প্রশ্নঃ নগরায়ন কি? নগরায়নের নেতিবাচক দিকগুলো সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
ভূমিকাঃ নগরায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে নগর কেন্দ্রগুলির বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন ঘটে। এটি একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং পরিবেশগত কাঠামোর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। নিম্নে প্রশ্নালোকে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
নগরায়নঃ কোনো একটি স্থানে নগর সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে নগরায়ন (urbanization) বলে। অর্থাৎ, নগরায়ন গ্রামাঞ্চল থেকে শহুরে অঞ্চলে জনসংখ্যার স্থানান্তর, গ্রামের তুলনায় নগর অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি এবং সমাজের উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে। এটি মূলত এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শহর এবং নগরগুলো গঠিত হয় এবং আরও বেশি লোক বসবাস এবং কাজ শুরু করায় তা বৃহত্তর হয়ে ওঠে। মানুষ জীবন ও জীবিকা, উচ্চশিক্ষা বা কর্মসংস্থানের আশায় শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। জাতিসংঘ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রায় ৬৪ শতাংশ এবং উন্নত বিশ্বের ৮৬ শতাংশই নগরায়িত হয়ে নগরাঞ্চলে পরিণত হবে।
আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। এর প্রকৃতি ও স্বরূপ বা পরিধি ও বিষয়বস্তু আলোচনা করো।
নগরায়নের নেতিবাচক দিকঃ
বাংলাদেশ সম্প্রতি নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উপনিত হয়েছে। দেশে অনেক নতুন প্রকল্প, মেগা প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে। সে সাথে দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সিংহভাগ শহরকেন্দ্রিক। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চল এখনো অনেকখানি পিছিয়ে আছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমনঃ
১. পরিবেশের উপর প্রভাবঃ বিপুলসংখ্যক মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে শহর অঞ্চলে বাসস্থান সংকট দেখা দেয়। অতিরিক্ত লোকের বাসস্থানের ঘাটতি মেটাতে যথেচ্ছা দালানকোঠা নির্মাণের জন্য বৃক্ষ নিধন করা হয়। এটি পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে৷
২. নিম্ন জীবনযাত্রার মানঃ নগরায়নের ফলে বাড়তি জনবসতির চাপে পরিবেশ দূষণ ও বাসস্থান সংকটের পাশাপাশি খাদ্যের অভাব, পরিবহণ সংকট, যানবাহন সংকট ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র অভাব পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। ফলে উন্নয়নশীল নগরগুলোতে জীবনযাত্রার মান কমে যায় ও সল্প আয়ের মানুষেরা বস্তি গড়ে তুলে।
আরো পড়ুনঃ সামাজিক পরিবর্তন কি? সামাজিক পরিবর্তনের মার্ক্সিয় তত্ত্বটি আলোচনা করো।
৩. দূষণ ও দুর্বিষহ জীবনঃ ঢাকা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ শহর। মানহীন পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্যের তীব্র দুর্গন্ধর্গ ও বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠস্থ পানিকে দূষিত করছে। কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, চামড়া শিল্পের বর্জ্য, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ুদূষণের প্রধান নিয়ামক। ফলে হাঁপানি, সর্দি, ক্যান্সার, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়ার মত রোগের প্রাদুর্ভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঢাকা শহরে গড়ে ৯০০ টন বর্জ্য নিচু খোলা জায়গায় ফেলা হয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্বের অবসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
৪. কৃষিজমি ও খাদ্য সংকটঃ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও বাংলাদেশে জনপ্রতি কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ০.০৫ হেক্টর (বিশ্বব্যাংক, ২০১১)। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়লেও কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমতে শুরু করেছে। কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে শহরগড়ে তোলার কারণে খাদ্যসঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
৫. পানি সংকটঃ শহরাঞ্চলে জনবসতি বেশি হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্বভ হচ্ছে না। এছাড়া পানি অপচয় ও দূষণের কারণে সূপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। নগরবাসী জীবাণুযুক্ত পানি গ্রহনের ফলে ডাইরিয়া, টাইফয়েড সহ বিভিন্ন পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
৬. ঝুকিপূর্ণ নগরায়ণঃ অপরিকল্পিত নগরায়ন ও যানবাহন বৃদ্ধির ফলে ঢাকা শহরে গ্যাসের সংকট ও পুরনো গ্যাসের সংযোগ থেকে দুর্ঘটনার শঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যানবাহনের ধোঁয়া থেকে নির্গতর্গ সীসা, পারদ, নিকেল, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতির কারণে হাঁপা নি, সর্দি, কাশি সহ অন্যান্য এলার্জি জনিত রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
আরো পড়ুনঃ শিল্পায়ন কি? বাংলাদেশে শিল্পায়নের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো।
উপসংহার: অপরিকল্পিত নগরাণের ফলে শহরবাসীর জন্য শিক্ষা, চিকিৎসার সুবিধা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা দুরুহ ব্যাপার। পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। সুতরাং নগরায়নের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সুপরিকল্পিত উপায়ে নগর গড়ে তোলা উচিত।