প্রশ্নঃ ভদ্রবেশী অপরাধ বলতে কি বুঝ?
ভদ্রবেশী অপরাধঃ গতানুগতিক অপরাধপ্রবণতা থেকে ভিন্নধর্মী একটি অপরাধের নাম ভদ্রবেশী অপরাধ। ইংরেজিতে যেটি White Collar Crime. বুদ্ধির দ্বারা সংঘটিত অপরাধ; এই হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা নানাভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে বা পর্দার অন্তরালে থেকে অপরাধের আশ্রয় নেয়।
হোয়াইট কলার অপরাধ সর্বাপেক্ষা সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশের করপোরেট বা করপোরেশনে। ভদ্রবেশী অপরাধের প্রকৃতি উন্মোচন করেন প্রখ্যাত মার্কিন অপরাধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাদারল্যান্ড, যিনি ভদ্রবেশী অপরাধের উদ্ভাবক। সাদারল্যান্ড বলেন, আর্থসামাজিকভাবে উচ্চশ্রেণির ব্যক্তি কর্তৃক এমন কর্মকাণ্ড, যা তাদের পেশাগত কাজের প্রক্রিয়ায় ঘটে থাকে। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত কাজ না করে অবৈধ সুযোগণ্ডসুবিধা গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট কাজটি সম্পন্ন করে। এমনকি অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ উচ্চশ্রেণির এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় অপরাধ করেও শাস্তি পায় না। ফলে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কি? সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা করো
প্রচলিত সাধারণ শ্রেণির অপরাধ যেকোনো শ্রেণির ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হতে পারে। তবে White Collar Crime চতুর ও উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হয়।
ভদ্রবেশী অপরাধ ও বাংলাদেশঃ
প্রত্যেক সমাজেই কমবেশি ভদ্রবেশী অপরাধ সংঘটিত হয়। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেআইনি সহযোগিতা ভদ্রবেশী অপরাধের পথকে সুগম করে দেয়। সমাজের উচ্চশ্রেণির লোকরা নিজের স্বার্থের জন্য বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য এসব অনৈতিক ও অমানবিক কাজ করে।
বাংলাদেশে সাধারণত যেসব White Collar Crime লক্ষ্য করা যায়, তার মধ্যে অন্যতম- আয়কর ফাঁকি, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ফাঁকি, ঘুষগ্রহণ, শেয়ারবাজারে কারসাজি, মজুদদারি, বিজ্ঞাপন ও বিক্রিতে মিথ্যা বর্ণনা ইত্যাদি।
১. আয়কর ফাঁকিঃ সঠিক হারে কর দেওয়া তো দূরের কথা, এ দেশের বেশির ভাগ করারোপযোগ্য ব্যক্তি নিজেকে করদাতা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োজনীয় Taxpayers Identification Number (TIN) পর্যন্ত গ্রহণ করেন না। আয়কর প্রদানের সংস্কৃতি এ দেশে গড়ে ওঠেনি। আয়কর ফাঁকি দেওয়ার কারণে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ প্রায় সবাই হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল।
২. ঘুষ গ্রহণঃ White Collar Crime-এর সর্বোৎকৃষ্ট ও বিস্তৃত ক্ষেত্র হচ্ছে বিভিন্ন স্তরে ঘুষের আদান-প্রদান। যেসব ব্যক্তি কোনো কাজ করিয়ে নিতে চায়, তারা তাদের নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ঘুষ দেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর অর্থলিপ্সার কারণে সাধারণ ভোক্তারা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়।
আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে অগাস্ট কোঁতের অবদান আলোচনা করো।
৩. শেয়ারবাজারে কারসাজিঃ কিছু কিছু কোম্পানি এবং শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দেয়, এবং সময়মত বিপুল পরিমাণ টাকা উঠিয়ে সরে পড়ে। এভাবে শেয়ারবাজারে কৃত্রিম দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
৪. মজুদদারিঃ বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে ব্যবসায়ীরা বাজারে ওই পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ফলে চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ার কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এভাবে মজুদদারি ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন আমাদের দেশের জন্য একটি চরম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এ ধরণের ব্যবসায়ীরা ভদ্রবেশী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত।
৫. বিজ্ঞাপন ও বিক্রিতে মিথ্যা বর্ণনাঃ পণ্যদ্রব্য ভোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনের প্রতিযোগিতায় প্রায়ই উৎপাদনকারীরা মিথ্যার আশ্রয় নেন। যেমন : বাজারে যেসব ফলের জুস পাওয়া যায়, উৎপাদনকারীরা তাদের বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন ফলের নাম উল্লেখ করেন এবং মোড়কে সেসব রসালো ফলের আকর্ষণীয় রঙিন ছবি ছাপান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তারা ওই জুসে ফল নয় বরং ফলের সুগন্ধ (Fruit Flavour) ব্যবহার করেন। এভাবে মিথ্যা বর্ণনার মাধ্যমে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করাও এক ধরনের ভদ্রবেশী অপরাধ।
আরো পড়ুনঃ সামাজিক পরিবর্তন কি? সামাজিক পরিবর্তনের মার্ক্সিয় তত্ত্বটি আলোচনা করো।
এ ছাড়া মানি লন্ডারিং, ইন্স্যুরেন্স প্রতারণা, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে কৌশলে বঞ্চিত করা, উন্নয়ন খাতের অর্থ আত্মসাৎ, রোগীর শরীরে বিনা প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার, সরকারি হাসপাতালে সঠিকভাবে রোগী না দেখে প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখার প্রবণতা, প্রকৌশলী কর্তৃক অর্থ আত্মসাৎ-পূর্বক নিম্নমানের সেতু ও রাস্তাঘাট তৈরি, দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক ঘুষ গ্রহণ, আইনজীবী কর্তৃক মক্কেলের সঙ্গে অসদাচরণ ও হয়রানি, রাজনীতিবিদ কতৃক জনগণের ভোটাধিকার বা গনতন্ত্র হরণের চেষ্টা ইত্যাদি বিষয়গুলো ভদ্রবেশী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত।