ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর

প্রশ্নঃ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর।  

earn money

ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনের পূ্বে ভারতবর্ষে প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর মুসলিম শাসন বিদ্যমান ছিল। ১২০৬ সালে দিল্লি ও আজমির জয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৫৭সালে পলাশির যুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ভারতবর্ষে শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ শাসন। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার  সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক, ধর্মীয, সাংস্কৃতি সহ সর্ব ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব: ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার সমাজ কাঠামােতে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো;  

১। হিন্দু মুসলিম দূরত্ব সৃষ্টি: মুসলমানদের নিকট থেকে ক্ষমতা দখলের পর শুরু থেকেই ব্রিটিশরা মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। তাদের আশঙ্কা ছিল হারানাে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য মুসলমানরা যেকোনো সময় সুযােগের সঠিক ব্যবহার করতে পারে। তাই ব্রিটিশ শাষকগোষ্ঠী মুসলমানদের সব সুযােগ সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং হিন্দুদের পৃষ্ঠপােষকতা করে। এর ফলে হিন্দু মুসলিম দূরত্ব সৃষ্টি হয়। 

২। ভাগ কর ও শাসন কর’ এ নীতিঃ ব্রটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে “ভাগ কর ও শাসন কর’ এ নীতি প্রয়ােগ করার মাধ্যমে কয়েকশ বছরের ঐতিহ্য হিন্দু মুসলিম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ফাটল ধরায়। হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের তিক্ততা তৈরি করে। এর মাধ্যমে কৌশলে তারা নিজেদের শাসন ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে।  

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


আরো পড়ুনঃ কেবিনেটের একনায়কত্ব কি?

৩।সাম্প্রদায়িকতা তৈরি: ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা দখলের পর তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলিমদেরমাঝে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে থাকে। অপকৌশলে মুসলমানদের জমিদারি সিনিয়ে নেয়। সুষ্টি করে নব হিন্দু জমিদার। চাকরি,ব্যবসা বাণিজ্য সহ সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের অগ্রাধিকার প্রদান করে। ফলশ্রুতিতেদিন দিন দিন সমাজে সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা ক্ষমতার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করার জন্য জন্য হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক তৈরি করে। এভাবে মুসলমানদেরকে হিন্দু বিদ্বেষী করে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে।  

৪।  সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস: ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার জনগণের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় হিন্দু জনগণ আস্তে আস্তে শিক্ষিত হয়ে ওঠে  পক্ষান্তরে মুসলমানদের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হতে থাকে। সার্বিকভাবে তৎ্কালীন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবারই সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পায়।  

৫।মুসলমানদের সংস্কার আন্দোলন: ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষে মুসলিম সমাজ বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলে।বিভিন্ন মুসলিম চিন্তাবিদ  পাশ্চাত্য ভাবধারা হতে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। তত্কালীন সংস্কার অন্দোলনের মধ্য আলীগড় আন্দোলন ও ফরায়েজি আন্দোলন অন্যতম।

৬।হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি: ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপােষকতায় হিন্দুগণ ইংরেজি ভাযা ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে শিক্ষিত হতে থাকে। রাজা রামমােহন রায়ের প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও রাধাকান্ত দেবের শিক্ষা অনুরাগ একটি শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টিতে সহায়তা করে। ১৮৪৩ সালে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু জনগন ‘Bengal British India Society’, ১৮৫১ সালে ‘British India Association’  এবং ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও আনন্দমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় ‘India Association’ নামক একটি সংগঠন গড়ে তােলে। এসব সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংগঠিত করা এবংব্রিটিশ শাসকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা।

৭। রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও প্রতিপত্তি ধ্বংস: বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও প্রতিপত্তি ধ্বংস হতে থাকে। ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে এতে হিন্দু মুসলিম সকল জমিদারই তাদের জমিদারি হারায়। এর ফলে বাংলার বহুদিনের চিরাচরিত ঐতিহ্য ও প্রতিপত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। 

আরো পড়ুনঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ?

৮। সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম: ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বে (Bombay) (বর্তমান মুম্বাই) শহরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। এটি ছিল ভারতীয়দের সর্বপ্রথম সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন। কংগ্রেসর পতাকাতলে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রণি রাজনৈতিকভাবে আরও সুসংগঠিত হতে থাকে। এ সংগঠনটি ব্রিটিশদের পূষ্ঠপােষকতায় গঠিত হলেও অচিরেই তা ব্রিটিশ বিরােধী সংগঠনে রুপান্তরিত হয় এবং পরবর্তীতে এ সংগঠনের মাধ্যমেই এদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়।

৯। মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি: সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হিন্দুরা ব্রিটিশবিরোধী হয়ে ওঠলে ব্রিটিশরা তখন মুসলমানদের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা শুরু করে। ফলে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রাহের পর মুসলমান সমাজে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নওয়াব আব্দুল লতিফ,  সৈয়দ আমীর অলী প্রমুখের চেষ্টায় মুসলমানগন ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে । ফলে মুসলমানদের মধ্যেও ধীরে ধীরে একটি শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে।

১০। সাংস্কৃতিক প্রভাব: ইংরেজরা সুদীর্ঘ প্রায় দুইশত বছর এদেশ শাসন করে। ফলে এদেশে অনেক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধিত হয়।বাংলার সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি  যোগসূত্র তৈরি হয়। এ সাংস্কৃতিক যোগসূত্র এদেশের সাংস্কৃতিক ভাবধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। 

১১। কৃষক আন্দোলন:  লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। যা ছিল এদেশের কৃষক সমাজকে শােষণ ও  নির্যাতনের অন্যতম হাতিয়ার। এ শােষণ ও নির্যাতনের অংশ হিসেবে

তত্কালীন ইরেজ নীলকররা এদেশের কৃষকদের নীল চাষ করতে বাধ্য করে। এর ফলে এদেশে কৃষকদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। এই অসন্তোষ পরবর্তীতে নীল বিদ্রোহে রূপ নেয় ।

১২। কুটিরশিল্পের বিলুপ্তি: ১৭৫৭ সালের সিপাহী  বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে  এ দেশের কুটিরশিল্প ধ্বংস ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে থাকে। ফলশ্রুতিতেকুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত এদেশের হাজার হাজার মানুষ  কর্মহীন হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এদেশের দেশীয় শিল্প কমতে থাকে। 

১৩। বেকারত্ব বৃদ্ধি: শিল্পবিপ্পবের পর ইংল্যান্ড থেকে তৈরি পোশাক সহ নানা জিনিসপত্র বাংলায় আমদানি করে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত বাংলার অনেক যুবসমাজ বেকার হয়ে পড়ে এবং সর্বক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়।  

১৪। ইউরােপীয় বণিকদের একচেটিয়া বাণিজ্য: ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার বাণিজ্য ব্যবস্থা একচেটিয়া  ইউরোপীয় বণিকদের হাতে চলে যায়। তারা গােমস্তা, বেনিয়ান ও মুতসুদ্দির মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করে। ফলে উপমহাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে প্রচণ্ড আঘাত আসে।

১৫। পরিবর্তনের ছোঁয়া: ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই পরিলক্ষিত হয়। ইংরেজদের সংস্কৃতির প্রভাবে এদেশের মানুষের মাঝে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সহ নানা ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। 

১৬।যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি সাধিত হয়। ব্রিটিশরা শাসনভার গ্রহণের পর নতুন নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, রেলপথ নির্মাণ  করে এবং,  ডাক ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি করে । 

১৭। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন: প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা তথা ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন শুরু করে। যদিও এ শিক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের অনুকূলে কাজ  করে  কিন্তু পরবর্তীতে এই শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণি ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব পোষণ করতে থাকে এবং জাতীয়তাবাদী তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয় । 

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোেচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনামল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ব্রিটিশ সরকার তাদের শাসনের শুরু থেকেই শাসনের নামে শােষণ শুরু করে। তবে তারা যে শুধু শোষণই করেছে বিষয়টি এমন নয় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে এদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন; শিক্ষা, সংস্কৃতি যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের স্বার্থ চরিতার্থ করা।  

Riya Akter
Riya Akter
Hey, This is Riya Akter Setu, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক