প্রশ্নঃ বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ আলোচনা কর
ভূমিকাঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই নারীর ক্ষমতায়নকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীদের সমাজের অর্ধেক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে তাদের সকল ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমান সরকারও নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে এবং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
শিক্ষাক্ষেত্রেঃ একটি প্রবাদ রয়েছে, একজন পুরুষকে শিক্ষা দেয়া মানে একজন ব্যক্তিকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা। আর একজন মেয়েকে শিক্ষা দেয়া মানে গোটা পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলা। জাতির কল্যাণ ও অগ্রগতিতে নারী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই সরকার নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। কেননা, নারী সমাজেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশ যেমন এগিয়ে যাবে, তেমনি দেশের উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও নারীর অবদান দৃষ্টিগোচর হবে। কাজেই নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সরকার নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, মেধাবৃত্তি, উপবৃত্তি, মিড-ডে মিল প্রদান ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এছাড়া মেয়েদের জন্য স্কুল ও কলেজ স্থাপন করে দেশের সকল স্তরে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা হয়েছে ও মেয়েদের জন্য টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্কুল ও কলেজে নারী শিক্ষিকা নিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আজ নারী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে আপন মহিমায় ভাস্বর। তাই নারী আজ ঘরের কোণে সেকালের মতো বন্দি থেকে অন্ধঅনুকরণ ও বিশ্বাসকে আঁকড়ে না ধরে শিক্ষা তাদের অন্তর-বাহিরকে জাগরিত করেছে।
আরো পড়ুনঃনারী উন্নয়নে ব্র্যাক এর কর্মসূচিগুলো কী?
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেঃ বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে সরকার কতৃক নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রণোদনা প্রদান, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তা প্রদান, অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি, ক্ষুদ্রঋণ প্রোগ্রাম ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কর্মসংস্থানে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। নিচে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে গৃহিত কিছু নীতিমালা উল্লেখ করা হলো।
- জাতীয় নারী নীতি (২০১১): নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য নীতিগত দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
- জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি (২০১৫): কর্মসংস্থানে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত।
- মহিলা উদ্যোক্তা তহবিল: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ প্রদান করে।
- জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) ফাউন্ডেশন: নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে।
নারীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গৃহিত কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলোঃ
- কারিগরি শিক্ষা বোর্ড: নারীদের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে।
- বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও গ্রামীণ শিল্প কর্তৃপক্ষ (BSIC): নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করে।
- বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ: নারীদের আয়োজনমূলক দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
নারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের লক্ষে গৃহিত কিছু পদক্ষেপ হলোঃ
- ক্ষুদ্রঋণ প্রোগ্রাম: নারীদের ছোট ব্যবসা শুরু করার জন্য ঋণ প্রদান করে।
- জামানতমুক্ত ঋণ: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ প্রোগ্রাম।
- অনুদান: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অনুদান প্রোগ্রাম।
সামাজিক ক্ষেত্রেঃ বাংলাদেশ সরকার সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে নারীদের আইনি অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। নারী নির্যাতন দমন ও প্রতিরোধ ও নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা উন্নতকরণ করা হয়েছে। এছাড়া নারীদের জন্য আশ্রয় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি করা হয়েছে।
নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা উন্নতকরণ করার লক্ষে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ
- মাতৃস্বাস্থ্য সেবা: গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে।
- শিশু স্বাস্থ্য সেবা: শিশুদের জন্য বিনামূল্যে টিকা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে।
- পরিবার পরিকল্পনা: নারীদের পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেঃ রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত। নারীরা জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, এবং তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনও সমাজের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত হওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। আমাদের সংবিধানে শুধু নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে ২৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ও জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। তা ছাড়া জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বিচারপতি, পাইলটসহ রাষ্ট্রের ঝুঁকিপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর উপস্থিতি লক্ষণীয়।
আরো পড়ুনঃবাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর নরগোষ্ঠী গত পরিচয়
- সংবিধানে নারীদের জন্য ৩০% সংরক্ষিত আসন রয়েছে।
- বর্তমান সংসদে ১০০ জন নারী সাংসদ রয়েছেন।
- স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে।
- নারীদের রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিভিন্ন বার্ষিক পরিকল্পনায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহঃ স্বাধীনতার পর ’৭২ সালের সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও প্রতিফলিত হয়েছে নারীর উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি।
১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮): এ পরিকল্পনার আওতায় ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ছিন্নমূল নারীর মা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও তাদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং ও চাকরি প্রদান করা।
২. দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৮-৮০): দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনায় নারী কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
৩. দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৮০-৮৫): এ পরিকল্পনার আওতায় ছিলঃ
ক. জাতীয় উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া।
খ. দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নারীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা।
গ. উপার্জনমূলক কাজে নারীদের অংশগ্রহণ করানো।
৪. তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৮৫-৯০): এ পরিকল্পনার আওতায় ছিল:
ক. সরকারি চাকরিতে নারীর কোঠা ১০% থেকে ১৫% এ উন্নীত করা।
খ. নারীর স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ।
৫. চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৯০-৯৫): এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল।
ক. সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী পুরুষের সমান অধিকার।
খ. নারীর দারিদ্র্য দূরীকরণ।
গ. নারীনির্যাতন বন্ধ করা।
৬. পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৯৭-২০০২): এ পরিকল্পনায় নারীকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্য কমিয়ে আনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এতে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক উভয় ক্ষেত্রেই নারী উন্নয়ন নীতিমালার লক্ষ্যসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে।
৭. পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার (১৯৯৫-২০১০): এ পর্যন্ত ১৫ বছরের জন্য নিমোক্ত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে –
ক. নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
খ. নারী উন্নয়নে NGO দের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা।
গ. CEDAW এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন দান।
৮. আইনি পদক্ষেপ: বাংলাদেশ সরকার নারী ও কন্যাশিশু এর নির্যাতন রোধে প্রচলিত আইনের সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। এসব আইনের মধ্যে রয়েছে-
ক. মুসলিম পারিবারিক আইন (১৯৬৯)
খ. যৌতুক বিরোধী আইন (১৯৮০)
গ. বাল্যবিবাহ রোধ আইন (১৯৭৪)
ঘ. পারিবারিক আদালত আদেশ (১৯৮২)
ঙ. নারী ও শিশু নির্যাতন আইন (১৯৮৩)
আরো পড়ুনঃবাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পরিবারের পরিবর্তনশীল ভূমিকা পর্যালোচনা কর।
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সরকার যেসব পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে তা অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু তারপরও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তার একমাত্র কারণ শুধু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় বাস্তবায়ন করা হয় না। তাই এসব পদক্ষেপ যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যাবে।