প্রশ্নঃ সামাজিক আইন কি? ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ শিশু ও মহিলাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ বিধান এবং স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য নির্ধারণের উদ্দেশ্যে মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১ জারি করা হয়। মুসলমান নারীদের নিরাপত্তা বিশেষ করে বিবাহিত নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় এ আইনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সামাজিক আইনের সংজ্ঞাঃ সামাজিক আইন বলতে সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষকে যেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়, সেগুলোকে বুঝায়। সামাজিক আইন বলতে সমাজ কর্তৃক গৃহীত সেসব সুসংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপকে বুঝায়, যা সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে ক্ষতিকর অবস্থা থেকে ক্ষতিকর উপাদানসমূহ দূর করে সামাজিক অগ্রগতি ও লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ নিম্নে সামাজিক আইনের কিছু জনপ্রিয় সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো:
অধ্যাপক হল্যান্ড এর মতে, ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বলবৎকৃত এবং মানুষের বাহ্যিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ বিধিই আইন।
ডব্লিউ. উইলসন এর মতে, “সামাজিক আইন হলো সমাজের সেসব সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা বা রীতি-নীতি যেগুলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত ও রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিধিতে পরিণত হয়েছে এবং যেগুলোর পেছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সমর্থন রয়েছে।”
আরো পড়ুনঃ সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি কি?
স্যার হেনরী মেইন এর মতে, “কেবল সার্বভৌম শক্তির অনুশাসনই আইন নয়, দেশের প্রচলিত আচার-আচরণও আইন বলে স্বীকৃত। যদিও এগুলো কোনো সার্বভৌম শক্তির আদেশে তৈরি হয়নি।”
ভারতীয় সমাজকর্ম বিশ্বকোষ অনুযায়ী, “যথাযথ আইনসিদ্ধ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গৃহীত সামাজিক প্রথার সংশোধনকে সামাজিক আইন বলা যেতে পারে। এরূপ প্রথার কাজ হলো সাধারণত কোনো সমাজে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যার্জনের ব্যবস্থা করা।”
সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, “সামাজিক আইন বলতে সমাজজীবন হতে অবাঞ্ছিত অবস্থা দূর করে, সুষ্ঠু ও প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে প্রয়াস পায় সেগুলোকে বুঝায়। সমাজ সংস্কার সামাজিক আইনের মূল লক্ষ্য।”
মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১: বাংলাদেশে পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন মুসলিম নারীদের রক্ষায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আইনগত পদক্ষেপ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, বিবাহ, তালাক ভরণ- পোষণ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে কতিপয় আইনগত ধারা এতে সংযোজন করা হয়। এ আইনটি একাধারে শিশু কল্যাণ নারীকল্যাণ এবং নিরাপত্তামূলক সামাজিক আইন।
শিশু ও মহিলাদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ এবং স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো হলো:
১.অর্ডিন্যান্সের ব্যবস্থা অনুসারে রেজিস্ট্রঃ মুসলিম রীতি অনুসারে যেসব বিয়ে হবে তার প্রত্যেকটি এ অর্ডিন্যান্সের ব্যবস্থা অনুসারে রেজিস্ট্রি করতে হবে। বিয়ে রেজিস্ট্রির উদ্দেশ্যে ইউনিয়ন কাউন্সিল এক বা একাধিক ব্যক্তিকে লাইসেন্স দিবে এবং এ ব্যক্তি নিকাহ রেজিস্ট্রার বলে অভিহিত হবে।
২. দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রথম স্ত্রীর অনুমতিঃ প্রথম স্ত্রী বেঁচে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। তবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বামী-স্ত্রীর মনোনীত প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত সালিশ পরিষদের অনুমতিক্রমে দ্বিতীয় বিবাহ করা যাবে। সালিশ পরিষদ দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি প্রদানের সময় যে সমস্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করবে তাহলো প্রথম স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা, দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষা প্রভৃতি।
৩. প্রথম স্ত্রী তালাক দাবি করার অধিকারঃ সালিশ পরিষদের অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিবাহ করলে প্রথম স্ত্রী তালাক দাবি করতে পারবে এবং সমস্ত দেনমোহর পরিশোধে স্বামী বাধ্য থাকবে।
আরো পড়ুনঃ কিশোর অপরাধ কি? কিশোর অপরাধের কারণ গুলো আলোচনা কর।
৪. তালাক নোটিশ প্রদান করাঃ এ আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি তালাক শব্দটি উচ্চারণ করেই তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবে না। যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চায় সে তা লিখিত নোটিশের মাধ্যমে স্ত্রী এবং স্থানীয় চেয়ারম্যানকে জানাবে। এ আদেশে তিন মাসের মধ্যে কার্যকরী হবে। এ নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান স্থানীয় সালিশী পরিষদের মাধ্যমে ৯০ দিনের মধ্যে উভয়ের মিলনের চেষ্টা করবেন এবং তাতে ব্যর্থ হলে তালাক কার্যকরী হবে।
৫. স্ত্রীর দেনমোহর পরিষদঃ এ আইনের ধারা অনুসারে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে স্ত্রী চাহিবা মাত্র স্বামী দেনমোহর পূরণ করতে বাধ্য থাকবে। আর দেনমোহর আদায়ের বিষয়টি আইনগতভাবে স্বীকৃত।
৬. স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্বঃ কোনো স্বামী তার স্ত্রীর প্রয়োজন অনুসারে ভরণ পোষণে অক্ষম হলে এবং একাধিক স্ত্রী রাখলে, স্ত্রী এ বিষয়ে উপযুক্ত সাহায্য চেয়ে লিখিতভাবে ইউনিয়ন পরিষদে অভিযোগ দাখিল করতে পারবে। এরূপ পর্যায়ে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ মিটানোর জন্য পরিষদ সালিশি পরিষদের মাধ্যমে স্বামীর উপর আদেশ জারি করবেন এবং স্বামী দুবছর ব্যর্থ হলে স্ত্রী তাকে তালাক প্রদানের অধিকার লাভ করেন।
৭.ছেলে মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়াঃ এ আইনে বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলেদের ১৮ বছর এবং মেয়েদের ১৬ বছর ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়। পরে অবশ্য এ বয়স যথাক্রমে ২১ বছর ও ১৮ বছরে উত্তীর্ণ করা হয়।
৮. গর্ভবতী অবস্থায় কালীনঃ গর্ভবতী অবস্থায় কোনো প্রকার তালাক কার্যকরি হবে না।
৯.মুসলিম পারিবারিক আইনঃ মুসলিম পারিবারিক আইন মোতাবেক কোনো পরিবারে। কোনো শিশুদের দাদা জীবিত থাকা অবস্থায় পিতা মারা গেলে সে শিশুরা উত্তরাধিকার সূত্রে পৈত্রিক সম্পত্তির মালিক হবে।
আইনের কার্যকারিতা: মুসলিম পারিবারিক আইন নারীদের কল্যাণ ও জীবনের নিরাপত্তা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিয় পালন করে। উত্তরাধিকারী, বিবাহ, তালাক প্রস্তুতি, বিবাদেয় বয়স ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ আইনের কার্যকারিতা অনেক বেশি। এ আইনের বদৌলতেই অতীতের বঞ্চনার চেয়ে বর্তমান মহিলার উন্নয়নের সাথে অনেকখানি নিজেদেরকে সম্পৃত্ত করেছে।
আরো পড়ুনঃ কল্যাণ রাষ্ট্র কি? কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলী আলোচনা কর।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, যে দর্শনকে উপজীব করে মুসলিম পারিবারিক আইন প্রণীত হয়েছিলো সে লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। প্রশাসনিক জটিলতা, ক্ষমতাসীননে সদিচ্ছার অভাব, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে এই পূর্ণরূপে কার্যকরি হচ্ছে না। তাই এ আইনের সংশোধন অপরিহার্য।