fbpx

সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কি? সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা করো

প্রশ্নঃ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কি? সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা করো। 

ভূমিকাঃ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল এমন এক সামাজিক পদ্ধতি যার দ্বারা সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রন করা যায়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ফলেই সমাজে শান্তি – শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সুব্যবস্থিতভাবে সমাজ পরিচালিত হয়। সামাজিক নিয়ন্ত্রন হলো এমন একটি উপায় বা ব্যবস্থা, যার দ্বারা সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষিত হয়। সমাজ পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা

বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের প্রদত্ত কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :

ম্যাকাইভার ও পেজ বলেছেন – সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল এক বিশেষ পদ্ধতি যার দ্বারা সমাজব্যবস্থা সুসংহত ও সংরক্ষিত থাকে , পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে সুব্যবস্থিত করে তোলে।    

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। এর প্রকৃতি ও স্বরূপ বা পরিধি ও বিষয়বস্তু আলোচনা করো।

সমাজতাত্ত্বিক বটোমোর বলেছেন – সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল বিশেষ কিছু সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ , আইন ও আদর্শের সমষ্টি , যার মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গের জীবন ও সমাজ বাঞ্ছিত ও নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হয়। 

সমাজতাত্ত্বিক রস বলেছেন – সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল কিছু বিধি – ব্যবস্থার সমষ্টি – যার মাধ্যমে একটি আদর্শ মানের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।  

সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকা

সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে সমাজের মধ্যে নিয়ম-নীতি ও মানদণ্ডের অনুসরণের মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপায় রয়েছে, যার মধ্যে পরিবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার হল সমাজের আদি ও অকৃত্রিম প্রতিষ্ঠান। পরিবারই শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম ক্ষেত্র। পরিবারের মাধ্যমে শিশু সমাজের মূল্যবোধ, রীতিনীতি, প্রথা, সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে ও আয়ত্ত করতে পারে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, আচার-আচরণ, নিয়ম-নীতি ইত্যাদির মাধ্যমে শিশু সামাজিক নিয়মের সাথে পরিচিত হয়। পরিবার সামাজিক নিয়ন্ত্রণে যে ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

১. মূল্যবোধ ও নীতিবোধের বিকাশ: পরিবার হল শিশুর মূল্যবোধ ও নীতিবোধের বিকাশের প্রথম ক্ষেত্র। পরিবারের সদস্যদের আচরণ ও কথাবার্তা থেকে শিশু জানতে পারে কি ভালো আর কি মন্দ। পরিবারের সদস্যরা শিশুকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ, সহানুভূতিশীল, কর্তব্যপরায়ণ ইত্যাদি মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। এই মূল্যবোধ ও নীতিবোধের ভিত্তিতে শিশু সমাজে বসবাস করতে শেখায়।

google news

২. নিয়মানুবর্তিতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ: পরিবারের সদস্যরা শিশুকে নিয়মানুবর্তিতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দেয়। পরিবারের নিয়ম-নীতি মেনে চলতে শিখলে শিশু সমাজের আইন-কানুন মেনে চলতে শেখায়।

আরো পড়ুনঃ শিল্পায়ন কি? বাংলাদেশে শিল্পায়নের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো। 

৩. অসৎ ও অশালীন আচরণের প্রতিরোধ: পরিবারের সদস্যরা শিশুকে অসৎ ও অশালীন আচরণের প্রতিরোধ করতে শেখায়। পরিবারের সদস্যরা শিশুকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ, সহানুভূতিশীল, কর্তব্যপরায়ণ ইত্যাদি মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। এই মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিশু অসৎ ও অশালীন আচরণ থেকে বিরত থাকে।

৪. সামাজিকীকরণ: পরিবার শিশুর সামাজিকীকরণের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। পরিবারে শিশু সামাজিক মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, নৈতিকতা ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে। এই শিক্ষার মাধ্যমে শিশু সমাজের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।

৫. শাস্তি ও পুরস্কার: পরিবার শাস্তি ও পুরস্কারের মাধ্যমে শিশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। শিশুর কোনো ভালো কাজের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয় এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়। এই শাস্তি ও পুরস্কারের মাধ্যমে শিশু সমাজের ভালো ও মন্দ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং ভালো কাজ করার আগ্রহী হয়।

৬. অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ: পরিবার শিশুকে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ প্রদান করে। পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা, স্নেহ ও আবেগ শিশুকে ভালো কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে।

৭. সম্প্রীতি ও সহযোগিতা: পরিবারে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতা বিদ্যমান। এই সম্প্রীতি ও সহযোগিতা শিশুকে সমাজে অন্যের সাথে সুন্দরভাবে বসবাস করতে শেখায়।

৮. সমাজের মূল্যবোধ প্রচার: পরিবার সমাজের মূল্যবোধ প্রচার করে। পরিবারের সদস্যরা তাদের আচরণের মাধ্যমে সমাজের মূল্যবোধগুলোকে প্রচার করে।

সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ধর্মের ভূমিকা

ধর্মকে বলা হয় একটি প্রধান ও সার্বজনীন মানবীয় প্রতিষ্ঠান। নিম্নে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :

১. ব্যক্তি গঠনের মাধ্যম: ধর্ম মানুষের পরম বন্ধু। ধর্ম একটি গঠনমূলক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি গঠনের অন্যতম হাতিয়ার। ধর্ম ব্যক্তিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসে। অর্থাৎ বিভিন্ন অপরাধ থেকে বিরত রেখে সৎ ও নিষ্ঠাবান হিসেবে গড়ে তুলে। আর এভাবেই ‘ধর্ম’ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

২. সামাজিক ঐক্য সৃষ্টি: মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন যাপন করতে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে সমাজে শান্তি ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করে। ধর্ম পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতাকে সওয়াব বা পুণ্যের কাজ আখ্যায়িত করে পরস্পরকে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করে। এছাড়া প্রতিবেশীর খোঁজ খবর নিতে ধর্মে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তাই তাদের মাঝে সামাজিক ঐক্য তৈরি হয়। আর এভাবেই ধর্ম সামাজিক ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

আরো পড়ুনঃ সামাজিক পরিবর্তন কি? সামাজিক পরিবর্তনের মার্ক্সিয় তত্ত্বটি আলোচনা করো।

৩. ব্যক্তির কুপ্রবৃত্তি দমন: ধর্ম কেবল ব্যক্তিকে সমাজে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হিসেবেই উপস্থাপন করে না, ব্যক্তির কুপ্রবৃত্তিকেও দমন করে। অসৎ বা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হলে জাহান্নাম বা নরকে যাওয়ার কথা ধর্মে উল্লেখ করা হয়। ফলে ব্যক্তি তার কুপ্রবৃত্তি দমন করে আদর্শ জীবন যাপন করে।

৪. অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন রোধ: ধর্ম মানুষের অবৈধ পন্থায় অর্থ আয়ের পথ রোধ করে। বিভিন্ন ধর্মে অবৈধভাবে টাকা অর্জন করা থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। যেমন: ইসলাম ধর্মে অবৈধ উপার্জন, সুদ খাওয়া ও ঘুষ দেয়া- নেয়া উভয়ই হারাম করা হয়েছে। তাই অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ করে ধর্ম সামাজিক নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে সমাজকে শান্তিময় করে তুলে।

৫. শান্তির বিধান: ধর্মে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে বিভিন্ন অপরাধের জন্য আলাদা আলাদা শাস্তির বিধান রয়েছে। ফলে মানুষ এসব কঠোর শাস্তির ভয়ে অপরাধ থেকে বিরত থাকে। তাই বলা যায়, ধর্ম শাস্তির বিধান বা আইন রেখে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ করছে।

৬. আদর্শ জীবন দর্শন উপস্থাপনা: ধর্ম মানুষকে আত্মত্যাগ শেখায়। ফলে মানুষ তার লোভ লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ছাড়াও ধর্ম মানুষকে দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে পরকাল বা আখেরাতমুখী করে। ফলে মানুষ বেশি বেশি কথা ভাবে এবং তার পরবর্তী জীবন নিয়ে চিন্তা করে। ফলে সে আদর্শ জীবন যাপন করতে শিখে।
উপসংহার: সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হলো সমাজকে কলুষিত করে এমন কাজ থেকে ব্যক্তিকে বিরত রাখা এবং সমাজ থেকে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ দূর করে শান্তিপূর্ণ সমাজ তৈরির প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার হলো পরিবার ও ধর্ম। কেননা, পৃথিবীর ইতিহাসে পরিবার ও ধর্ম ব্যক্তিকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পেরেছে। তাই পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা ব্যাপক।

Shihabur Rahman
Shihabur Rahman
Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক