fbpx

বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায়সমূহ আলোচনা কর।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায়সমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা: বাংলাদেশে যেসব সামাজিক সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে দুর্নীতি বোধ হয় সবচেয়ে মারাত্মক- কারণ এই ব্যাধি সানসিক এবং তা সারানো খুব সহজ নয়। দুর্নীতিই আজ এক শ্রেণীর মানুষের কাছে নীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে, সমাজের একেবারে নিচের স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি তার থাবা বিস্তার করেছে। এ অবস্থায় জাতীয় উন্নয়নে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত না হয়ে পারে না।

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রূপ: বাংলাদেশ সীমাহীন দুর্নীতির আবর্তে নিমজ্জিত। সে দুর্নীতির অবস্থান দেখা যায় সর্বত্র। ঋণ নিয়ে বেমালুম হজম করে ফেলা, সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করা, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস চুরি, আয়কর-বিক্রয়কর ও শুল্ক ফাঁকি দেওয়া, চাকরির নামে হায় হায় কোম্পানি খোলা, হীনস্বার্থে শেয়ার-বাজার কারচুপি, চোরাচালানি, কালোবাজারি, ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েস- দুর্নীতি কোথায় নেই? এমনকী দুঃস্থ মায়েদের জন্যে বরাদ্ধকৃত গম নিয়ে, এতিমখানার এতিমদের জন্যে বরাদ্দকৃত বস্ত্র নিয়ে, দুর্গত মানুষের জন্যে বরাদ্দকৃত ত্রাণের টিন নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে। পরীক্ষার হলেও দুর্নীতি আধিপত্য বিস্তার করছে। ভাবা যায় না, মেধা তালিকায় স্থান নির্ধারণেও চলে দুর্নীতি। 

সরকার দুর্নীতি দমন সংস্থা করেছেন দুর্নীতি সামাল দিতে। কিন্তু বিগত সরকারগুলোর আমলে দেখা যায়, দুর্নীতির ভূত সেখানেও আছর গেড়েছে। অসহায় মানুষ সেখানে ন্যায় বিচার আশা করে, সেই বিচার ব্যবস্থায় আইনের শাসনের হাত-পা ভেঙে দিয়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রূপের জন্য সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের সারিতে। ব্যাপক দুর্নীতির জন্য দেশবাসীরেক উচ্চমূল্য দিয়ে বিপুল ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির ভয়াবহ ছোবলে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবন জর্জরিত। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সবকিছুকেই কলুষিত করেছে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মামলাবাজি, টোলবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়েছে সন্ত্রাসী চরিত্র, যাকে বলা চলে সন্ত্রাসী দুর্নীতি।

আরো পড়ুনঃ Previous Year Brief Bangladesh Sociology

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


দুর্নীতি উন্নয়নের অন্তরায়: বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির এক উজ্জ্বল দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। মাথাপিছু বার্ষিক আয় দ্বিগুণ করা, সমৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করার অনেক সুযোগ এখন আমাদের সামনে এসেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ফলে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সার্বিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, লণ্ঠিত হচ্ছে দেশের মূল্যবান সম্পদ, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে সেগুলো পাচার করা হচ্ছে বিদেশে। জনগণের দুঃখ ও দারিদ্র্যের অবসান তো দূরের কথা, তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সৃষ্টি হচ্ছে বিপুল ধনবৈষম্য। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে দুর্নীতিকে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দুর্নীতির মূলোৎপাটন: দুঃখের ও লজ্জার বিষয় হল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্দেশিকায় সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় প্রথম সারির নিন্দিত স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। এ গ্লানি দূর করার জন্যে সমগ্র জাতির সামনে এখন অন্যতম প্রধান করণীয় হচ্ছে দুর্নীতির মূলোৎপাটন। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক রূপান্তর ছাড়া এই দুর্নীতির ঘুণ থেকে আমাদের রেহাই নেই। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, দুর্নীতি বিরোধী গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে আগামীতে হয়ত এই সম্ভাবনার পথ খুলে যাবে।

দুর্নীতির প্রতিকার ও প্রতিরােধ: আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র তথা জাতিকে সমৃদ্ধশালী করতে প্রথমেই দেশ থেকে দুর্নীতিকে নির্মূল করতে হবে। আর তার জন্যে প্রয়ােজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলা। এই প্রতিরােধ প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক— এই দুভাবে করা যেতে পারে। যেমন—

ক. প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরােধ : প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরােধ দুই রকমের হতে পারে-

১. দুদক: বাংলাদেশ সরকার দেশ থেকে দুর্নীতিকে নির্মূল করতে ২০০৪ সালে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠন করেছে। দুদক বর্তমানে সফলভাবে পরিচালিত হলেও এটিকে আরও শক্তিশালীরূপে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে আমাদের দেশ থেকে দুর্নীতিকে পুরােপুরি দূর করা সম্ভব হবে।

২. TIB: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, দলীয় রাজনীতিমুক্ত ও অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশ্ব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে টিআইবি বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টার হিসেবে স্বীকৃত। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করে থাকে যার মাধ্যমে একটি দেশের দুর্নীতির মাত্রা প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরার ফলে এ ক্ষেত্রে সরকার সতর্ক থাকতে পারে।

google news

আরো পড়ুনঃ Bangladesh Sociology Special Brief Suggestion

খ. অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরােধ: শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি দেশের দুর্নীতি সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সর্বক্ষেত্রে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারলে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন করা সম্ভব হবে।

১. ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবােধ: দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে প্রথমেই প্রয়ােজন ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবােধের বিকাশ। প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক মূল্যবােধ সৃষ্টি করতে পারলে সমাজে দুর্নীতির মাত্রা উল্লেখযােগ্য মাত্রায় কমে আসবে।

২. সামাজিক প্রতিরােধ: দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে আমাদের সমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কেননা সামাজিক ঐক্যই পারে এই ব্যাধি থেকে দেশকে মুক্ত করতে। সমাজে যদি দুর্নীতিবাজকে ঘৃণা করা হয় এবং তাদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলা হয় তবে দুর্নীতি অনেকাংশে নির্মূল করা যাবে। উন্নত কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে গড়ে তুলতে হবে দেশব্রতী মানবদরদী নতুন সমাজ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা জাগিয়ে নতুন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ জন্যে রাষ্ট্রনেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূল স্লোগান হতে পারে “দুর্নীতি করে যে দেশের ক্ষতি করে সে”, “দুর্নীতি রোধ কর, উন্নয়নের হাল ধর”। 

৩. ধর্মীয় মূল্যবােধের বিকাশ: সমাজে দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ ধর্মীয় মূল্যবােধের অভাব। সমাজে ধর্মীয় মূল্যবােধের বিকাশ ঘটাতে পারলে এ সমস্যার সমাধান খুব সহজেই সম্ভব হবে। প্রতিটি মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায় দুর্নীতির ধর্মীয় কুফল সম্পর্কে আলােচনা করলে মানুষের মনে ভীতির সৃষ্টি করবে।

৪. সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যম ও মিডিয়া: দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যম যেমন— ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। এছাড়া ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে দুনীতিমুক্ত সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে। তাহলে এটা একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপলাভ করবে।

আরো পড়ুনঃ Write about the Main Novelists of 20th-Century English Literature and Compare Them with the Victorian Novelists. (বাংলায়)

৫. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: দুর্নীতিবিরােধী অভিযানে আইনের শাসন খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্নীতিকে একটি কঠোর শাস্তিযােগ্য অপরাধ হিসেবে জনগণের সামনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আইনকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে কেউ আইনের উর্ধ্বে নয় বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা ছাড়া কোনাে আইনের সর্বোত্তম প্রয়ােগ কোনােভাবেই সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে দুর্নীতিবিরােধী অভিযানের গ্রহণযােগ্যতাকে কোনােভাবেই বিনষ্ট করা যাবে না ।

৬. প্রশাসনে সংস্কার: স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও যােগ্যতাসম্পন্ন প্রশাসনিক খাত যেকোনাে দেশের দুর্নীতি প্রতিরােধে তাৎপর্যপূর্ণ। ভূমিকা পালন করে থাকে। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ সাফল্যের সঙ্গে দুর্নীতিকে প্রতিহত করতে পেরেছে তাদের কর্মপন্থায় প্রশাসন খুবই দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের দুর্নীতি বিস্তারের বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দুই ধরনের মৌলিক কারণ দৃষ্টিগােচর হয়— ১. প্রয়ােজনতাড়িত দুর্নীতি ২. লােভতাড়িত দুর্নীতি। এই দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে দুর্নীতির খাতগুলোকে সরাসরি আইনের আওতায় আনতে হবে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় যথাযথ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্নীতি মোকাবেলায় আরো কিছু পদক্ষেপ সম্পের্কে তুলে ধরা হলো- 

১. দুর্নীতিবিরোধী চিন্তাচেতনার বিকাশ ও বিস্তার ঘটানো। 

২. আন্দোলন পরিচালনার জন্য সংগঠন গড়ে তোলা। 

৩. নেতৃত্ব ও সংগঠনের প্রতি জনগণের সমর্থন ও আস্থা অর্জন করা। 

৪. দুর্নীতি মোকাবেলায় গঠিত সংগঠনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। 

৫. ক্ষমতা ও কার্যকারিতা বিবেচনায় দুর্নীতি মোকাবিলায় অধিকতর ফলদায়ক উপায় ও পন্থা নির্বাচন। 

৬. গৃহীত উপায় ও পন্থার প্রতি জনসর্থন যাচাই ও প্রয়োজনে সংশোধন। 

৭. জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি মোকাবিলায় কার্যকর পন্থা ও উপায় কার্যকরকরণ। 

৮. মূল্যায়ন ও কার্যকারিতা স্থায়ীকরণ। 

৯. ধর্মীয় বিধানাবলি প্রচার ও কার্যকর করা। 

১০. দুর্নীতিবিরোধী সাংস্কৃতিক কর্মকা- পরিচালনা করা। 

১১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। 

১২. দুর্নীতিবাজদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা। 

১৩. দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করা। 

১৪. দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ বা সামাজিকভাবে বয়কট করা। 

১৫. দক্ষ তদন্তকারী এবং সরকারি আইনজীবী নিয়োগ করে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা। 

১৬. দুর্নীতি দমন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা।

উপসংহার: বাংলাদেশের মতাে দ্রুত উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখা দেশে দুর্নীতি সুকৌশলে দানা বেঁধে উঠতে পারে। তাই এটি সম্পর্কে প্রথমে সাধারণ মানুষকে অবগত করা প্রয়ােজন। কারণ জনগণ দুর্নীতি সম্পর্কে যত সচেতন হবে ততই অসাধু ব্যক্তিরা দুর্নীতি করতে ভয় পাবে । পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে আন্তরিকভাবে দুনীতি দমনে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সামগ্রিক সমাজ থেকে দুর্নীতিকে বিদায় করা সম্ভব হবে।

Riya Akter
Riya Akter
Hey, This is Riya Akter Setu, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক