প্রশ্নঃ নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: নারীর ক্ষমতায়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং অবিভাজ্য ধারণাবিশেষ। এক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়নের দু’টি শর্ত পূরণ হলেই নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে বলে মনে করা হয়। কিন্তু উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ফসল হিসেবে নারী সচেতনায়িত হলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সরকারি নীতিনির্ধারণে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত না হওয়ায় নারীর প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হয় নি। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হবে। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।
নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নীতিসমূহ: ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদন নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় অর্জন। এ নীতিমালা জাতীয়, স্থানীয় ও পারিবারিক পর্যায়ে নারী ইস্যুকে মূল ধারায় নিয়ে আসার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। নিম্ন ৷ গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা করা হলো :
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায়সমূহ আলোচনা কর।
১. পারিবারিক, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নারীর উপর গুরুত্ব: জাতীয়, জেলা,উপজেলা ও তৃর্ণমূল পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা শক্তিশালীকরণ করতে হবে। জাতীয় মেশিনারিকে শক্তিশালীকরণ করা, NGO এববৃহত্তর সুশীল সমাজের মধ্যে আরও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গঠন করা। নারী উন্নয়নের জন্য জেন্ডার ইস্যু নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা। জেন্ডারকে মূলধারা করতে সহায়তার জন্য প্রকল্প কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সকল স্তরে সক্ষমতা গঠন। জেন্ডার ইস্যু সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সকল পর্যায়ে Advocacy ও Lobbing এবংগণতৎপরতা চালানো।জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নেটওয়ার্কিং এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি পরিচালনা করা।
২. কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন: নারী উন্নয়নকে জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা। পরিবার, সমাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমান ভূমিকা পালনসহ নারীকে উন্নয়নের সমান অংশীদাররূপে প্রতিষ্ঠা করা। নীতিমালা সংস্কার ও জোরালো ইতিবাচক কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীর সমান অধিকার চর্চায় বাধাদানকারী সকল আইনগত, অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক বাধা অপসারণ করা। নারীর ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ ও অগ্রাধিকার সম্বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি বা বৃদ্ধি এবং নারীর
অবস্থা ও অবস্থানের উন্নয়ন সাধনের অঙ্গীকার সুদৃঢ়করণ ।
৩. উইড ফোকাল পয়েন্ট: নারী উন্নয়নের জাতীয় মেকানিজমের অন্যতম গুরুত্ববাহী অংশ হচ্ছে WID Focal pionts. মন্ত্রণালয়গুলো ইতোমধ্যে উইড ফোকাল পয়েন্ট, অ্যাসোসিয়েট ফোকাল পয়েন্ট প্রয়োগ করেছে। বেইজিং সম্মেলনের পর এ উইড ফোকাল পয়েন্টকে বিস্তৃত শক্তিশালী করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এজেন্সিসমূহের নীতিনির্ধারণী কাঠামোতে নারীকে সরাসরি নিয়োগ দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমন- বিগত সরকারের আমলে তিনজন নারীকে কূটনীতিবিদ, তিনজনকে যুগ্মসচিব ও একজনকে হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৪. রাজনীতিতে নারী: বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে নারী অবস্থানের যে বাস্তবতা তা পরস্পরবিরোধী। কেননা, বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতা কাঠামোয় প্রধানমন্ত্রী একজন নারী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীও একজন নারী। সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্তরে এ দু’নেত্রীর প্রাধান্য ব্যাপক দৃশ্যমান হলেও সার্বিকভাবে বিরাজ করছে শূন্যতা। স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়, বিশেষ করে কাঠামোগত রাজনীতিতে নারীর অবস্থান তেমন ব্যাপক ও ক্ষমতা সংহতকরণে কার্যকর নয়।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি মূল্যায়ন কর।
৬. মন্ত্রিসভায় নারী: বর্তমানে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীসহ ৫জন মহিলা মন্ত্রী অধিষ্ঠিত আছেন । বাংলাদেশের ইতিহাসে মহিলা মন্ত্রিগণ বা গুরুত্বপূর্ণ বলে সচরাচর বিবেচিত নয় তবুও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন।
৭. প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে নারী: আধুনিককালে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি প্রশাসনের সাথেই বেশি জড়িত। বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের শীর্ষ পর্যায়ের পদসমূহে এখনও নারী তেমন একটা নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারে নি। অথচ নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা, উদ্দেশ্য এবং আন্তরিক ইচ্ছার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনায় উচ্চস্তরে সংযোজিত হওয়া প্রয়োজন। নিম্নে বাংলাদেশের প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে নারী অংশগ্রহণের হার তুলে ধরা হলো :
৮. আইনসভায় নারী: প্রথম সংসদ থেকে অষ্টম সংসদ পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনে মোট ২০৩ জন মহিলা সদস্য মনোনীত হয়েছে। এদের মধ্যে একাধিকবার সংসদ সদস্য হয়েছেন আটজন। সংসদীয় এ সংরক্ষণ ব্যবস্থা রাজনীতিতে নারীর আগমন ত্বরান্বিত করেছে এমন কথা বলা যাবে না। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচিত নারী সাংসদ ছিলেন মাত্র সাতজন। ২০০১ সালের নির্বাচনে ছয়জন, পরবর্তীতে উপ-নির্বাচনে একজন নির্বাচিত হন। বর্তমানে সংসদে সংরক্ষিত আসনগুলো বিলুপ্ত। বর্তমানে নারীদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত হয়েছে। এছাড়া সাধারণ আসনে ২৮জন মহিলা সংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।
৯. ইউনিয়ন পরিষদে নারী: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বনিম্ন প্রশাসনিক স্তর হচ্ছে স্থানীয় সরকার। ইউনিয়ন পরিষদে নারী ও পুরুষ উভয়ের সমান অংশগ্রহণ ও সঠিক প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রবর্তিত হয় একটি নতুন আইন। এতে নারীদের তিনটি সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে নারীর ক্ষমতায়নে এটি একটি বিরাট অর্জন। ১৯৯৭ সালের নির্বাচনেই প্রথম মহিলারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
আরো পড়ুনঃ গ্রামীণ বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা আলোচনা কর।
১০. সংরক্ষিত নারী আসন ও নির্বাচন: বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে নারী ও পুরুষের মধ্যে ভিন্নতা নেই। ভোটের অধিকার, সমিতি ও সংস্থার অধিকার, প্রতিনিধি হওয়ার সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে সংবিধান নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে নি। সংবিধান জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংরক্ষিত আসনের বিধান করেছিল। সংবিধানে নারীর প্রতিনিধিত্ব প্রেরণে সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা নারীর প্রতি সমাজের অধস্তন মূল্যবোধ তথা জেন্ডার বৈষম্য লালনের একটি প্রয়াস ছিল বলা যায়।
মূল্যায়ন: পৃথিবীর বহু দেশে সংরক্ষিত আসন ছাড়াই মহিলারা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। শ্রীলংকার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধী, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো, ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সবাই সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তাহলে আমাদের নারী নেত্রীদের ক্ষেত্রে আপত্তি কেন? তবে এক্ষেত্রে বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সংসদে নারীর সমাজের পশ্চাৎপদ শ্রেণি হিসেবে নারীর আসন সংরক্ষণ হতো দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। এতে বলা যায় যে, ক্ষমতায়ন না হয়ে দলের ক্ষমতায়ন হতো। কারণ এ ধরনের একটি ব্যবস্থায় নারী ব্যবহৃত হতো ক্ষমতা সংহতকরণের কৌশল হিসেবে, সরাসরি নির্বাচনের দাবি তাই যুগোপযোগী বলা যায়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ক্ষমতা কাঠামো ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অবস্থান ও অংশগ্রহণের চিত্র নির্ধারণের এ বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, সর্বক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়নে একটি প্রতীকী বৃদ্ধি ঘটেছে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার নারীদের উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।