প্রশ্নঃ জনমতের সংজ্ঞা দাও। জনমত গঠনের উপায়/মাধ্যম সমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: সাধারণভাবে জনসাধারণের মতমতকেই বলে জনমত। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জনমতকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। সমাজের এক বা একাধিক বিষয়ে জনসাধারণের সুস্পষ্ট মতামতকে জনমত বলে। কোনো সরকার বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে না। জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে কতগুলো মাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসকল মাধ্যম যদি শক্তিশালী হয় তবে সুস্থ জনমত গঠন করা সম্ভব হয়। জনমত সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্র দার্শনিক বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
জনমতের প্রামাণ্য সংজ্ঞা: জে. এস. মিল এর মতে, “কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় সমস্যার উপর জনগণের সংগঠিত অভিমতের নাম জনমত।”
লর্ড ব্রাইস বলেন, “জনমত হচ্ছে সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের অভিতের সমষ্টি।”
জিনসবার্গের মতে, “জনমত হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন মতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল।”
মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ কিমবল ইয়ং বলেন, “কোন নির্দিষ্ট সময়ে জনগণ যে মতামত প্রকাশ করে তাই জনমত।”
আরো পড়ুনঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
কিন্তু জনমত বলতে জনসাধারণের সাধারণ মতামতকে বুঝায় না। কারণ প্রতিদিন জনগণ বিচ্ছিন্নভাবে হাজারো রকমের মতামত ব্যক্ত করে। এই সব মতামতের সবগুলো জনমত নয়। জনসাধারণের যে মতামত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে তাই জনমত হিসেবে বিবেচিত হয়।
জনমত গঠনের মাধ্যমসমূহঃ গণতন্ত্রের সাফল্যের মূলভিত্তি হলো সুস্থ ও সুচিন্তিত জনমত। আর এ জনমত প্রকাশের ক্ষেত্রে কতকগুলো মাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ যা নিম্নরূপঃ
১. পরিবারঃ মানুষের জনমতের প্রথম বাহন হলো পরিবার। পরিবারে মানুষ প্রথম বাবা, মা, ভাই বোনের মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ প্রভাব ভবিষ্যতে রাজনৈতিক মতামত গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে পরিবারের মধ্যেই ব্যক্তি প্রথম বিভিন্ন মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানঃ জনমত গঠনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল আলোচনার পাশাপাশি আরো অনেক বিষয়ে আলোচনা করা হয়, সেসব আলোচনায় দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় স্থান পায় এর ফলে ছাত্রদের মাঝে এসব বিষয়ে সাম্যক ধারণা জন্মায়।
৩. আইনসভাঃ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে আইনসভা গঠিত হয়। আইনসভায় সরকারি দল ও বিরোধী দল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক করে থাকে ফলে এসব বিষয় থেকে মানুষের মাঝে জনমতের জন্ম নেয় ৷
৪. সংবাদপত্রঃ বর্তমান যুগে জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। সংবাদপত্রে দেশের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তাছাড়া জনগণের বিভিন্ন ধরনের মতামত এখানে স্থান পায় ফলে জনগণের মতামতগুলো সহজে সরকার জানতে পারে।
৫. বেতার, চলচ্চিত্র ও দূরদর্শনঃ বেতার প্রচারের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত সর্বশেষ খবর দেশের সর্বত্র তড়িৎ গতিতে পৌঁছে দেয়া হয়। বেতারের মত চলচ্চিত্রও সর্বসাধারণের মধ্যে সংবাদ ও তথ্যাদি পরিবেশনের ব্যাপারে এক অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। জনগণের মধ্যে বেতার ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জনগণের মধ্যে এদের প্রভাবও ক্রমশ বাড়ছে।
৬. ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাঃ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জনমত গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষ তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বিষয়ে তাদের মতামত গঠন করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যদি একটি নির্দিষ্ট পণ্য ব্যবহার করে এবং সেটি পছন্দ করে, তাহলে সে সেই পণ্য সম্পর্কে ইতিবাচক মতামত তৈরি করতে পারে।
৭. গোষ্ঠী প্রভাবঃ গোষ্ঠী প্রভাব জনমত গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষ প্রায়ই তাদের সামাজিক গোষ্ঠীর মতামত অনুসরণ করে। এই প্রভাবকে সামাজিক চাপ বা সামাজিক অনুমোদন হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই একই রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে।
আরো পড়ুনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর।
৮. রাজনৈতিক দলঃ রাজনৈতিক দল জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জনমত গঠন করে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জনমত গঠন করে। রাজনৈতিক দল প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচি দিয়ে থাকে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সভা-সমাবেশ, দলীয় ইশতেহার, পোস্টার ব্যানার ফেস্টুনসহ নানা মাধ্যমে নিজস্ব বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। এর ফলে জনগণ দেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করে। বিষয়গুলো যুক্তিসংগত মনে হলে দলটির পক্ষে জনমত গড়ে উঠে।
৯. সভা-সমিতিঃ সভা-সমিতি জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সভা-সমিতিতে বিশেষ করে রাজনৈতিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করে জনগণ দেশের বিদ্যমান বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয় যার ভিত্তিতে একটি পর্যায়ে এসে উক্ত বিষয়ে জনমত গড়ে উঠে। আজ থেকে দেড় দশক পূর্বেও সভা-সমিতিই ছিল প্রচার ও জনমত গঠনের প্রধান মাধ্যম। বর্তমানে মিডিয়া সে স্থান ক্রমাগত দখল করে নিচ্ছে।
১০. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমঃ বর্তমানে ফেইসবুক, স্কাইপ, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনমত গঠনে বেশ ভূমিকা রাখে। যেকোন ঘটনা ফেইসবুক, টুইটারে মুহুর্তে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্নভাবে মানুষকে সংযুক্ত করে এই ধারাটিই এক সময় বৃহৎ জনমতে রুপান্তরিত হয়। ২০১৫ এপ্রিলে সিলেটে শিশু রাজন হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক জনমত সংগঠিত হতে দেখা গেছে। রাজনকে নির্মমভাবে অত্যাচার করে হত্যার দৃশ্য ফেইসবুকের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার হত্যার বিচারের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। জনমতের চাপে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করে বলে অনেকে মনে করেন।
১১. ধর্মীয় সংঘঃ জনমত গঠনে ধর্মীয় সংঘগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা ধর্মীয় সংঘগুলোর আলোচনা ও উপদেশ জনগণকে অনেকটা প্রভাবিত করে থাকে। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে জনমত গঠন হয়।
১২. রেডিও-টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রঃ জনমত গঠনের অন্য এক প্রকার মাধ্যম হল রেডিও-টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র। এসব মাধ্যমগুলো জনগণের মাঝে খবর প্রচার ও বিনোদন পরিবেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সচেতনামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে জনমত গড়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান আমলে জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান প্রমুখ চিত্র পরিচালকরা পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিতবাহী চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে ছিলেন।
১৩. আইন পরিষদঃ আইন পরিষদের অধিবেশন থেকে অনেক বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা যায়। সেখানে সংসদ সদস্যদের বক্তব্য থেকেও জনমত গড়ে উঠে।
১৪. সাহিত্যঃ সাহিত্যও জনমত গঠনে অনেক সময় ভূমিকা পালন করে। যেমন, রুশো, ভলটেয়ার প্রমুখের লেখনী দ্বারা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
আরো পড়ুনঃ প্রথা বলতে কী বোঝো? বৃটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথা কেন মান্য করা হয়?
উপসংহারঃ আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে আমরা বলতে পারি, সুষ্ঠু জনমত গঠনের জন্য জনমতের উপর্যুক্ত মাধ্যমগুলোর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু উপর্যুক্ত মাধ্যমগুলো যেন সময় উপযোগী জনমত গড়ে তুলতে পারে সেজন্য তাদের সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।