহ নিম্নরূপ :
১. ভূমি মালিকানা: ভূমি মালিকানা হচ্ছে গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতা কাঠামোর একটা মৌলিক উপাদান। এ দেশের বৃহৎ ভূমি মালিকানা বর্গাচাষি ও দিনমজুরদের উপর ক্ষমতা খাটিয়ে থাকে। এভাবে দেখা যায়, একজন ভূস্বামী অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী এবং অনেক লোকই তার নিয়ন্ত্রণাধীন।
২. অর্থনৈতিক শক্তি: অর্থনৈতিক শক্তি ও এদেশের গ্রামীণ সমাজকাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অর্থনৈতিক শক্তি গড়ে উঠে কৃষি ও অকৃষিখাতের সমন্বয়ে। গ্রামীণ পরিবারে অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারীরা সাধারণত অন্যান্য পরিবারের সদস্যদেরকে নিজেদের ক্ষমতার আওতার মধ্যে ধরে রাখতে পারে।
৩. সমাজে নেতৃত্ব দান: গ্রাম সমাজের নেতৃত্বদানে গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকা খুবই অগ্রগণ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিক ভূমির মালিকরাই গ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে ।
৪. বংশীয় ক্ষমতা: বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে বৃহৎ বংশের লোকেরা যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে। কেননা তাদের থাকে এক বিরাট জনবল। উচ্চবংশ পরিবারগুলো অন্যান্য পরিবারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
আরো পড়ুনঃ সমকালীন বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর নগরায়নের প্রভাব আলোচনা কর।
৫. জাতিগোষ্ঠী: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উৎস হিসেব জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব উল্লেখ করা যায়। এ দেশের গ্রাম প্রশাসনের নিকটতম প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। সাধারণভাবে দেখা যায়, এসব সামাজিক প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব করার জন্য প্রয়োজন অধিক পরিমাণে আত্মীয়স্বজনের সাহায্য। তাই যাদের আত্মীয়স্বজন বেশি তারাই জয়লাভ করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর মূল উৎস হচ্ছে ভূমি। ভূমি মালিকানার উপর নির্ভর করেই গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো গড়ে উঠে। ঐতিহ্যগতভাবে গ্রাম পর্যায়ে বাংলাদেশে বৃহৎ ভূমি গোষ্ঠী নেতৃত্ব দিয়ে থাকে এবং তারাই গ্রামে ক্ষমতা প্রয়োগ করে আসছে।